somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাপ রহস্য

০৮ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব অল্প বয়সেই হাজারো রহস্য কুটিমিয়ার মনের ভিতর গেঁথে গিয়েছিল। সে মনে মনে সেসব রহস্যের জট খুলতে চেষ্টা করে; কোনোটার জট খোলে, কোনোটা আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে, তার কচি মন কোনো কূল-কিনারা পায় না। সে কেবল ভাবে আর ভাবে।
আরো ছোটোবেলায় দাদিমার কাছে সে রূপকথার রাজপুত্র আর পঙ্খিরাজের গল্প শুনতো। গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে রাজপুত্র মনে হতো। সুরম্য রাজপ্রাসাদে পারিষদ পরিবেষ্টিত রাজদরবার নয়, হীরক-খচিত সিংহাসনের আকাঙ্ক্ষা নয়, নয় রাজকোষ ভর্তি মণি-মুক্তো-জহরত, কিংবা ভিনদেশী অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যার জন্য লালসা কিংবা বাসনা, তার সাধ হতো যদি তার একটা পঙ্ক্ষিরাজ ঘোড়া থাকতো, তার পৃষ্ঠে আরোহণ করে সে তারার রাজ্যে, মেঘের রাজ্যে উড়ে বেড়াতো, বহুদূরের স্বপ্নপুরীতে পরীর রাজ্যে সে চলে যেতো, যেখানে ঝলমলে ফরসা পরীরা ডানায় ভর করে সারারাত নৃত্য করে।
কিশোর কুটিমিয়ার সাধ হতো, তার যদি একটা জাদুর কাঠি থাকতো, এক টুকরো পাথরে সে কাঠি ছুঁইয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি হীরা হয়ে যায়, অট্টালিকার গায়ে সে কাঠি আলতো করে ছুঁইয়ে দিলে মুহূর্তে তা সোনার প্রাসাদে পরিণত হয়।

পাতালপুরীতে বাস করে ভয়ংকর এক রাক্ষস। রাজকন্যা কংকাবতীকে সেই পাতালপুরীতে বন্দি করে রেখেছে এই রাক্ষস। কংকাবতীকে সে বিয়ে করবে। কাঁদতে কাঁদতে রাজকুমারীর চোখ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে; নিষ্ঠুর রাক্ষসের মনে কোনো মায়ার উদ্রেক হয় না, রাজকন্যাকে মুক্তিও দেয় না। রাক্ষসের হাত থেকে রাজকন্যাকে মুক্ত করে এনে দেবার জন্য তামাম রাজ্য লিখে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রাজা। কিন্তু রাক্ষসের আস্তানার সন্ধানই জানে না কেউ।
সাত আসমানের ওপর দিয়ে পঙ্খিরাজের পাখায় চড়ে উড়ে যাচ্ছিল রাজপুত্র ডালিমকুমার। হঠাৎ পৃথিবীতে এক যুগল ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির কথোপকথনে তার কান খাড়া হয়ে যায়। তারা বলাবলি করছিল— আজ ভোরে সূর্যোদয়ের আগেই কংকাবতীকে কতল করা হবে। আহা রে, রাক্ষসটার মনে একটুও দয়ামায়া নেই। পৃথিবীতে কেউ কি নেই এসে কংকাবতীকে উদ্ধার করে?

পঙ্খিরাজের লাগাম টেনে মুহূর্তে ডালিমকুমার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমিদের কাছে নেমে আসে, কংকাবতীর সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে নিয়ে দ্রুত উড়াল দিয়ে সপ্ত সমুদ্রের অন্ধকার সুড়ঙ্গ বেয়ে পাতালপুরীতে রাক্ষসের আস্তানায় গিয়ে সে হাজির হয়। রাক্ষস ছিল তখন ঘুমে আর আবদ্ধ কুঠরির কোনায় বসে তখন রাজকন্যা কংকাবতী কেঁদে কেঁদে জাড় হচ্ছিল। এ রাতটাই বেঁচে থাকবার জন্য তার শেষ রাত, রাত পার হবার সাথে সাথেই নির্দয় ও লোভী রাক্ষসটি তার প্রাণ সংহার করবে। মনুষ্য পদশব্দে সামনে চোখ তুলে তাকিয়েই কংকাবতী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে সামনে এসে কুঠরির লোহার শিক ধরে দাঁড়ায়। বলে, কে তুমি সাহসী যুবক, তোমার কি জীবনের একটুও ভয় নেই? এক্ষুনি তুমি রাক্ষসের এই আস্তানা ত্যাগ করো, নইলে তুমি প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।
ঠিক ঐ সময় সমস্ত পাতালপুরী কাঁপিয়ে গর্জন করতে করতে কুঠরির দিকে অগ্রসর হলো রাক্ষসটি। কংকাবতী আরো ভয় পেয়ে গেলো। সে বললো, শীঘ্র পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও। কিন্তু ডালিমকুমারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, সে এক ঝংকারে খোল থেকে তরবারি বের করে রাক্ষসের পথের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে রইলো। বললো, তুমি একটুও ভয় পেয়ো না সোনার কন্যা, এই রাক্ষসকে হত্যা করে তোমাকে আমি মুক্ত করে নিবই।
এমন সময় বিকট অট্টহাসি দিতে দিতে সামনে এসে দাঁড়ায় রাক্ষস। বহু উচ্চ তার দেহখানি, সুদীর্ঘ তার হাত, ডালিমকুমার তরবারি তাক করে মাথা উঁচু করে রাক্ষসের মুখের দিকে তাকায়। রাক্ষস হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে উদ্যত হতেই তার দু-পায়ের ফাঁক গলে ডালিমকুমার অন্য পাশে চলে যায়। সে রাক্ষসকে লক্ষ্য করে তরবারি ছোঁড়ে, কিন্তু তা বার বারই কেবল হাওয়ায় লেগে ব্যর্থ হয়ে যায়। এভাবে দুজনের মধ্যে আক্রমণ আর পালটা আক্রমণের উদ্যোগ চলতে থাকলো।
ডালিমকুমার খুব চতুর, বুদ্ধিমান এবং রণকৌশলী। সুযোগ পেয়েই রাক্ষসের ডান পা বরাবর তরবারি চালনা করলো, আর পা-টি দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেলো। কিন্তু রাক্ষসের গায়ে শক্তি একটুও কমে নি, তার তেজ যেন আরো বেড়ে গেলো। সে আরো মরিয়া হয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে ডালিমকুমারকে ধরতে উদ্যত হতেই সে আরেকটা মওকা পেয়ে যায় এবং এবার রাক্ষসের বাম পা বরাবর তরবারি চালায়; বাম পা-ও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অবাক কাণ্ড, কাটা পায়ের ওপর ভর করেই দুর্জেয় রাক্ষসটি গর্জন করতে করতে ডালিমকুমারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো। এবার ডালিমকুমার রাক্ষসের বাম হাতের গোড়া পর্যন্ত তরবারি চালিয়ে বাম বাহুও আলাদা করে ফেলে। রাক্ষসের ডান বাহুটি আলাদা করতে ডালিমকুমারকে প্রচুর বেগ পেতে হলো।

