somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শামা

১৯ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শামার সাথে আমি একই কলেজে পড়তাম। এইচএসসি পাশের পর শামা ঢাকা শহরের একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভাইয়ের বাসায় থাকতে লাগলো, আর আমি ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে গ্রামের কলেজেই রয়ে গেলাম।
শামার গায়ের রঙ জারুল কিংবা মহিমার মতো ফরসা না হলেও ওর চেহারা মিষ্টি ও আকর্ষণীয় ছিল। অন্যদের চাইতে আলাদা এবং স্মার্ট ছিল শামা।
কলেজ লাইফে আমার সাথে শামার আচরণ ছিল স্রেফ ক্লাসমেট বা বন্ধুর মতোই। তবে, আমার দিক থেকে এর চাইতে একটু বেশিই ছিল। ওকে আমার ভালো লাগতো। মাঝে মাঝে ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কয়েকজন ক্লাসমেট ওদের বাসায় যেতাম। ওদের বাড়িতে আমগাছ আর নারকেল গাছ ছিল। শামা আমাকে বলতো গাছ থেকে ডাব পেড়ে দিতে, আমি বাকিদের চেয়ে লম্বা এবং বলিষ্ঠ ছিলাম বলে। আমি ডাব পাড়তাম। অন্য কেউ ডাবের মুখ কেটে দিলে শামা সবার হাতে সেগুলো পৌঁছে দিত; আমার হাতে ডাবটি তুলে দেয়ার সময় ও একটুখানি হাসতো, যেমন করে সবার চোখের দিকে তাকিয়েই হাসতো। আমি মনে মনে চাইতাম, শামা আমার দিকে একটু অন্যভাবে হাসুক, আমার সাথে কথা বলার সময় ওর ভুরুটা একটা সরু হোক, কিংবা চোখদুটো একটু নেচে উঠুক। এসব কখনো হতো না। তবে, ডাব তুলে দেয়ার সময় ওর হাতের আঙুলে আলতো করে একটা ছোঁয়া লাগলে আমি গোপনে, সবার অলক্ষে মৃদু শিহরিত হতাম। এভাবে প্রতিদিনই আমার শিহরিত হতে সাধ হতো।
আমের দিনে আমাকেই গাছ হতে আম পাড়তে বলতো শামা। শামা কাঁচা আম পাটায় ছেঁচে সামান্য চিনি ও ধনেপাতা দিয়ে মাখাতো। খুব ভালো লাগতো। আমরা মজা করে গল্প করতাম আর কাঁচা আমবাঁটা খেতাম। শামা চেয়ারের হাতলে বসে পা দোলাতো, খাটিয়ার কোনায় বসে পায়ের উপর পা তুলে নাচাতো। থুতনিতে আঙুলের ডগা রেখে কথা বলার সময় ও সবচাইতে বেশি আকর্ষণীয়া হয়ে উঠতো। ওর এসব দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। মেয়েদের হাঁটার ভঙ্গি, ঘাড় দোলানো, চুল ওড়ানো, হাত নেড়ে কথা বলা- সবকিছুতেই মাধুর্য মাখানো। এগুলো হলো মেয়েদের কলা বা শিল্প, যাকে আর্ট বলা হয়। এগুলো কোনো মেয়েকে অর্জন করতে হয় না, এগুলো তাদের জন্মজাত প্রাপ্তি। মেয়েদের সব কলাই ছেলেদের ভালো লাগে। যুবকেরা মেয়েদের এসব দেখেই আকৃষ্ট হয় এবং প্রেমে পড়ে। শামা একটা কলাবতী মেয়ে, যার প্রতিটি কলায়ই শিল্পের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ বিদ্যমান।

শামা খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতো। কলেজের ফাংশনে ওর আবৃত্তি শুনে সবাই মুগ্ধ হতো। ওদের বাসায় গেলে ও আবৃত্তি করতো আর অভিনয় করতো সেই সাথে। মাঝে মাঝে ঘাড় কাত করে, কখনো আঙুলে মুদ্রা তুলে সে শব্দগুলো উচ্চারণ করতো; অঙ্গ দুলিয়ে আবৃত্তি করার সময় ওর অঙ্গগুলোতে যেন শব্দগুলো জীবন্ত হয়ে কথা বলে উঠতো।

