দেশে খুন, ধর্ষণসহ আরো অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানববন্ধন, মিছিল, শ্লোগান হচ্ছে। কিন্তু, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন কোনো প্রতিবাদ, মানববন্ধন, সমাবেশ হয় না? আমার পঞ্চাশোর্ধ বয়সে কখনো এমন সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ দেখি নি, চোখে পড়ে নি। আপনারা কেউ এর সাক্ষী হয়ে থাকলে জানালে কৃতার্থ হবো।
ঘুষের প্রতি কি আমাদের লোভ বা আগ্রহ খুব বেশি? খুব বেশি নয় কি? এর কারণ কী? ঘুষ কি তাহলে অন্যসব ‘বৈধ’ কাজের মতোই একটা কাজ, যা যে-কোনো সময়ে যে-কোনোভাবে করা যায়? আমি অবাক হয়েছি আরো, গতরাতে এ ব্যাপারটি নিয়ে ফেইসবুকে স্টেটাস দিলে সেখানেও এর উপর গোটা পাঁচেক ‘লাইক’ ছাড়া আর কোনো কমেন্ট পড়লো না। পরে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আমি মানুষের সবচাইতে স্পর্শকাতর একটা জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছি, যা একটা গর্হিত অন্যায় হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
ঘুষ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে মিশে আছে। ঘুষ ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে যে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করে অন্যের আগে কাজটি পাওয়ার জন্য তৎপর হয়ে পড়ি, কিংবা অন্যকে হঁটিয়ে বা অন্যকে না দিয়ে আমাকে কাজটি দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে ঘুষ বা কমিশন দিতে চাই। ঘুষ দিয়ে কারচুপির সুযোগ গ্রহণ করতে চাই, যেমন, টেন্ডারের তথ্য পাচারের জন্য ঘুষ দিতে চাই। একটা কাজ পাওয়ার জন্য ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে ‘তাদের’ পিছে পিছে ঘুরি। নির্ধারিত সময়ের আগে কাজটি সম্পন্ন করে দেয়ার জন্য ঘুষ দিতে চাই। অবৈধ কোনো কাজের অনুমোদনের জন্য ঘুষ দিতে চাই, যেমন ১৩তলা বিল্ডিঙের জায়গায় ২১তলা করার জন্য রাজউকের অসাধু কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে চাই। বেআইনি বিদ্যুৎ লাইন পাওয়ার জন্য ঘুষ দিয়ে থাকি। বাড়ি বানানোর জন্য অবৈধ নকশার অনুমোদন পেতে ঘুষ দিয়ে চাপাচাপি করি। বিমান বন্দর বা সমুদ্রবন্দরে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য ঘুষ দিয়ে থাকি। সরকারি জায়গা অবৈধভাবে নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করে নেয়ার জন্য সংস্লিষ্ট অফিসে দৌড়ঝাঁপ করি। আবার, অন্যের জায়গা নিজের নামে লিখিয়ে নেয়ার জন্যও কম দুর্নীতি করি না।
চাকরি পাওয়ার জন্য 'যোগ্য' না হয়েও চাকরি পেতে চাই, ফলে 'যোগ্য' লোকটি চাকরি পান না, তার স্থলে অন্য 'অযোগ্য' লোকের চাকরি হয়। এই ‘অযোগ্য’ লোকটি যখন ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পায়, তখন থেকেই তার মাথা ভন ভন করে, কতদিনে সে চাকরিতে ঢুকবে, আর কড়ায়-গণ্ডায় ঐ ৫ লাখ টাকা ‘ঘুষ’-এর মাধ্যমে তুলে পূর্ণ-উদ্যমে লাভের টাকা তুলতে শুরু করবে। আমার ছোটোভাইয়ের স্ত্রী একবার প্রাইমারি শিক্ষক পদে চাকরি প্রার্থী ছিল। সব পরীক্ষা শেষে সে জানালো, চাকরি পেতে হলে তাকে ৬০ হাজার টাকা ‘ঘুষ’ দিতে হবে। ঐ সময়ে এই ৬০ হাজার টাকার মূল্য আজকের ১২ লাখ টাকার সমান ছিল। যারা ঘুষ খেয়ে থাকেন, তারা নিজের ব্যাংকা অ্যাকাউন্ট কখনো চেক করেন না বলে জনশ্রুতি আছে; কারণ, ঘুষের অংকের কাছে বেতনের অংক খুবই নগণ্য, তার প্রতি দৃষ্টিপাত করা সময়ের অপচয় মাত্র।
পদোন্নতির জন্য, পোস্টিঙের জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে থাকি আমরা। একটা অন্যায় অপরাধকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য পুলিশকে ঘুষ দিতে চাই। বিচারের জন্য সালিশি বসবে- মাদবর, মেম্বার, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলরদেরকে ঘুষ দিয়ে নিজের পক্ষে ‘রায়’ দেয়ার জন্য প্রভাবিত করে থাকি। খুনের সাক্ষীকে ঘুষ দিয়ে থাকি, যিনি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাবলীল কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘উক্ত ব্যক্তি একজন পয়গম্বর, তিনি খুন করেন নাই, ওখানে খুনের কোনো ঘটনাই ঘটে নাই।’ খুন বা ধর্ষণের ঘটনাকে সাধারণ ঘটনা কিংবা ‘নাই ঘটনা’ হিসাবে দাঁড় করানোর জন্যও ঘুষের ব্যবহার ব্যাপক। দুর্নীতি দমনের জন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদেরকেও আমরা অসঙ্কোচে ঘুষ অফার করে থাকি।