এরপর রাক্ষসের কৌশল বদলে গেলো, কখনো লাফিয়ে লাফিয়ে কখনো গড়াগড়ি দিয়ে মুখে বিশাল হাঁ করে সে ডালিমকুমারের দিকে তেড়ে আসতে লাগলো। রাক্ষসের গলা বরাবর বেশ কয়েকবার তরবারি চালিয়েও ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা গেলো না। এতো লড়াই করার ফলে ডালিমকুমারের শরীরও নেতিয়ে আসতে লাগলো। সে যতো জোরে তরবারি চালনা করতে যায়, রাক্ষসের শরীরে ততো বড় ক্ষত সৃষ্টি হয় না। এমন সময় কংকাবতী চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, হে যুবক, তুমি তো এভাবে রাক্ষসটার প্রাণ সংহার করতে পারবে না। ওর শরীর কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও ওটা মরবে না। তোমার মাথার ওপর তাকিয়ে দেখো, একটা বাঁশের চোঙ্গা ঝুলে আছে, ওটার ভিতরে আছে বিষাক্ত এক কালো ভ্রমর, সেই ভ্রমরের প্রাণটাই হলো এই রাক্ষসের প্রাণ। ভ্রমরটা না মারতে পারলে রাক্ষসটা কোনোদিনই মরবে না। রাক্ষসের এই মৃত্যুরহস্য রাক্ষসের পর দ্বিতীয় যেজন জানে সে হলো এই কংকাবতী। তার মন পাওয়ার আশায় কোনো এক আবেগঘন মুহূর্তে অসাবধানে রাক্ষসটা এই রহস্য কংকাবতীকে বলে ফেলেছিল। কিন্তু কংকাবতীর এখন বেশ আফসোস হচ্ছে। প্রথম দেখায়ই যুবককে এই কথা বলে দেয়া উচিত ছিল।
হাত দিয়ে ইশারা করতেই একটু দূরে দণ্ডায়মান পঙ্খিরাজ ঘোড়া সামনে চলে আসে। ডালিমকুমার চোখের পলকে এক লাফে পঙ্খিরাজের পিঠে চড়ে শূন্যে বাঁশের চোঙ্গার দিকে ধাবিত হয়। এক ছোঁ-তে চোঙ্গাটি হাতে তুলে নিয়ে ওটার মুখ খুলে ফেলে, আর তখনই কালো ভ্রমরটি বেরিয়ে ভনভন শব্দে উড়ে উড়ে ডালিমকুমারকে হুল ফোটাতে আসে। কয়েকবার তরবারি চালনার পর ভ্রমরের মাথাটি তরবারির আঘাতে আলাদা হয়ে যায়, আর ঐ সময় নীচে গর্জনরত রাক্ষসটি প্রচণ্ড আর্তনাদ করতে করতে নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
কংকাবতীকে উদ্ধার করে ডালিমকুমার তার মা-বাবার হাতে সমর্পণ করে; ডালিমকুমারের বীরত্বে মুগ্ধ রাজা-রানি তার হাতেই তাঁদের কন্যা সম্প্রদান করে রাজ্য আর রাজসিংহাসন বুঝিয়ে দিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন।

রাতে দাদিমার গলা ধরে শুয়ে শুয়ে প্রতিদিনই কুটিমিয়া ডালিমকুমার আর কংকাবতীর গল্প শুনতে চাইতো। গল্প শুনতে শুনতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়তো। ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখতো, তার তরবারির ঝলকানিতে পাতালপুরীর রাক্ষসের হাত-পা-মাথা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।
কুটিমিয়া নিগূঢ় মনে কামনা করতো, যেন তার একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া হয়, যেন সে পাহাড় পর্বত আসমান সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়াতে পারে।



যেজন সাপের পা দেখে সে নাকি রাজা হয়। কিশোর কুটিমিয়ার মনে কত আফসোস— সে আজও সাপের পা দেখতে পেলো না।