কলেজে চলে যাওয়ার পর এসব স্মৃতি আমার মনে পড়তো এবং খারাপ লাগতো। আমার খারাপ লাগার আরো কারণ ছিল। গ্রামে থাকা কালে শামার সাথে আলাদা করে ‘বিশেষ কিছু’ নিয়ে কোনো কথা হয় নি কোনোদিন। শহরে যাওয়ার পর সেই শামার সাথে আর কীইবা কথা হতে পারে? কোনোদিন মোবাইলে হয়ত ‘কেমন আছিস? ভালো আছিস?’– বড়োজোর এমন কিছু সৌজন্য বিনিময় চলতে পারে।

যদিও এত এত ক্লাসমেটের মধ্যে আমরা গুটিকতক ক্লাসমেট শামার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, কিন্তু এটা ঠিক, আমার প্রতি ওর একটা আলাদা ‘বিশেষ’ দৃষ্টি থাকবে, আমার প্রত্যাশা কখনো এত উঁচুতে ওঠে নি। ওর চোখে ‘আলাদা’ হয়ে ওঠার মতো তেমন কোনো এক্সট্রা-অর্ডিনারি কোয়ালিটিও ছিল না আমার। সব বন্ধুবান্ধব মিলে ওর সাথে যেটুকু সময় কাটিয়েছি, কারো প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত আমাদের সবার উপর ওর দৃষ্টি সমান মনে হতো।

কিন্তু শামার সাথে যে সময়টুকু কাটিয়েছি, ও দূরে যাবার পর সেই স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝেই মোচড় দিয়ে উঠতে থাকলো। দল বেঁধে ওর বাসায় ছুটে যেয়ে আড্ডা দিব, শামা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলবে, এগুলো দেখতে মন আনচান করতে লাগলো।

মাস তিনেক পর শামার ফোন পেলাম একদিন। খুব উচ্ছল কণ্ঠ শামার। ‘হ্যাঁ, কী রে? ভুলে গেছিস? একদিনও একটা ফোন দিলি না যে?’ ওহ শামা! ওহ শামা! আমার বুকটা বার বার ‘ওহ শামা’ বলে চিৎকার করে উঠলো- তাহলে তুইও আমার কথা ভাবিস? আমার প্রতি তোরও এতটা অভিমান- আমি তোকে ভুলে গেছি! শামা যদ্দিন গ্রামে ছিল, কালেভদ্রে দু-একটা প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া আমাকে কখনো কল করে নি মোবাইলে। আমার মুখচোরা স্বভাব ছাড়াও সহজাত সঙ্কোচের কারণে আমি নিজেও কোনোদিন শামাকে কল করি নি। তাই আমার ঘূণাক্ষরেও এমনটা কখনো মনে হয় নি, আমার ফোনের জন্য শামার কিছুটা ‘অপেক্ষা’ বা ‘আক্ষেপ’ থাকতে পারে।
আমি নিজেকে সংযত করে বলি, ‘তুইও তো একদিনও খবর নিলি না।’
‘আড়ি করিস না। সময় পাইলেই কল দিবি, বুঝছিস?’
শামা অনেক উৎফুল্লভাবে কথা বললো। ঢাকা শহর ওর ভালো লাগছে খুব। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস আরো বেশি ভালো লাগছে। অল্পদিনেই অনেক বন্ধু হয়েছে। এ জায়গাটাতে একটু কষ্ট পাই। আমি যাকে প্রেমিকা হিসাবে চাই, তার আর কোনো বন্ধু থাকতে পারবে না। এটা যে-কোনো প্রেমিকের জন্যই খুব কষ্টকর। আমার প্রতি প্রেমিকার ভালোবাসা জনে জনে ভাগ হয়ে যাক, পৃথিবীতে এতটা উদার কোনো প্রেমিক নেই। কিন্তু নিজেকে ধিক্কার দিতেও কসুর করি না। শামাকে আমি প্রেমিকা ভাবছি কেন? আমি যে তার ক্লাসমেটের চাইতেও অধিক কিছু- শামার পক্ষ থেকে আজও এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি। একপক্ষীয় ভালোবাসায় প্রেমিকের হৃদয় রক্তক্ষরণ ছাড়া আর কিছু পায় না। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকি।




