১৯৮৪ সালের ২৭ নভেম্বর। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে দিনটির কথা। বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন, যা হাজার বছরেও একবার আসে না। ঐদিন বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যেভাবে নিজেকে এক মহিমান্বিত জাতি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, আর তার পেছনে যে যুবকের অসামান্য অবদান ছিল, আজ সেই কাহিনি আবার নতুন করে আপনাদের মনে করিয়ে দিব।
১৯৮৪ সালে বিগত ১৪ বছরের সকল রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড ৮৯৩ নম্বর পেয়ে এসএসসি পাশ করার পর ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। সায়েন্স গ্রুপ, সেকশন-সি, রুল নাম্বার ৫৭। নর্থ হোস্টেল, ১০১ নাম্বার রুম। অ্যাডমিশন টেস্টে আমরা ৩৬৬ জন ছাত্র সিলেক্টেড হয়েছিলাম (আমাকে অ্যাডিমিশন টেস্ট দিতে হয় নি), যদিও সায়েন্স গ্রুপ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম প্রায় হাজারের কাছাকাছি। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আমরা একে অপরের রোল নাম্বার জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতাম, সে অ্যাডমিশন টেস্টে কোয়ালিফাই করে ভর্তি হয়েছে, নাকি মামা-চাচা-খালুর জোরে টিসি নিয়ে এসে ভর্তি হয়েছে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সেই সময়ে ঢাকা কলেজই ছিল এক এবং অদ্বিতীয় সেরা কলেজ সারা বাংলাদেশে।
আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হবে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে। অ্যাডমিশন কমপ্লিট করে সদর ঘাটে যেয়ে লঞ্চে করে বাড়ি চলে গেলাম।
বাড়িতে যাওয়ার ৩দিনের মাথায় হঠাৎ দেখি থানা থেকে ওসি সাহেব, সাথে ৩জন স্টাফসহ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। আমরা তো একটু ভয় পেয়ে গেলাম- ব্যাপার কী! আমাদের চোখেমুখে ভয়ের আভাস দেখে ওসি সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই তোমার নাম খলিল!
আমি ঢোক গিলতে গিলতে কোনোরকমে বুক হালকা হয়ে যায়। এবং হাঁফ ছেড়ে বলি, জি স্যার, আমিই খলিল।
ওসি সাহেব আমার মা আর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের ছেলের জন্য আমরাও গর্বিত। আপনার ছেলে যে এতবড়ো ফুটবল খেলোয়াড়, এজন্য দোহার থানার ওসি হিসাবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
এরপর ব্যাপারটা খুলে বলার পর আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমার বাবা-মাও খুব খুশি। গ্রামের মাদবর সাহেব এসেছিলেন, আনন্দে তারও চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সেই ছোটোবেলা থেকেই ফুটবল খেলি। আমার ফুটবল খেলা দেখে স্কুলের শিক্ষকগণ, এলাকার মানুষ বলতেন, আমিই বাংলাদেশের ম্যারাডোনা। আমার কারণে আমাদের স্কুল পর পর তিন বছর থানা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন ছিল। জেলা পর্যায়ের চ্যাম্পিয়নশিপে আমি ছিলাম ঢাকা জেলা টিমের টিম ক্যাপ্টেন, ২ বছর ধরে। ২ বছর তখনো পর্যন্ত কেউ টিম ক্যাপ্টেন থাকতে পারে নি, আমি রেকর্ড করেছিলাম। দুবার আমি শ্রেষ্ঠ প্লেয়ার হয়েছিলাম।