পাশের বাড়ির নুয়াবালি বয়সে কুটিমিয়ার চেয়ে পাঁচ মাসের বড়। ওর কাছেই সে প্রথম গাছে উঠতে শিখেছিল। নুয়াবালি বলেছিল সাপের মাথায় মণি থাকে। এক মণি সাত রাজার ধন। সাপের মণির জন্য কুটিমিয়ার মন কাঁদতো। বনেজঙ্গলে দৈবাৎ কোনো সাপ দেখে ফেললে কুটিমিয়া দূরে দাঁড়িয়ে পরখ করতো সাপটির মাথায় কোনো মণি জ্বলছে কিনা। কখনো কখনো নুয়াবালি সাপের খোঁজে জঙ্গলে চলে যেতো, সঙ্গে থাকতো কুটিমিয়া। নুয়াবালির দুর্দান্ত সাহস। জঙ্গলের লতাপাতা আর গাছপালা ফাঁক করে একটা লাঠি হাতে নুয়াবালি ঠুকঠাক করে হাঁটতো, আর সাপের তালাশ করতো।
মণির আশায় কুটিমিয়ার সাপুড়ে হবার সাধ হয়েছিল।
নুয়াবালি বলতো, ‘সব সাপই সাপ না।’ বিড়া পাকিয়ে তার ওপর বিশাল ফণা তুলে চারদিক কাঁপিয়ে ফোঁস ফোঁস গর্জন করতে থাকে সাপ। সেই গর্জনরত সাপ দেখে ভয়ে মানুষ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আসলে ওটা সাপ না, সাপের ছলে অন্য কিছু। এরূপ বিড়া পাকানো সাপের সামনে সাহস দেখাতে হয়— হাত বাড়িয়ে খপ করে সাপটির ফণা ধরে ফেললে দেখা যাবে সাপটা মুহূর্তে একটা চারাগাছ হয়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে। হয়তোবা দেখা যাবে ওটা মাটিতে পোঁতা একটা লাঠি, কিংবা একটা ঘুঘুর ছানা, বা একটা পাকা ডালিমফল; এমনকি মস্ত বড় একটা জবাকুসুমও হয়ে যেতে পারে সাপটা। আদতে সাপটা কীসের রূপ ধারণ করবে তা নির্ভর করে সাপের ছলধারী অশরীরী আত্মার মর্জির ওপর।
নুয়াবালির কাছে সাপের ছল বদলের কাহিনি শুনে কুটিমিয়া খুব রোমাঞ্চিত হতো। সে মূলত শান্ত গোছের ছেলে; সঙ্গীরা প্রায়ই তাকে ভীতু বলে খোটা দিয়ে থাকে। সাপের আস্ত একটা বিড়া হাত পাকিয়ে ধরে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চায়, সে মোটেও ভীতু নয়।

পশ্চিম পাড়ায় খাঁ-দের জোলার ওপর বড় দুটি জামগাছ। আষাঢ় মাসে জাম পাকার মৌসুমে সেই গাছে ছেলেদের জাম পাড়ার ধুম পড়ে যায়। ওরা দল বেঁধে গাছে চড়ে, জাম পাড়ে, আবার দল বেঁধে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে জোলার পানিতে— সেও এক মজার খেলা।
এমন এক এক আষাঢ়ে মৌসুম। রাতভর বৃষ্টি হয়েছিল; ফলে গাছ ভিজে পিচ্ছিল। সকালবেলা নুয়াবালি আর কুটিমিয়া গাছে উঠলো। দুজনে দু ডালে। গাছ পিচ্ছিল হওয়ার কারণে অল্প একটু উঠতেই কুটিমিয়ার বুক কাঁপতে লাগলো। নেমে যাবে কী যাবে না এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ডালের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে কুটিমিয়া স্থির হলো।
‘উডা যায় না রে। আয় নাইম্যা যাই।’ কুটিমিয়া বলে।
‘ধূর বেডাহাল্লা, গাছে উইড্যা কেওই খালি মুহে নামে?’ নুয়াবালি মৃদু ভর্ৎসনা করে।
কুটিমিয়া ডালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে।
‘কুডি!’ হঠাৎ নুয়াবালি ডেকে ওঠে, ‘ঐ দ্যাক্‌, পক্কির বাসা...’
‘কী পক্কি রে?’ কুটিমিয়া চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
‘হালিক।’
‘আন্ডা পারছে?’
‘আমি কি অহনতুরি দেকছি? উপ্‌রে উইড্যা আয়।’ বলেই নুয়াবালি ডাল বেয়ে পাখির বাসার দিকে যেতে থাকে। কুটিমিয়ার মন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সে আগের ডাল থেকে নেমে এসে নুয়াবালির ডাল বরাবর উঠতে থাকে।
পাখির বাসার কাছে পৌঁছে ডান হাত বাড়িয়ে ভিতরে হাত ঢোকাতে উদ্যত হলো নুয়াবালি, ঠিক অমন সময়ে বাসার ভিতর থেকে মাথা বের করে প্রকাণ্ড এক গোখরা বিশাল চওড়া আর উঁচু ফণা তুলে ফোঁস করে উঠলো, রাগ আর উত্তেজনায় তার শরীর যেন ফেটে পড়ছে। নুয়াবালি হকচকিয়ে যায়, হাত গুটিয়ে আনে। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে ওঠে।
‘কুডি। নড়িস না তুই। ঐহানেই থাক।’ স্থিরভাবে সাপের জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে সাবধানে কুটিমিয়াকে বলতে থাকে নুয়াবালি।
কুটিমিয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এই ভয়ানক কাণ্ড। সে আর্তস্বরে ডাকে, ‘নুয়াবালি, জলদি নাইম্যা আয়!’
‘কতা কইছ না, চুপ কইর‌্যা বইয়া থাক। এইড্যা সাপ না রে!’ নুয়াবালি ভাবে এটা সাপের ছলধারী অন্যকিছু, এর লাফানো ফণা খপ করে ধরে ফেললেই এটা একটা পাখির ডিম হয়ে যাবে। সে ডিমের ভিতরে হলুদ রঙের কুসুমের বদলে একটা মণি আছে, যার দাম সাত রাজার ধনের চেয়েও অনেক বেশি।
কিন্তু কুটিমিয়া ভয়ে কাঁপছে। সে বলছে, ‘নুয়াবালি, আমার ডর করবার লাগছে। মাইনষেরে ডাক দেই?’
‘কেওইরে ডাক দিওন লাগবো না। ডরাইলেই ডর। জীবনে তুই তো কুনো আজব কাণ্ড দেহছ নাই। আইছক্যা দ্যাক। অহনে দ্যাকতেছো সাপ, একটু পরেই দেকবি আমার হাতে একটা দড়ি।’ বলেই নুয়াবালি হাত বাড়িয়ে সাপের ফণা ধরতে উদ্যত হলো, আর সঙ্গে সঙ্গে ‘ও বাবারে...’ বলে গগণভেদী চিৎকার দিয়ে উঠলো।