এরপর আমি প্রতিদিনই শামার ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম। কখনো নিজ থেকেও ফোন করতে চেয়েছি, কিন্তু করি নি। ও বললো আর অমনি ফোন করে বসবো! কথাটা ও কতখানি মন থেকে বলেছে তা আমি বুঝতে চেয়েছি। নিজ থেকে একটা ফোন করে চটুল হতে চাই নি আমি। হয়ত এটা আমার আদেখলেপনাও ভাবতে পারে শামা। আমি চেয়েছি, আমার প্রতি সত্যিকারেই শামার কোনো টান আছে কিনা সেটা দেখতে। যার সাথে অন্তরঙ্গতা থাকে, সে সময়ে-অসময়ে কল করতে পারে। শামা এতদিনে একদিন মাত্র কল করলো- এতেই বোঝা যায় আমার প্রতি ওর কত ক্ষীণ অনুভূতি কাজ করে।

শামা আর একদিনও ফোন করলো না, কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সে গ্রামে এলো বেড়াতে। বাসায় এসে প্রথম ফোনটা সে আমাকেই দিয়েছে বলে জানালো। এ জিনিসটা আমার আত্মবিশ্বাস ঢের বাড়িয়ে দিল। ‘তোরা কাল সকালে বাসায় আয়, কথা আছে।’ শামা বললো। আবার আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত হই। আত্মবিশ্বাস নামতে থাকে। শামা শুধু আমাকে একাই ওদের বাসায় যেতে বলতে পারতো। ওর সাথে একা বসে নিরিবিলি কথা বলতে অনেক অনেক ভালো লাগতো আমার। আমি জিজ্ঞাসা করতাম, ‘শামা, তুই কি ভালো ছিলি আমাদের ছেড়ে? আমাদের ছেড়ে শহরে থাকতে কষ্ট হয় নি তোর?’ তারপর একসময় ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’তে নেমে এসে বলে বসতাম, ‘বল শামা, তোর বুকে হাত রেখে বল, আমার জন্য তোর কি একটুও মন কাঁদে নি?’ নাহ্, এভাবে কোনোদিন বলার মতো সুযোগ হবে না আমার। একান্ত সামনাসামনিও যদি দিনভর বসে থাকি, আমি বড়োজোর বলতে পারবো, ‘একটা কবিতা বল তো!’ কিংবা বলতাম, ‘তুই নাচ শিখলি না কেন রে? তুই নাচলে খুব ভালো লাগতো’।

শামাকে দেখে চমকে গেলাম আমরা সবাই। ও আগের চাইতে সুন্দর হয়েছে অনেক। ভারি মিষ্টি লাগছে ওকে। হাসতে হাসতে কথা বলতে শুরু করলো শামা, ওর কথার তুবড়িও আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। এবং অল্পক্ষণেই শামা আমাদেরকে একটা চমকপ্রদ খবর দিল। বললো, ও একটা নাটকে অভিনয় করার অফার পেয়েছে। নায়িকা হবে সে এবং একজন নামকরা নায়কের বিপরীতে নামকরা পরিচালকের নির্দেশনায়। শীঘ্রই শুটিং হবে।
শামা খুব উচ্ছ্বসিত। অন্যান্য ক্লাসমেটরা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু আমি চুপসে গেলাম। আমার জীবন থেকে শামা চিরতরে হারিয়ে গেল তাহলে! ওর সাথে আমার আর ‘কোনোকিছু’ হবার সম্ভাবনা একেবারেই থাকলো না, বুঝতে পারলাম। আমার আরো বেশি খারাপ লাগতে লাগলো এই ভেবে যে, শামাকে এখন আর আগের মতো পাওয়া যাবে না। নাটকের নায়িকা হলে সে হয়ে যাবে সেলিব্রেটি। ওর চারদিকে তখন এত ভিড় থাকবে যে, তা ভেদ করে ভেতরে ঢোকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি ভাবলাম, আগে তো যাই হোক, টুকিটাকি কথা হতো, এখন হয়ত শামা আমাকে ফোন করার সময়ই পাবে না। কিংবা, পেলেও ও হয়ত নিজের দাম বজায় রাখতে আমার মতো ‘নিঃস্ব’ কারো কাছে ফোন করে সময় নষ্ট করবে না।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল হলো। শামা শহরে চলে যাওয়ার পরের দিনই আমাকে কল দিল। খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে শামা। কবে শ্যুটিং হবে, লোকেশন কোথায়, কী কী ড্রেস পরতে হবে, শামা এসব নিয়ে আমার সাথে আলাপ করলো। আলাপ করতে করতেই জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোর খুব ভালো লাগছে না?’
আমি একটু চুপ থাকি। ওর মন বোঝার চেষ্টা করি। ও আবার বলে, ‘বল না, ভালো লাগছে না তোর? আমার খুব ভালো লাগছে।’ আমি সৌজন্য রক্ষা করে বলি, ‘হ্যাঁ, তুই নায়িকা হবি, আমার ভালো লাগবে না তো কার ভালো লাগবে?’ তবে, ‘তোর খুব ভালো লাগছে না’ কথাটা খুব ব্যক্তিগত মনে হওয়ায় আমি আশান্বিত হয়ে উঠি। আমার ভালোলাগাটা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ; নিজের আর্ট বা ক্রিয়েটিভিটি দ্বারা আমাকে খুশি করতে চায় শামা। এটা আমাকে প্রভূত আনন্দ দিতে থাকলো।