নভেম্বরের ২৫ তারিখে আন্ডার এইটিন (১৮ মাইনাস) আর্জেন্টাইন টিম বাংলাদেশে আসবে। বাংলাদেশের আন্ডার এইটিন টিমের সাথে আর্জেন্টিনা টিমের খেলা হবে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন আমাকে টিম ক্যাপ্টেন নির্বাচন করেছে। পরশু থেকে ক্যাম্পিং শুরু হবে, এবং সেটা হবে আমাদের ঢাকা কলেজের মাঠে। আগামীকাল সাড়ে দশটায় হেলিকপ্টার আসবে আমাকে নেয়ার জন্য। সকাল ১০টার মধ্যেই আমাকে থানা সদরের হেলিপ্যাডে উপস্থিত থাকতে হবে। এ সংবাদটা সত্যিই শুধু আমার জন্য না, পুরো গ্রামবাসী, আমাদের দোহার থানা, সর্বোপরি ঢাকা জেলার জন্য ছিল সম্মান ও গৌরবের।
পরের দিন হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা চলে আসি। মাননীয় এমপি মহোদয় এলেন আমাকে সি-অফ করার জন্য। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন- তুমি আমাদের এলাকার গর্ব। দেশের গর্ব। তুমি আমাদের আগামীর ম্যারাডোনা।
হেলি কপ্টার ভ্রমণটা রোমাঞ্চকর ছিল। যদিও ওটা ছিল হেলিকপ্টারে আমার ৫ম ভ্রমণ। এর আগে একবার চট্টগ্রাম এবং দু’বার খুলনা স্টেডিয়ামে খেলার জন্য আমাদেরকে এমআই -১৪ হেলিকপ্টারে করে নেয়া হয়েছিল। একবার জাতীয় পর্যায়ে আমাদের টিম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পুরা টিমকে প্রেসিডেন্টের সাথে একেবারে উত্তর থেকে যমুনা নদীরেখা বরাবর দক্ষিণ দিকে, অতঃপর পদ্মা নদীর উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্লেজার ট্রিপ দেয়া হয়েছিল। সেটা একটা স্মরণীয় আকাশভ্রমণ ছিল।
ক্যাম্পে এসে দেখি সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের ঢাকা কলেজ থেকে আরো একজন ছাত্র টিমে আছে। সে অবশ্য সেকেন্ড ইয়ারের। দলে মোট ৩৩জন ছাত্র। এর মধ্যে ঢাকা শহরের কলেজগুলো থেকেই সর্বাধিক ২১জন।
দল নির্বাচনের ভার দেয়া হয়েছে কোচ এবং আমাকে। কোচ একজন ব্রাজিলিয়ান। তিনি অবশ্য জাতীয় দলের কোচ, তবে এই ইভেন্টের জন্য তাকে স্পেশিয়ালি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আমাদের রাতদিন কঠোর অনুশীলন করতে হচ্ছে। ভোরে উঠে প্রথমে ১০ মিনিটের স্ট্রেচিং, এরপর ৭কিলোমিটার দৌড় ও জগিং, তারপর পাক্কা ৩০ মিনিট ফিল্ড এক্সারসাইজ করার পর পায়ে ফুটবল দেয়া হয়। তবে, কোচের সাথে আমাকেও কোচিং করাতে হয়। কারণ, কোচের ব্রাজিলিয়ান ভাষাটা সবাই বুঝতে পারে না। আর আমি খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচাইতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হওয়ায় সবাই আমার টিচিংটাই আশা করে এবং ভালোবাসে।