নুয়াবালিকে বাঁচানো যায় নি। কুটিমিয়ার হাতে বন্দি হবার আগেই ক্ষুব্ধ গোখরা তার হাতে বিষদাঁত ফুটিয়ে দিয়েছিল। তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল, ডাল বেয়ে সামান্য নীচে নামবার পরই শক্তিহীন শরীর গড়গড়িয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। আশপাশ থেকে মানুষ ছুটে এসে নুয়াবালিকে ডাঙ্গায় তুললো, কিন্তু ততক্ষণে তার নাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে।
কত ওঝা, কত ফকির এলো, তারা টানা সাতদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুনিয়ার সব মন্ত্র পাঠ করে নুয়াবালির মরা প্রাণ তাজা করবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সে আর জাগলো না।
সেদিন কুটিমিয়াও কম ভয় পায় নি। নুয়াবালি নীচে পড়ে যাওয়ার পর সে বুক-হেঁচড়ে গাছ থেকে নেমেছিল। তার ভয় ছিল একটাই, গোখরাটা বুঝি তাকেও দংশন করার জন্য ডাল বেয়ে তেড়ে আসছে।
নুয়াবালির মৃত্যুর পর কুটিমিয়ার সাপুড়ে হবার সাধ মিইয়ে গিয়েছিল।



সাপের খেলা দেখা কুটিমিয়ার প্রিয় একটি শখ ছিল। মেঘুলা কিংবা জয়পাড়া বাজারে গিয়ে সে টুইটুই করে ঘুরতো—কখন সাপুড়েরা এসে ডালি নামাবে, ডালি খুলতেই ভিতর থেকে একটা আজদাহা সাপ মাথা উঁচু করে সগর্জনে ফণা তুলবে, সাপুড়ে মুঠি পাকানো হাত নাচাতে নাচাতে ওটা ধরতে যাবে, সাপটা সাপুড়ের হাতে ঠোকর দিতে উদ্যত হবে, দংশনোদ্যত সেই সাপের মুখে কোনো পাহাড়ি গাছের এক টুকরো ছাল ধরবে সাপুড়ে, অমিন ওটা মাথা নীচু করে ডালির ভিতরে লুকোবার চেষ্টা করবে।