একদিন শ্যুটিং শুরু হলো। শ্যুটিং-এর জন্য ওদের কক্সবাজার যেতে হচ্ছে। প্রথম নাটকেই খুব রোমান্টিক কিছু সিকোয়েন্স থাকবে। বাতাসে চুল আর উড়না উড়িয়ে সে সৈকতের পানিতে হাঁটতে থাকবে, উলটো দিক থেকে নায়ক আসবে। আমার কাছে খুব কমন এবং সাদামাটা সিকোয়েন্স মনে হলো। কিন্তু শামা খুব এক্সাইটেড।
টানা একসপ্তাহ ওরা কক্সবাজার রইল। এর মধ্যে মাত্র একবার শামার সাথে আমার কথা হলো। সে অভিভূত এবং এতই অভিভূত যে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।

নাটকটা কোনো টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হলো না, এটা রিলিজ করা হলো ইউটিউবে। আমাকে ফোন করে মাত্র ১৫ সেকেন্ডে এ খবরটা দিয়েই শামা কথা শেষ করে দেয়। বুকে ধড়পড়ানি নিয়ে নাটক দেখতে শুরু করলাম। ৪২ মিনিটের নাটক। ৭ মিনিটের মাথায় শামার আবির্ভাব। আমার খুব কষ্ট হতে লাগলো, কারণ, শামাকে বাস্তবের চাইতে আরো অনেক বেশি সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া দেখাচ্ছে। ও যত বেশি সুন্দরী হবে, আমার কাছ থেকে তত দ্রুত আরো দূরে চলে যাবে। ও আমার না হয়ে, হয়ে যাবে সকলের। আমি সময় টেনে টেনে সামনে যাচ্ছি। শুধু শামার অংশই দেখছি। নায়কের সাথে চোখাচোখি হলো শামার। খুব নিবিড়ভাবে তাকানোর একটা দৃশ্য। আমার হিংসা শুরু হলো এখান থেকেই। নায়কের চোখ বরাবর খুব গভীর একটা চাহনি ছুঁড়ে দিলে বাস্তবিকই হিংসায় আমি জ্বলে ছারখার হতে থাকলাম। যে-চোখে অসীম মোহ নিয়ে আমার দিকে তাকাবে, সেই চোখ কীভাবে শামা অন্য যুবকের চোখের উপর ফেলে?

অনেক যন্ত্রণা নিয়ে ৪০ মিনিট পর্যন্ত পৌঁছুলাম। স্পষ্টত এর পরের সিকোয়েন্সে যথারীতি মিলন হবে। নায়কের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে নায়িকা। সেই দৃশ্য চলে এলো অবশেষে- শামা সামনে হেঁটে যাচ্ছে। স্লো মোশনে হাঁটছে শামা। এইতো এখন লম্বা কদম ফেলে ধীর কদমে সামনে এগোচ্ছে শামা। এরপর থামলো দুজন - মুখোমুখী দাঁড়িয়ে। মাঝখানে কয়েক ফুটের দূরত্ব। হাত প্রসারিত করে সামান্য ঝুঁকতেই ছবি ফ্রিজ হলো- আর মনে হলো, আমার বুক থেকে বিরাট একটা পাহাড় নেমে পড়লো। শামার শরীর অন্য কেউ জড়িয়ে ধরুক, এ দৃশ্য আমি দেখতে চাই না। কিন্তু যখন আমি ভাবতে থাকলাম- সামনে ঝুঁকে পড়ে নায়কের বুকে শামা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন আমার মন সত্যিই খুব অশান্ত হয়ে উঠলো।