আমরা পুরো টিমকে দুইভাগে ভাগ করে প্রতিদিন ৯০ মিনিটের পরিবর্তে ১৪০ মিনিটের খেলা খেলতে শুরু করলাম, মাঝখানে ২০ মিনিটের বিরতি দিয়ে প্রতি হাফে ৬০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা করে খেলা। এতে আমাদের স্টেমিনা বাড়বে। এই ইউনিক ও ম্যাভেরিক আইডিয়াটা অবশ্য আমার ছোটো ভাইয়ের, যা আমার পছন্দ হওয়ায় টিমের জন্য কাজে লাগাই।
আমাদের অনুশীলন চলতে থাকলো পুরোদমে। আমার শরীর আগের যে-কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি ফিট। প্রতিদিনই আমি একাই ৬/৭টা করে গোল দিই এবং আমার টিমই প্রতিদিন জিততে থাকলো। এই সময় কিছু মজার ঘটনা ঘটলো। আমার খেলা দেখে অনেকেই খুব মুগ্ধ হতো। ক্লাস ও হোস্টেল থেকে ছাত্ররা মাঠে এসে খেলা দেখতো। শিক্ষকদের জন্য গ্যালারিতে বসার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে স্যার ও ম্যাডামরা এসে খেলা দেখেন। আমি অবাক হতাম, সবাই আমার খেলা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। আমি কখনো কখনো মাঠ থেকে বিশ্রাম নিই। ঐ সময় দর্শকরা খেলা দেখা ছেড়ে চলে যায়, হতাশ হয়ে। আমি যদি আবার মাঠে নামি, দেখা যায় দর্শকরা আবার ফিরে এসেছে।
একবার এক মজার কাণ্ড ঘটলো। দেখলাম, ইডেন কলেজ থেকে বেশ কয়েকটা মেয়ে এসেছে খেলা দেখার জন্য। তারা সবাই শিক্ষকদের গ্যালারিতে একপাশে বসেছে। খেলার বিরতির সময় আরো অবাক হলাম। দেখলাম মাঝারি গড়নের শ্যামলা মতো (কিন্তু খুব আকর্ষণীয়া) একটা মেয়ে মুখে হাসি ছড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই আমি বিস্ময়ে হতবাক- এ দেখি আমাদের ক্লাসমেট সোহানা সাজি! আমরা একই স্কুলে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা কলেজে শুধু ছেলেরা পড়তে পারে বলে সোহানা এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে পারে নাই। যাই হোক, সোহানাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। খেলা দেখা শেষ করে আমরা অবশ্য বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম- সিনেমার নাম ছিল ‘দিন যায় কথা থাকে’।
যথাসময়ে আর্জেন্টাইন টিম বাংলাদেশে এলো। ক্রীড়ামন্ত্রী মহোদয় এয়ারপোর্টে গেলেন তাদের রিসিভ করতে। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, আমাকেও তার সাথে যেতে হবে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জেই দুই টিমের দুই ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎ হয়ে গেলে তারা পরস্পরকে চিনতে পারবে, আই’স ব্রেকিংও হবে।
আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম, টিমের সাথে ম্যারাডোনা আসছেন। ম্যারাডোনা তখনো এত নামকরা হন নাই। কিন্তু, তাকে বাংলাদেশের অনেক মানুষ চিনতো।
ঐ টিমে মোট ২৩জন ছিলেন ম্যারাডোনা সহ। ম্যারাডোনার সাথে পরিচিত হয়ে তখন যদিও এতটা উচ্ছ্বসিত হই নি, কিন্তু তিনি যখন বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড় হয়ে গেলেন, তখন তার সাথে তোলা আমার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নিজেকে খুব সৌভাগ্যমান মনে হতো।