একবার এক ক্যানভাসের আসরে জনৈক জটাধারী সাধক গান গেয়ে আসর জমিয়ে তুললেন। মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকলো এবং সবাই তন্ময় হয়ে গান শুনতে লাগলো। গানের আসর জমে গেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য কোণে ভদ্র ও শিক্ষিত গোছের পাঞ্জাবি পরা এক লোক ডুগডুগি বাজিয়ে গলায় সুর তুলে গেয়ে উঠলেন, ‘ও...রে লখাই রে...’।
সাধকের গান ছিল মানুষ জড়ো করার জন্য। মানুষ জড়ো হওয়া মাত্রই এই সাপুড়ের আবির্ভাব। সচরাচর সাপুড়েরা এরূপ ভদ্রসদৃশ হয় না।
সাপুড়ে দারুণ এক ঘোষণা দিয়ে বললেন, তিনি আজ এক আশ্চর্য কেরামতি দেখাবেন যদ্বারা সৎ এবং অসৎ লোককে আলাদা করা যায়। তাঁর ঘোষণার সাথে সাথে উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠলো, প্রত্যেকেই এই সুযোগে নিজের সততার বিষয়টি পরীক্ষা করে নিবে। দু একজন অবশ্য এতো লোকের সামনে অসৎ বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় আসর ছেড়ে চুপি চুপি পালিয়ে গেলো। তবে বেশির ভাগ মানুষই সাপুড়ের সেই কেরামতি দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে রইলো।
সাপুড়ে তাঁর পকেট থেকে ছোটো একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। তারপর ডান হাতের দু আঙ্গুলে প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে বললেন, ‘এইটার ভিতরে কী আছে বলেন দেখি?’
‘দশটা সিগারেট আছে।’ সবাই সমস্বরে জবাব দেয়।
ভদ্রলোক মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেন, ‘হইল না। হইল না।’
‘তাইলে কী আছে?’ মানুষ জানতে চায়।
‘এইটার ভিতরে আছে... ,’ সাপুড়ে একটু রহস্য করতে থাকেন, ‘এইটার ভিতরে আছে একটা সাপ।’
‘অসম্ভব’, মানুষ আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘এত্ত ছোটো প্যাকেটের মধ্যে সাপ থাকবো ক্যামনে?’
‘কিন্তু এইটা ভাই যেনতেন সাপ না, এইটা হইল সত্য যুগের সাপ। এই সত্য যুগের সাপই আইজ খুঁইজ্যা বাইর করবো কে সৎ আর কে অসৎ লোক।’
উপস্থিত মানুষজন আরো আশ্চর্য হতে থাকে।
ভদ্রলোক তাঁর সুরেলা গলায় লখিন্দরের গান গাইতে গাইতে চমৎকার ভঙ্গিতে প্যাকেটের মুখ খুলতে থাকেন—মুখ খোলা মাত্র ভিতর থেকে একটা সরু সাপের মাথা বের হয়ে আসে। সাপটি তার লিকলিকে জিহ্বা বের করে চারদিকের মানুষজনের দিকে পুটপুট করে তাকায়।
ভদ্রলোক কী একটা মন্ত্র পড়ে সাপের দিকে ফুঁ ছোঁড়েন, সাপটি সিগারেটের প্যাকেট থেকে তরতর করে বেরিয়ে এসে পাঞ্জাবির হাতা বেয়ে কাঁধ বরাবর উঠে আসে; তারপর গলার দু পাশে ঝুলে পড়ে এক পাশে লেজ নাড়ে, আরেক পাশে ফণা তুলে জিহ্বা বের করে নাচায়। মানুষের আশ্চর্যের শেষ নেই, এতোটুকুন একটা প্যাকেটের ভিতরে একটা আস্ত সাপ থাকতে পারে!
সাপুড়ে এবার বয়ান ছাড়তে লাগলেন, ‘আমার এই সাপ সৎ লোকের টাকা নেয়, অসৎ লোকের টাকায় থুথু ছুঁইড়া মারে। আপনারা সবাই যার যার হাতের ওপর টাকা মেইল্যা ধরেন। সৎ লোকের টাকার ওপর এই সাপ চুমা খাইবো, অসৎ লোকের টাকার দিকে ফিরাও তাকাইবো না।’
মানুষের মধ্যে চমক দেখার টানটান উত্তেজনা। অনেকে ঝকঝকে নতুন টাকা মেলে ধরলো, আর সাপুড়ে তা লক্ষ করেই বললেন, ‘অসৎ লোকের টাকা নতুন ক্যান, সোনা দিয়া বান্ধানো থাকলেও আমার সত্য যুগের সাপ তার দিকে ফিরা চাইবো না।’ আশ্চর্য, তাই ঘটতে লাগলো। মেলে ধরা টাকার কাছে সাপটিকে নেয়া মাত্র সাপটি আলগোছে নুয়ে পড়ে টাকায় চিবুক ছোঁয়ায়, জিহ্বা বের করে স্পর্শ করে। অথচ কোনো কোনো ঝকঝকে নোটের দিকে ফিরেও তাকালো না। সাপুড়ে চুমু-খাওয়া টাকাগুলো তুলে নিজের পকেটে পুরতে থাকলেন।
সেদিন নিজের সততা পরীক্ষা করে দেখার অনেক সাধ হয়েছিল কুটিমিয়ার, কিন্তু নোট কেন, সেদিন তার জিপে একটা কানা কড়িও ছিল না। সে মন খারাপ করে ভ্যাগাভ্যাগা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
সেই আসরে আরেক সাপুড়ের আরো কিছু অত্যাশ্চর্য কেরামতি সে দেখেছিল। পাঞ্জাবি পরা সাপুড়ের পর্ব শেষ হতে না হতেই লম্বা গোঁফওয়ালা বিশাল-বপু এক সাপুড়ে সাপের ঝাঁপি নিয়ে এক কোনা থেকে হাঁক দিয়ে প্রবেশ করলো, তারপর নেচে নেচে বীণা বাজিয়ে চারদিকে ঘুরতে থাকলো। সাপুড়ে বীণা বাজাতে বাজাতে ঝাঁপির কাছে গেলো, আস্তে ঢাকনার একটুখানি খুলতেই ভিতর থেকে ফুঁসস্ শব্দ হলো। সে আবার বীণা বাজাতে শুরু করলে একটি সাপ ফুঁসফুঁস করতে করতে মাথা উঁচু করে ফণা তুলে দাঁড়ায়। সাপুড়ে তার ডান হাতের আঙ্গুলে বিড়া পাকিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে সামনে বাড়ায়, সাপটি ফুঁস করে ছোবল মারতে উদ্যত হয়, অমনি সে দ্রুত হাত ফিরিয়ে এনে আবার বীণা বাজাতে থাকে।