আবার শুরু থেকে শুরু করলাম। সঘন রোমান্সে পরিপূর্ণ একটা নাটক। কথার পৃষ্ঠে কথা; কথাপ্রধান নাটকটা শামার বাচনভঙ্গীতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রেমিকা হিসাবে শামা যে অসামান্য চৌকষ ও বরিষ্ঠা, এ নাটকে সেটা সে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। শামার জায়গায় অন্য কোনো নায়িকা হলে এটা আমার দেখা সেরা নাটক হতো; অথচ এটাকে এখন সবচাইতে কষ্টের আধার মনে হচ্ছে। শামা অমন করে হাসলো কেন? নায়কের মন পাওয়ার জন্য, মান ভাঙানোর জন্য কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! তীব্র ঈর্ষায় আমি পুড়ে যেতে থাকলাম।



নাটকটা খুব নাম করলো ইউটিউবে। কমেন্টে নায়কের প্রশংসা ভূরি ভূরি হলো, সেই তুলনায় নায়িকার প্রশংসা কিছুটা কম বৈকি। কিন্তু দর্শকরা শামাকে খুব পজিটিভলি নিয়েছেন, এবং এ নাটকটা শামার কেরিয়ার গঠনে একটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে, তা নিশ্চিত।
আমার ধারণা ছিল, অতি শীঘ্রই শামা আমাকে কল করবে। আমার মতামত জানতে চাইবে। আমাকে খুব উচ্ছল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোর ভালো লাগছে না?’ আমার একজন প্রিয়‘তমা’ বান্ধবী একজন সেলিব্রেটি, এ এক বিরাট গর্বের বিষয়। এ গর্বে আমার বুক উঁচু হবে। আমার তো খুব ভালো লাগারই কথা। শামা আমার মুখ থেকে সেটা শুনে নিশ্চিত হতে চায়।

কয়েক সপ্তাহ পর একদিন শামার ফোন। খলবলে কণ্ঠেই বললো, ‘কী রে, কিছু বললি না যে! তোর ভালো লাগে নি?’ আমি ওর ফোন পেয়েই গলে যাই।
‘খুব ভালো লেগেছে। অনেক অনেক ভালো লেগেছে নাটকটা।’
‘তাই? সত্যিই? আমাকে কেমন লেগেছে, বল তো?’
‘খুব সুন্দর লেগেছে তোকে?’
‘আচ্ছা বলতো, আমাকে দেখতে কার মতো লাগে?’ শামার এ প্রশ্ন শুনে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। আমি শুধু শামাকেই দেখে থাকি, শুধু শামাকেই দেখি। শামাকে শুধু শামার মতোই দেখতে লাগে। দেখতে কার মতো শামা- এ প্রশ্ন কোনোদিন মনেই আসে নি, তুলনা করবো কীভাবে, কার সাথে?
‘শোন, প্রডিউসার ভাইয়া কী বলে জানিস? বলে, আমি নাকি অবিকল মীনা কুমারী।’


কয়েক মাসের মধ্যে শামার আরো তিনটা নাটক হলো। একদিন খুশিতে খলখল করতে করতে একটা সুখবর জানালো, আগামী ১৭ তারিখে ওর একটা নাটক টিভিতে প্রচারিত হবে। খুব দুর্দান্ত একটা নাটক। আমি যেন আমাদের সব ক্লাসমেটকে খবরটা জানিয়ে দিই। আমাকে বার বার বললো, কেউ যেন নাটকটা মিস না করে।
ইতোমধ্যে শামার একটা সেলিব্রেটি ইমেজ আমাদের ক্লাসমেটদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এলাকার অনেক মানুষ, বিশেষ করে যারা অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করে ইউটিউব দেখে, তাদের মধ্যে ‘দেশের মেয়ে’ হিসাবে একটি বাড়তি জনপ্রিয়তাও সৃষ্টি হয়েছে।
আমার ভালো লাগলো যে, ওর সুখবরটা অন্য বন্ধুদের জানাতে শামা আর কাউকে না, স্বয়ং আমাকে বলেছে। যে কাছের, বা আস্থার, তাকে এ কাজ দেয়া যায়। আবারও আমার আশা জেগে ওঠে।
কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে টিভিতে নাটক প্রচারের খবর বলতে যেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম- অনেকের কাছে ঢের আগেই এ খবর পৌঁছে গেছে। আরো একটা বিষয় জেনে খুব বিস্মিত হলাম, অনেকের সাথেই শামার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আমার ধারণা অন্ধ ছিল, শামা একমাত্র আমাকেই মাঝে মাঝে ফোন করে থাকে; আমি একাই ওর নাটকের একনিষ্ঠ বিমুগ্ধ দর্শক, এমনকি নাটকের খবরাখবর প্রচারের মুখপাত্রও আমি একাই।