এই ঘুষের দেশে কেউ ঘুষ বা দুর্নীতির বিপক্ষে জোরেসোরে কথা বলছেন না কেন? কারণ, ঘুষ না দিলে কাজটা সহজে করা যায় না। ঘুষকে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘স্পিডমানি’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছি। কেউ কেউ ঘুষকে ‘পুরস্কার’ বা ‘বকশিস’ হিসাবে হাসিমুখে গ্রহণ করে থাকেন; কিংবা ‘ঘুষ কোনো অপরাধ নয়, উপরি পাওনা’- এই সরল বিশ্বাসে অবারিতভাবে ঘুষ গ্রহণ করে থাকেন; কেউ কেউ বলেন, ‘তিনি খুশি হয়ে আমাকে এই টাকাটা দিয়েছেন।’ এভাবে কেউ কেউ ঘুষ গ্রহণকে বৈধ বলে মনে করেন। বিস্মিত হবো না, যদি কেউ এমনটা ভেবে বসেন যে উপরি পাওনা বা ঘুষ তার ন্যায্য অধিকার।
প্রতিটা সরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত বেতন-স্কেল আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা মাসিক বেতন-ভাতার বাইরেও অতিরিক্ত বেতন-ভাতা, যেমন টিএ-ডিএ, ওভার টাইম, এমনকি ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ বা Workers' Profit Participation Fund পাবেন, তা সুস্পষ্টাবে লিপিবদ্ধ থাকে। এর বাইরে কারো কাছ থেকে একটা কানাকড়ি গ্রহণও ‘অবৈধ’ বা ‘উৎকোচ’ হিসাবে বিবেচিত হবে, যা গ্রহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনাকে খুশি করতে হবে কেন? আপনাকে ‘কাজ’ করার জন্যই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বরং আপনারই উচিত, যে-কাজের জন্য আপনি নিযুক্ত হয়েছেন, ওটি সুসম্পন্ন করে প্রজাকে বা ভোক্তাকে সর্বোত্তম ভাবে ‘খুশি’ করা; আপনিই বরং প্রজার কাজটি সম্পন্ন করে দেয়ার পর বিনয়ী কণ্ঠে তার কাছ থেকে ফিডব্যাক আহবান করুন, ‘স্যার, আপনার কাজটা কি ঠিকমতো সম্পন্ন করে দিতে পেরেছি?’ প্রজা বা ভোক্তার একটা ‘ধন্যবাদ’ই আপনার জন্য বিরাট ‘ইনসেনটিভ’ বা পুরস্কার হতে পারে, যা প্রমাণ করবে যে আপনার নিযুক্তির জন্য আপনিই ‘যোগ্য’ ব্যক্তি।
আমি গ্রাসরুট লেভেলে দেখেছি, ‘ঘুষ’ না নেয়ার ব্যাপারে মোটিভেশন কোনো কাজ করে না। গ্রাসরুট লেভেলের ঘুষখোররা কোনোদিনই প্রকাশ করেন না তারা কাকে, কীভাবে কতটাকা করে ঘুষ দেন। ঘুষখোরদের স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, সবাই কিন্তু জানে লোকটা ঘুষ খান। কারণ, চাকরির বেতন খুব বেশি না। আজকের বেতনস্কেল অনুযায়ী ৭ম থেকে ১০ম গ্রেডের এক কর্মকর্তার বেতন সর্বসাকুল্যে ৬০ হাজার টাকার বেশি হবে না। কিন্তু, ঢাকা শহরে তাদের কয়েকটা বাড়ি, কয়েকটা ফ্ল্যাট পাওয়া যায়; সন্তানাদি পড়ালেখা করে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায়। আবার, মাসিক ৮০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন। এই কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও সন্তানাদিরা কখনো জিজ্ঞাসা করেন না- তুমি এত টাকা কোথায় পাচ্ছ? কারণ, তারা জানেন এই টাকার পাহাড়ের উৎস কোথায়। তারা বরং এই কীর্তিমান পুরুষের কীর্তিতে গর্বে উল্লসিত হয়ে বলে ওঠেন – আমার স্বামী একজন অনেক শক্তিশালী অফিসার। সন্তানরা অন্যদের সাথে বিতর্ক করে, কার বাবা কত বেশি ‘উপরি’ উপার্জন করেন। আপনারা তো শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ এবং এরকম অজস্র কীর্তিমান শক্তিশালী কর্মকর্তার প্রতিবেশী- আপনাদের কখনো প্রশ্ন জাগে নি মনে – এই লোকটা কীভাবে হড়হড় করে এত টাকা বানাচ্ছেন? অর্থাৎ, আপনারাও এই ওপেন সিক্রেট মেনে নিয়েছেন যে, উনি ঘুষের টাকা দিয়েই এভাবে ফুলে বটগাছের গোড়া হচ্ছেন। হয়ত, এমন শক্তিশালী কর্মকর্তার প্রতিবেশী হিসাবে নিজেও অনেক গর্ব প্রকাশ করে থাকেন।
কাউকে কাউকে বড়ো গলায় বলতে দেখা গেছে- আমার বাবা ‘অমুক’ বড়ো পদে চাকরি করেন। আমার তখন ইচ্ছে করে তার বড়ো গলাটা চেপে ধরে বলি- আপনার বাবা যে এত অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন, বাবার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেছেন? করেন নি, বরং আরো আহ্লাদিত হয়ে বলেছেন- আই অ্যাম প্রাউড অব মাই ফাদার, হি ইজ সো রিচ!!!