বিশাল লম্বা সাপটিকে ঝাঁপি থেকে বের করা হলে তা দেখে কিশোর কুটিমিয়ার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল— এতো বড় সাপ হয়! সেই সাপ ভীষণ উঁচু ফণা তুলে তুমুল গর্জনে চারদিক আতংকিত করে তুললো। কিছুক্ষণ কোমর দুলিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে, হাত দুলিয়ে বীণা বাজিয়ে সাপের সাথে খেলা করলো সাপুড়ে, তারপর বাজনা থামিয়ে এক পাশে বীণাটি নামিয়ে রাখলো। এবার ডান হাতের মুঠিতে বিড়া পাকিয়ে সাপকে ছোবল দিতে উদ্যত হয় সাপুড়ে; সাপও পালটা ছোবল মারতে এগিয়ে আসে; এভাবে কয়েকবার খেলা দেখানোর পর সে কোঁচড় থেকে চিকন এক টুকরো কাঠি বের করে আনে; কাঠিটি সাপের মুখের কাছে ধরতেই ওটা মাথা নত করে সুড়সুড় করে মাটি শুঁকতে শুরু করে, ঐ সুযোগে সাপুড়ে সাপটিকে ধরে ফেলে।
দু হাতে লম্বালম্বি করে সাপটিকে উঁচুতে তুলে নিজের গলায় পেঁচিয়ে নিল সাপুড়ে। তারপর হাঁক দিল, ‘ভাইসব, আমার একজন সাহসী মানুষের দরকার। আছেন কোনো সাহসী, ভাইজান? কে আছেন, সামনে আসেন?’
কোনো সাহসী মানুষ বের হয়ে এলো না। কুটিমিয়া ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠছিল—সে সাহসী কিনা তা সে জানে না, তবে এতো মানুষের সামনে সাপুড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে তার বুক সামান্য হলেও কেঁপে উঠবে তা সে জানে। সামনে এগিয়ে গেলে তাকে দিয়ে কোন্‌ সাহসী কাজটা করানো হবে তা সে আন্দাজ করতে পারছে বইকি। সাপুড়ে তার কাঁধে হাত রেখে বেশ কিছুক্ষণ তার সাহসের তারিফ করবে— এই একরত্তি ছেলের যা সাহস, হাটভর্তি মানুষের মধ্যে আর কারোরই তা নেই। এভাবে তারিফ করতে করতে সাপুড়ে তার নিজের গলা থেকে সাপটিকে খসিয়ে কুটিমিয়ার গলায় পেঁচিয়ে দিবে, তার দুর্দান্ত সাহস দেখে দর্শকগণ সজোরে হাততালি দিয়ে উঠবে।
সাপুড়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে অনবরত হাঁক দিয়ে যাচ্ছে, ‘ভাইসব, আপনারা সবাই কি ভেড়া? আপনাদের কারোর বুকে কি পাটা নাই? সবাই কি ভেড়া? সবাই কি ভেড়া?’
হ্যাঁ, একজন বাদে বাকি সবাই ভেড়া। শংকিত পায়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে সংকুচিত ভাবে সাপুড়ের সামনে দাঁড়ায় কুটিমিয়া। সাপুড়ের চোখেমুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। কুটিমিয়ার সাহসের তারিফ করতে করতে সাপুড়ের মুখে খই ফুটতে থাকলো।
কুটিমিয়া যা আন্দাজ করেছিল তাই হলো। সাপুড়ে তার গলা থেকে সাপটিকে ছাড়িয়ে কুটিমিয়ার গলায় কয়েক প্যাঁচ ঘুরিয়ে ঝুলিয়ে দিল। ঝুলন্ত সাপটা একবার কুটিমিয়ার চোখ বরাবর এসে জিহ্বা বের করতেই তার বুক দুরুদুরু করে উঠলো, এই বুঝি তাকে ছোবল মারে। এভাবে কিছুক্ষণ যেতেই কুটিমিয়া বুঝতে পারে তার বুকে এখন একতিল ভয় নেই।
সাহস পরীক্ষার জন্য এতোটকুই যথেষ্ট হতে পারতো। কিন্তু তাকে এর থেকেও ভয়ংকর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হলো।
কুটিমিয়াকে অর্ধ্বেকখানি জিহ্বা বের করে দু-পাটি দাঁতের মাঝখানে শক্ত করে কামড়ে থাকতে বললো। কোনোমতেই সেই দাঁত ফাঁক করা যাবে না। মরে গেলেও না।
কুটিমিয়া কথামতো জিহ্বা বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে থাকলো। তখনো সে জানে না কী ঘটতে যাচ্ছে।
সাপে কাটা মানুষের বিষ তুলতে এই সাপুড়ের তুলনা নেই, তা প্রমাণের জন্য একজন সাহসী মানুষের প্রয়োজন ছিল।
একটা অসীম সাহসী কিশোর নিজের জিহ্বায় সজোরে কামড় বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কম্পমান জিহ্বার মাথা বেয়ে লালা ঝরছে, আর তার গলায় ঝুলছে একটা তরতাজা বিষধর সাপ।
সাপুড়ে কুটিমিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, দু হাত দিয়ে সাপের মুখ ফাঁক করে ধরে দু পাশের দুটি কালো ও চিকন বিষদাঁত মানুষকে দেখায়। এরপর বিষদাঁতের আগা মটমট করে কুটিমিয়ার জিহ্বার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এ দৃশ্যে মানুষের মধ্যে ভয়ার্ত গুঞ্জরন ভেসে উঠলো।
সাপের মাথা ছেড়ে কুটিমিয়ার কাঁধে হাত রাখে সাপুড়ে। সে চিৎকার করে মানুষের উদ্দেশে বলতে থাকে, ‘আপনারা লক্ষ কইর‌্যা দেখেন, কালসাপের বিষে জিব্বাডা কেমন কালো হইয়া যাইতেছে। কালো কুঁচকুঁচে হইয়া যাইতেছে।’ কুটিমিয়ার উদ্দেশে সে বলতে লাগলো, ‘সাবধান, একটুও দাঁত ফাঁকা করবা না। একটুও ফাঁকা করবা না, করলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাইবা।’ ঠিক সেই মুহূর্তে ভয়ে কুটিমিয়ার বুক ভীষণ কেঁপে উঠলো। এতোক্ষণ যতো জোরে কামড় দিয়ে ছিল, এবার তার চেয়েও অধিক জোরে জিহ্বায় কামড় দিয়ে আটকে ধরলো। তার মনে হচ্ছে জিহ্বাটা বুঝি কেটে দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর ঘেমে অস্থির, তার চোখের কোণ ভিজে উঠছে। হায়, যদি একটু ভুলের জন্য তার দাঁতগুলো সামান্য ফাঁক হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। সে এই পৃথিবীর আলোবাতাস আর কিছুই দেখতে পাবে না। বাড়িতে মা-বাবা, ভাইবোন, কেউ জানতে পারবে না তাদের আদরের কুটিমিয়া সাপের খেলা দেখতে এসে সাপে কাটায় মারা গেছে।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কুটিমিয়া টের পায় নি। সে যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্নমগ্ন ছিল। স্বপ্নছায়ার মতো সে দেখেছে সাপুড়ে একবার সাপের মুখটাকে তার জিহ্বার কাছে এনে ধরে রেখেছিল। দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের মতো সে সাপুড়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে—‘দেখেন, ক্যামনে বিষ শুইষ্যা নিয়া যাইতেছে, দেখেন আপনারা, দেখেন।’
কুটিমিয়ার যখন পূর্ণজ্ঞান হলো, তখন দেখতে পেলো সে সাপুড়ের শরীরে ভর করে হাঁটছে, আর সাপুড়ে তাকে নিয়ে চারদিকে ঘুরে ঘুরে মানুষকে তার জিহ্বা দেখাচ্ছে- সাপের কামড়ে জিহ্বার একটি জায়গা লাল হয়ে গেছে, বিষ চুষে নেবার পর সেখানে একফোঁটা রক্ত জমাট বেঁধে ফুটে আছে।
‘এইবার দাঁত ফাঁকা কইর‌্যা জিব্বা নাড়াচাড়া করো।’ সাপুড়ের কথায় যখন সে দাঁত খুললো, দেখলো জিহ্বার মাথাটা বেশ ভারী হয়ে আছে।