নাটকে বলতে গেলে অল্প সময়েই শামার নাম ছড়িয়ে পড়লো। ওর সব নাটকই টিভিতে এবং সেই সাথে ইউটিউবেও প্রচারিত হতে লাগলো। একটা নাটকে গানের দৃশ্য ছিল এবং সেই গানে বৃষ্টিতে ভিজে নায়কের হাত ধরাধরিসহ কিছু ঘনিষ্ঠতাও ছিল। এসব দেখে এখন আর আগের মতো কষ্ট লাগে না। আমি মেনে নিয়েছি, আমার জীবনে শামা কোনোদিন আসবার নয়। নিভে যাওয়া মীনা কুমারীর মতো শামাকে সারাজীবন দূর থেকেই দেখে যেতে হবে।
সবচাইতে দারুণ খবরটা এলো পরের বছর। অনেক বড়ো বাজেটের একটা ছায়াছবি হবে এবং শামা সেই সিনেমার নায়িকা নির্বাচিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, পাঁচটা দেশে শ্যুটিং হবে- থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, সিংগাপুর, শ্রীলংকা, ভারতের সিমলা এবং ইটালিতে হবে একটা বিশেষ এপিসোড। শামা আনন্দ ও উত্তেজনয়া ডগমগ করছে।

এরপর অনেকদিন শামার সাথে যোগাযোগ হয় না। ওর কোনো খবর পাই নি কারো কাছে। নতুন কোনো নাটকও নেই, সে ব্যস্ত সিনেমা নিয়ে। নিজের হীনমন্যতা কাটিয়ে একদিন শামার নাম্বারে কল দিলাম। আমার বুক ঢিভঢিভ করছিল। কল রিসিভ করলো একজন পুরুষ কণ্ঠ। পরিচয় জানতে চাইলে জানালেন তিনি শামা ম্যাডামের পিএস।
‘একটু কথা বলতে চাইছিলাম।’
‘ম্যাডাম এখন রেস্টে আছেন।’
শামা ম্যাডামের হয়ত একান্ত ব্যক্তিগত আরেকটা নাম্বার আছে। সেটা চাইতে পারতাম, কিন্তু তার জবাবে পিএস সাহেবের কোনো অনভিপ্রেত কথা শুনতে হয় আশঙ্কা করে সেটা চাই না। পিএস সাহেবকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, ম্যাডামকে প্লিজ জানাবেন, আমি তার ক্লাসমেট এবং অবশ্যই একজন ফ্যান। ‘জি, অবশ্যই’ বলে পিএস কল রাখলেন।