আর্জেন্টিনার সাথে একটা ওয়ার্মআপ ম্যাচ হবে, মাত্র ১৫ মিনিটের ম্যাচ। মাঠের মাপ হবে আবার প্রচলিত মাপের অর্ধেক – ৬০ ফিট বাই ৪০ ফিট। কিন্তু গোলপোস্ট হবে প্রচলিত মাপের চাইতে দেড়্গুণ বড়ো।
এই ১৫ মিনিটের ম্যাচটাই ছিল আমাদের ফাইনাল খেলার মিনিয়েচার ভার্সন। প্রথম সাড়ে তিন মিনিটের মাথায় আমি গোল করি। এরপর গোল করে আর্জেন্টিনা। শোধ করি মাত্র ১৩ সেকেন্ডের মাথায়, তবে এই গোলটা করে আমাদের কলেজের একটা ছেলে, হাসান। এরপর খেলা জমে উঠলো। আমার পা যেন জাদুকরের পা হয়ে গেল। পায়ের জাদুতে আমি একাই ৪টা গোল করি। বাংলাদেশ জিতে গেল ৯-৪ গোলে। মাঠ ছোটো হওয়ায় এবং গোলপোস্ট বড়ো হওয়ায় গোলের সংখ্যা বেশি হয়েছিল।
ওয়ার্ম আপ ম্যাচে আমাদের জয় দেখে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, খেলায় আমাদের জয় নিশ্চিত।
আগামী পরশু ফাইনাল। আজ সকালে আমাদের ফাইনাল এক্সারসাইজ ও প্র্যাকটিস। আগামীকাল সকালে পূর্ণ বিশ্রাম, বিকালে হালকা প্র্যাক্টিস।
আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে কম্পিটিশন শুরু করি। এ পর্যন্ত প্রতিটি প্র্যাক্টিস ম্যাচেই আমি ৬/৭টা করে গোল করেছি। আজ আমি টার্গেট করলাম গোল করবো ১০টা। সেই টার্গেট নিয়েই খেলা শুরু করলাম। ও, আজ হবে ৪৫ + ১৫ + ৪৫ মিনিটের খেলা। আমি ফার্স্ট হাফেই ৬টা দিয়ে ফেললাম। নরমালি সেকেন্ড হাফে স্টেমিনা কমে যায়, তবু ভাবলাম ৪টা গোল আশা করি দেয়া যাবে। সেই ইচ্ছা নিয়েই সেকেন্ড হাফ শুরু করলাম।
খেলছি। বল নিয়ে ছুটছি ডি-এর দিকে। ছুটছি- গ্যালারিতে দর্শকরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। ঠিক ঐ মুহূর্তে গোলকিপার সামনে এগিয়ে আসে, আর ওর ডান পায়ের একটা কিক এসে লাগে আমার তলপেট বরাবর। প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে বিকট চিৎকারে আমি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকি। যখন আমার হুঁশ হয়, দেখি ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে আমাকে অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে রাখা হয়েছে। আমার পাশে মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্রীড়ামন্ত্রীসহ আরো অনেকে, যাদের আমি চিনলাম না। এর মধ্যে আমাদের প্রিন্সিপালও ছিলেন।
আমার খুব কষ্ট লাগতে লাগলো- ব্যথার জন্য না, আমি যে ইনজিউর্ড হয়ে গেলাম, সেজন্য। আমি কি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবো? পরশুদিন খেলা। আমি কি খেলতে পারবো?
আমাকে ডাক্তারগণ অনেক উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভালো করে তুললেন। কিন্তু ফিজিও থেরাপিস্ট ও কোচ আমার কিছু টেস্ট নিতে গেলে দেখা গেল, আমার শরীর পুরোটাই আনফিট। কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করলো। এই ঐতিহাসিক খেলায় আমি খেলতে পারবো না? এত যত্নে তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজের দক্ষতা এ দেশের মানুষ, বিশ্ববাসীকে তাহলে দেখানো যাবে না?