সেদিন সাপুড়ে অনেক অনেক পাহাড়ি লতা বিক্রি করেছিল, যেগুলো ফণাধর সাপের সামনে তুলে ধরলে মুহূর্তে স্তিমিত হয়ে পলায়নপর হয়, যার একটি টুকরো বেড়ায় গুঁজে রাখলে কোনো বিষধর সাপ ঘরের ত্রিসীমানায় ভিড়তে সাহস পায় না, তাবিজ করে গলায় পরলে, কিংবা বাহুতে বা কোমরে বেঁধে রাখলে তাকে কোনোদিন কালসাপে দংশন করে না।
কুটিমিয়ার কাছে কোনো পয়সা ছিল না, তবে তার সাহসের পুরস্কার স্বরূপ কিংবা তার প্রতি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে সাপুড়ে তাকে বিনামূল্যে এক টুকরো পাহাড়ি লতা দিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে সাহস প্রদর্শনের এ ঘটনা কাউকে বলে নি কুটিমিয়া। কারণ, এ কাজটি খুব ভয়ানক ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পুরো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এ কথা ফাঁস হলে বাড়ি ভরে হায় হায় রব উঠবে, তার প্রতি কড়াকড়ি বেড়ে যাবে।
সাপুড়ের দেয়া পাহাড়ি লতাটি কুটিমিয়া নিজের শরীরে না বেঁধে ঘরের এককোণে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল।
এক টুকরো পাহাড়ি লতার আশ্চর্য শক্তি দেখে কুটিমিয়া যারপরনাই মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু সাপুড়েরা এর চেয়েও বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী, যা সে চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিল।



হাইস্কুলে যাওয়ার পথে ধাপারি খালের পাড়ে ঘুষদের বিরাট এক বাগ; সেই বাগে কুটিমিয়া একবার সাপুড়েদের সাপ ধরা দেখেছিল। সে এক মজার দৃশ্য, এবং অতি আশ্চর্যও বটে।
এক দীর্ঘ বেদেবহর বাগের কাছ ঘেঁষে খালের পাড়ে নোঙর গেড়েছিল। স্কুলে যাতায়াতের পথে বন্ধুদের সাথে বেদেবহরের পাশে কয়েক দণ্ড দাঁড়াতো কুটিমিয়া। বেদেদের বিচিত্র রকম পোশাকআশাক, ছোটো এক নৌকোয় একসঙ্গে অনেকের বসবাস, সারাক্ষণ কিচিরমিচির, চেঁচামেচি, ইত্যাদি দেখে সে খুব মজা পেতো।
একদিন স্কুল ছুটির পর বাগের কাছাকাছি আসতেই কুটিমিয়া মানুষের শোরগোল শুনতে পেলো। দ্রুত পায়ে বাগের কাছে এসে দেখে রাস্তার ওপর প্রচুর মানুষের ভিড়। সবাই চিৎকার করে বলছে—ঐ যে ডাইন দিকে— ঐ যে নীচে নাইম্যা গেলো— ঐ যে আরেক গাছে উড়াল দিল— ঐ যে গেলো— গেলো—
কুটিমিয়া ভিড় ঠেলে দাঁড়ায়। দেখে, কয়েকজন বেদে ও বেদেনি লম্বা লাঠি হাতে বনের ভিতর দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে তেড়ে ছুটে চলছে।
‘কী হইছে ভাই?’ কুটিমিয়া একজনকে জিজ্ঞাসা করে।
‘দেখো না গাছের মাথায় সাপ দৌড়াইতেছে?’ কেউ একজন জবাব দেয়।
কুটিমিয়া লক্ষ করে দেখে গাছের শাখায় লতাপাতার ওপর দিয়ে বিরাট লম্বা এক সাপ তরতর করে ছুটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সাপটা ভয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। দেখতে দেখতে ওটা মাটির কাছাকাছি একটা নীচু ডালে নেমে এলো। এক বেদেনি কাড়াইলের মাথা দিয়ে সাপটিকে জোরসে টান মারলো। সাপটা সামান্য নীচে নেমে এলেও পুরোটা এলো না। লতাপাতা বেয়ে আবার ওপরে উঠে দ্রুত অন্য একটি গাছের মাথায় চলে গেলো সাপটা। এ গাছটার পরে আর কোনো গাছ ছিল না, এই সুযোগে দুজন সাপুড়ে দুদিক থেকে দু ডাল বেয়ে ওপরে উঠে সাপটিকে ঘিরে ফেললো। লাঠিতে কয়েক খোঁচার পরই সাপটি গড়গড়িয়ে নীচে মাটিতে পড়ে গেলো। ততক্ষণে বাকি বেদে-বেদেনিরা সাপটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তাদের কারো হাতে লাঠি, কেউ বা খালি হাতে।
ঠিক এমন সময়ে একটা ছোটো ছেলে, যার পরনে একরত্তি কাপড়ও নেই, সবার ফাঁক গলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, অভিমানী স্বরে সে বলে, ‘মা, এইড্যা আমি দরুম।’
মা ছেলেটিকে সামনে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘যা না, দর। ছুইড্যা যায় না জানি।’
ন্যাংটো শ্রীযুত অকম্পিত পায়ে সামনে এগিয়ে যায়, তারপর অতি অভিজ্ঞ সাপুড়ের মতো খুব স্বাভাবিকভাবে সাপটিকে ধরে মালার মতো নিজের গলায় ঝুলিয়ে নেয়। তার ছোটো শরীর নাদুস নুদুস সাপটির ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেলো— একবারের জন্যও সাপটি ফণা তুললো না, যেন অনেক দিনের গৃহপালিত কোনো পশু মনিবের করস্পর্শে স্নেহবিগলিত হয়ে পড়লো।