শামা আর ফোন ব্যাক করলো না। আমি অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন। ওকে আমি পাব না জানি। আমার প্রতি ওর কোনো প্রেম নেই, সেটাও সুস্পষ্ট। তবু, মন খুব চায়, শামা আমাকে কিছুদিন পর পর ফোন করে বলুক, ‘কী রে, ভালো আছিস তুই? খবর কী তোর? আমাকে ভুলে গেছিস কীভাবে, বল তো?’ দেশের এক খ্যাতনামা নায়িকার সাথে আমার পরিচিয় রয়েছে, যিনি আমার বান্ধবী, এ কথা আর দশজনকে বললে তারা আমাকে ভিড় করে ধরবে। কতকিছু জানতে চাইবে! আমার গৌরব আকাশ ছুঁয়ে যাবে। প্রেম না পাওয়া এক প্রেমিকের জন্য এটাই হলো বড়ো সান্ত্বনা।
কোনো কোনো সময়ে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি লোপ পায়, লজ্জা বা হায়ার অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। আমিও বেহায়ার চূড়ান্ত হয়ে, মনকে প্রবোধ দিতে না পেরে আরেকদিন শামাকে ফোন দিলাম। যথারীতি পিএস সাহেব ফোন ধরলেন। আমার সৌভাগ্য যে, তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। আমার কথা ম্যাডামকে বলেছিলেন, তা বললেন। মনে হলো অপ্রীতিকর একটা কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু বলতে চেয়েও শেষমেষ বললেন না। তবে, তিনি এ দারুণ সংবাদটা দিয়ে শেষ করলেন- ম্যাডামের ছবির রেড কার্পেট প্রিমিয়ার শো হবে পরের মাসের ২৩ তারিখে। এ নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত আছেন।
তবু আমি অপেক্ষায় ছিলাম, একটা মিনিট বা মুহূর্তের জন্য হলেও শামা ওর এই সাফল্যের দিনে আমাকে ফোন করবে। বলবে, ‘তুই খুশি হোস নি? দেখ, আমি এ দেশের প্রথম হিরোইন, যার ছবির রেড কার্পেট হচ্ছে।’

গত কয়েক বছরে বেশ ক’বার ঢাকা এসেছি। অনেক বার ইচ্ছে করেছে, শামার বাসায় যেয়ে ঘুরে আসি। যাই নি। শামা কখন কোথায় থাকে, দেশে কী বিদেশে! একজন নামজাদা নায়িকার বাসায় যাব, কত মানুষই তো যায়, সবাই কি দেখা পায়? ভেতরে ঢুকতে না পেরে গেট থেকে ফিরে আসবো, নিজেকে অতখানি খাটো ও অপমানিত করতে চাই নি। আরো কত সংকোচ কাজ করেছে মনের ভেতরে!

রেড কার্পেট প্রিমিয়ার শো শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আমাদের একজন ক্লাসমেট, যে স্থানীয় এক ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির বড়ো ছেলে, কথাচ্ছলে আমাকে জানিয়েছিল, শামা এত করে বলার পর সে ‘না’ বলতে পারে নাই; ওর পারসোনাল ইনভাইটেশন পেয়ে সে রেড কার্পেট প্রিমিয়ার শো-তে গিয়েছিল। রেড কার্পেট দুর্দান্ত হয়েছে। ছবিটাও অসাধারণ।

আমাদের পুরো জীবনটাই ছোটো-বড়ো অজস্র পরাজয় ও ব্যর্থতার গ্লানিতে ভরপুর। এই গ্লানির ভেতরে ডুবে থাকতে আমাদের না জানি কত বাসনা! অতীত রোমন্থনেই যেন সর্বসুখ। Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. আমরা হেরে যাই, ডুবে যাই, আর তার কষ্টের গান গাইতে থাকি জীবন ভর।
আমি ঘুরে দাঁড়াই। নিহত প্রেমের জন্য নিজেকে কুরে কুরে নিঃস্ব করে আমার কী লাভ? কেবল দুঃখের গান গাইতেই এ জীবন নয়, দুঃখ নিংড়ে বের করে আনতে হবে হেমের নির্যাস। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি। আমি নিজেকে সন্ধান করি। বেরিয়ে আসে এক অসাধারণ আবিষ্কার। দেখি, আমার ভেতরে রয়েছে কিছু অমূল্য সম্পদ, আমার সূক্ষ্মতম অনুভূতি, আমার অভিমান, আমার আত্মসম্মানবোধ, যা আমাকে অনেক অনেক দিন পর্যন্ত যেচে শামাকে ফোন করতে দেয় নি। যেচে আমাকে শামার বাসায় নিয়ে যায় নি। আমাকে বলতে দেয় নি, ‘শামা, আমি তোকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, শামা।’ এবং যেদিন সমস্ত আত্মসম্মান বিকিয়ে নিজ থেকে শামাকে ফোন করেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে, ওটা খুব দরকার ছিল। নইলে শামাকেও চিনতে পারতাম না, আর খুঁজে পেতাম না নিজের আবিষ্কারকেও।

১৯ জুলাই ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:৪৭
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×