বিকেল ৩টায় খেলা শুরু হবে। আমরা ২টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়লাম। গ্যালারি থইথই করছে দর্শকে। আমি অভিভূত হলাম একটা দৃশ্যে- দর্শকদের হাতে প্লাকার্ড। প্লাকার্ডে আমার নাম আর ছবি। আমার চোখে পানি চলে এলো। হায়, আজ আমি খেলতে পারলে দর্শকরা কতই না আনন্দ পেত। অথচ তারা কেউ জানে না, আমি আহত হয়ে মাঠের বাইরে থাকবো।
সেদিন আমেরিকা, সোভিয়েট ইউনিয়ন, চায়না, ব্রিটেনসহ পৃথিবীর ৪৩টা দেশে ঐ খেলা লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়েছিল।
যথাসময়ে খেলা শুরু হলো। কিন্তু শুরু থেকেই আর্জেন্টিনা আমাদের টিমকে কোণঠাসা করে রাখলো। আমি ঘামছিলাম- এই বুঝি আমাদের টিম গোল খেয়ে গেল। আমরা হাফ মাঠ পেরিয়ে একবারও ওদের দিকে অ্যাটাকে যেতে পারছিলাম না। এমন সময় পুরো মাঠ সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল – ২২ মিনিটের মাথায় বাংলাদেশ ১ম গোল খেয়ে বসলো। একি হায়, ঠিক এর ৩ মিনিটের মাথায় ২য় গোল, আরও ৫ মিনিটের মাথায় ৩য় গোল এবং হাফ টাইম যখন শেষ হলো, তখন আমরা ৮ গোল খেয়ে বসে আছি। গ্যালারির দর্শকরা লজ্জায়, ক্ষোভে, দুঃখে গালিগালাজ শুরু করে দিয়েছে।
সেকেন্ড হাফ শুরু করার পর আমাদের খেলোয়াড়রা নেতিয়ে গেলো। মাত্র ৭ মিনিটে তারা আরো ৩টি গোল খেয়ে মোট ১১ গোলে পেট ভরে ফেললো।
এই সময়ে হয়ে মরে যেতে হয়, অথবা জীবন পণ রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। আমি দ্রুত রেডি হয়ে কোচ এবং ক্রীড়ামন্ত্রীকে বললাম, আমাকে প্লিজ অনুমতি দিন। আমি মাঠে নামবো। তারা বোধহয় আমার এ কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে অনুমতি দেয়া মাত্র আমি বদলি খেলোয়াড় হিসাবে মাঠে নামি, আর পুরো স্টেডিয়াম যেন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ে আমাকে ওয়েলকাম জানালো।
আমার শরীরে যেন কিছুই হয় নাই, অতীতের যে-কোনো সময়ের চাইতে হালকা ও ফিট। আমি বাতাসের বেগে উড়ে চলি। আমার পায়ে বল এলে কেউ আটকে রাখতে পারছে না। ঠিক আড়াই মিনিটের মাথায় আমি আর্জেন্টিনার গোল কিপারকে তাজ্জব করে দিয়ে জালে বল ঢুকিয়ে দিই। পুরো গ্যালারি যেন ফেটে পড়লো। বাংলাদেশ-১, আর্জেন্টিনা ১১। ২য় গোলটা আমি বানিয়ে দিই এবং তমাল সেটা গোল করে। তাও ৭ মিনিটের মাথায়। ৩য় গোলটাও আমি বানিয়ে দিই, এবং সেটি গোল করে জহির নামক একটা ছেলে।
ইতিমধ্যে আর্জেন্টিনার টিম আউলিয়ে গেছে। পাঠক, আপনারাও চূড়ান্ত ফল কী হয়েছিল বুঝে গেছেন। হ্যাঁ, আমরা এরপর একে একে ৭টা গোল করি, যার মধ্যে আমার বানানো ছিল ২টা, আর আমি নিজে করেছি ৪টা। খেলা শেষ হতে আর মাত্র ৩ মিনিট বাকি আছে। স্কোর লাইন বাংলাদেশ ১০, আর্জেন্টিনা-১১। আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছি আরেকটা গোল দিয়ে অন্তত ড্র করতে, ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের ভুলের কারণে আমরা ১টা গোল খেয়ে বসি, পুরো স্টেডিয়াম হতবাক। হতবাক আমাদের প্লেয়াররা। কিন্তু আমি দমে যাবার ছেলে নই।