এ দৃশ্য দেখে কুটিমিয়া খুবই অবাক হয়েছিল। বেদেদের কাছে কী এমন পাহাড়ি লতা বা মহৌষধ আছে, যার কারণে সাপেরা এতোখানি বশীভূত হতে বাধ্য হয়? এর প্রভাবে কি সাপেরা নিষ্ক্রিয় বা বিষহীন হয়ে পড়ে? সাপটা যেন সত্যিকারের সাপ নয়, একটা খেলনা; একটা খেলনা নিজ হাতে ধরে দেখার কী আবদার ছুঁড়ে দিল মাত্র তিন কী চার বছরের উলঙ্গ কিশোর, যেন অহরহই এমন হয়ে আসছে, বহুদিন ধরে সে এ কাজে পারঙ্গম। কুটিমিয়া ভাবে, তাদের ঘরের কোণে যে পাহাড়ি লতাটা সে পুঁতে রেখেছে তার কি এমন আশ্চর্য বশীকরণ ক্ষমতা আছে?

অল্প কয়েকদিনের মাথায়ই সে এর প্রমাণ পেলো। একদিন সকাল বেলা মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতেই ভয়ে কুটিমিয়ার আত্মা উড়ে গেলো। ঘরের এককোণে, যেখানে সে সাপুড়ের দেয়া সর্প-দূরীকরণ পাহাড়ি লতাটি পুঁতে রেখেছে, তার কাছাকাছি একটা কালো সাপ বিড়া পাকিয়ে ফণা তুলে বসে আছে, এর ঠিক সামনে তার এগার মাসের ছোটো বোন হাত বাড়িয়ে বার বার সাপের মাথায় থাপড় দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। সাপটিও যেন মজা করে এই খুকুর সাথে খেলা করছে।
কুটিমিয়ার তখন গলা শুকিয়ে গেছে। সে শুকনো গলায় বোনকে ডাকলো, ‘নু-তু, নুতুমণি...’
নুতু ফিরে তাকায়, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে কুটিমিয়ার কাছে এসে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মানুষ জড়ো করে সাপটি মারা হলো। কিন্তু কুটিমিয়ার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকলো। যে-ঘরে সর্প-দূরীকরণ পাহাড়ি লতা পোঁতা আছে সে-ঘরে সাপ ঢোকে কী করে? এ-ও সে ভাবে, সাপ ঢুকলেও আসলে সাপের দংশন-ক্ষমতা লোপ পায়, তা না হলে কি নুতুকে দংশন করতো না?

কিন্তু তার এই বিশ্বাসও বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। একদিন রাতের বেলা ঘরের ভিতরে খোয়ারের মুরগিগুলো হঠাৎ কক কক করে দাপাদাপি শুরু করলো। একটা মোরগ খোয়ার থেকে বেরিয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করতে থাকলো। মাঝে মাঝেই শেয়াল এসে বেড়া ফাঁক করে খোয়ারে হানা দেয়। সেদিনও দিয়ে থাকবে মনে করে বাতি জ্বেলে ঘরের বাইরে আসা হলো, কিন্তু শিয়ালের বেড়া ভাঙ্গার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেলো না। ছুটন্ত মোরগটাকে ধরে খোয়ারের ভিতরে ঢোকাতে গিয়েই কুটিমিয়ার মায়ের মনে পড়লো, সেদিন খোয়ারের মুখে খিল দিতে মনে ছিল না। ভালো করে খিল আটকে সবাই শুয়ে পড়লো। তবু কিছুক্ষণ পরপর খোয়ারের ভিতরে দাপাদাপি চলতে থাকলো।
সকালবেলা উঠে খোয়ারের মুখ খুলতেই সবকটা মোরগ-মুরগি সশব্দে একসাথে ছুটে বেরিয়ে এলো, কিন্তু ভিতরে মরা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেলো সেই মোরগটি, যেটি রাতের বেলা খোয়ার থেকে বেরিয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করছিল। মরা মরোগটি তুলতে গিয়েই কুটিমিয়ার মা চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘ও লো মা লো... সা...প... সা....প...।’
ভিতরের ডিমগুলো সব সাবাড় করেছে, আর মস্ত মোরগটাকেও দংশন করেছে এই বজ্জাত সাপটি। কুটিমিয়া নিজেই একটা শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেই সাপটিকে মেরেছিল ।
সাপ-রহস্যের কূলকিনারা পাবার আগেই সে আরেক রহস্য-সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিল।

২০০৬
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১০:৩৯
৩১টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×