কোন পক্ষ আগে ঘুষের অবতারণা করেছিল- ঘুষদাতা, নাকি ঘুষগ্রহীতা, তা ব্যাপক গবেষণার বিষয়। তবে, ঘুষ দিতে দিতে ঘুষখোরদের অবস্থা এখন এমন হয়ে গেছে যে, ফাইলের ফিতা খোলার জন্য হলেও আপনাকে ঘুষ দিতে হবে। প্রতি টেবিলে আপনাকে ঘুষ দিতে হবে।
আর এই ঘুষ-দুর্নীতির সাথে আরেকটা বিষয় জড়িত, সেটা হলো চাঁদা। চাঁদা কথাটা কমিশন ও ঘুষ শব্দের সাথে কখনো সমার্থক, কখনো পরিপূরক। আপনি একটা কাজ পাবেন, তার জন্য চাঁদা লাগবে; বিল পাশ করাতে যাবেন, ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিবেন আপনি। অন গ্রাউন্ডে কাজটা যখন চলমান, তখন স্থানীয়/অস্থানীয় ‘সন্ত্রাসীদেরকে’ চাঁদা না দিলে কাজ বন্ধ থাকবে।
চাঁদা কি বন্ধ করা যাবে? কোন লেভেল পর্যন্ত চাঁদা দেয়া-নেয়া হয়?
ঘুষ-দুর্নীতি হলো সকল অপরাধ, খুন-খারাবির উৎস। এ থেকে অপরাধ সংঘটিত হয় এবং ছড়ায়। আমরা কি এই ঘুষ-দুর্নীতি থেকে মুক্তি চাই? তাহলে সবার আগে ঠিক থাকতে হবে, ঠিক হতে হবে আমাদেরকেই। আপনি কোথাও ঘুষ দিয়েন না। আপনার কাজ নির্ধারিত সময়ে হয় কিনা দেখুন। না হলেও ঘুষ দিয়েন না। আপনার বৈধ কাজটি নির্ধারিত সময়ে হচ্ছে না কেন, দুদকে দরখাস্ত/অভিযোগ জমা দিন। তার আগে নিশ্চিত হোন, আপনি বৈধভাবে একটা বৈধকাজের জন্যই আবেদন করেছেন। জোটবদ্ধ হোন। মিডিয়ায় মুখ খুলুন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন। নিজেরাই বুদ্ধি করুন ঘুষ না দিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কীভাবে কাজটি আদায় করে নিতে হবে। এটা আপনার মৌলিক ও ন্যায্য অধিকার। আপনি ঘুষ দিয়েন না। এভাবে প্রতিটা ওয়ার্ড/ইউনিয়ন থেকে ঘুষ দেয়া বন্ধ করুন। আপনি সাধারণ নাগরিক হোন, কিংবা ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবী- সবাই মিলে ঘুষ দেয়ার কাজটা বন্ধ হলে ঘুষ দুর্নীতি ব্যাপক ভাবে কমে আসবে। আবারও বলছি, সকল দুর্নীতির মূলে হলো ঘুষ। ঘুষ বন্ধ হলে দুর্নীতি ও অন্যান্য অনেক অপরাধ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে।
আপনি কি ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চান? তাহলে ঘুষকে না বলুন। আর সময়মতো একবার ঘুষের বিপক্ষে দেশ জুড়ে জেগে উঠুন, বলুন, ঘুষখোররা নিপাত যাক, বাংলাদেশ শান্তি পাক।
৩০ অক্টোবর ২০২০
দ্রষ্টব্য : ঘুষখোর মেয়ে
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৮:৪০