খেলার নির্দিষ্ট সময় শেষ। ইনজুরি টাইম দেয়া হয়েছে ৪ মিনিট। জীবন মরণ পণ করে আমি বল নিয়ে ছুটতে থাকলাম। ঝড়ের বেগে ছুটছি। সবাইকে কাটিয়ে, চোখ ফাঁকি দিয়ে ডি-এর প্রায় ১৫ গজ বাইরে থেকে লং শট একটা নিলাম- গোল। গোল। আমি দ্রুত দৌড়ে গিয়ে বল সেন্টারে এনে বসাই। ওরা একটু টাইম লস করতে চাইছিল। মেক্সিকান রেফারি ওদের ওয়ার্নিং দেয়ায় জলদি খেলা শুরু করে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে ভোঁ দৌড় দিই গোলপোস্টের দিকে। আগের শটের ঠিক রিপিট শট করি, আর জাদুকরি শটে গোল হয়ে যায়। ব্যস, স্কোর এখন লেভেলে। ১২-১২। আন্দাজ করি আর হয়ত ১ মিনিট, বড়োজোর দেড় মিনিট সময় বাকি আছে। আপনারা যারা সেই সময়ে স্যাটেলাইটে খেলাটা দেখেছিলেন, কিংবা পরে যারা রেকর্ডেড খেলা দেখেছেন, কিংবা খবরে বা রেকর্ডবুকে পড়েছেন, তারা জানেন, সেই দেড় মিনিট সময়ে আমি দুইটা গোল দিয়ে বাংলাদেশকে এক অভূতপূর্ব, ঐতিহাসিক জয় উপহার দিয়েছিলাম। সারা স্টেডিয়াম, সারা দেশ আনন্দে টগবগ টগবগ করে ফুটছিল। আনন্দের জোয়ারে সারা দেশ ভেসে যাচ্ছিল। সেই খেলাটা, বিশেষ করে আমার পায়ের জাদু দেখে সারা বিশ্ব এতই মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিল যে, খেলাটা একমাস ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে অনেকগুলো দেশে দেখানো হয়েছিল।
গ্যালারি থেকে দর্শকরা তারের বেড়া ভেঙে মাঠে নেমে এসেছিল। আমাকে কাঁধে নিয়ে পুরো ঢাকা শহর ঘুরে বেরিয়েছিল। সারা শহরের মানুষ আমাকে একনজর দেখার জন্য জোয়ারের পানির মতো রাস্তায় নেমে এসেছিল। মেয়েরা রাস্তার দু পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মতো ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছিল আমার শরীরে। এই পর্যায়ে এসে বান্ধবীকে গল্পটা পড়তে দিই। বান্ধবী পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠে বলেন- বাব্বাহ, টকশো দেখতে দেখতে তো দেখি ভালোই চাপা মারার ওস্তাদ হইয়া গেছো। আমি আর কী বলবো - চাপা ছাড়া কি দুনিয়া চলে? চাপা না মারলে তুমি বুঝবে কীভাবে আমার চাপার জোর কত? তারপর বান্ধবীকে বলি, শোনো, আমি চাপা মারি নাই। আমি একটা গল্প বলেছি মাত্র। সবাই এরকম গল্পই বলে, যেগুলো বানোয়াট, ভিত্তিহীন, কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গল্পকার নিজে জেনেশুনেই এসব গল্প বলে থাকেন। এ থেকে কিছু মানুষ ভাববে, বাপ রে বাপ, উনি দেখি কত বড়ো পালোয়ান! না জানি কত বড়ো কামেল লোক উনি। কেউ কেউ বাসায় ইঁদুর আর তেলাপোকা মাইরা বেড়ায়- আর ফুটানি মারে- মানুষ আমারে জেমস বন্ড বলে - মানুষ তো আর খামাখা জেমস বন্ড বলে না আমারে। হাহাহা, ঐ হালা ফুডাইন্যায় মনে করে সবাই ওর মতো ভোদাই, ওর ফুডাইন্যাগিরি বুঝি কেউ ধরবার পারে না। কেউ কেউ তৈলবাজি কইরা, মোটা অংকের ঘুষ দিয়া এখানে ওখানে বড়ো চাকরি ধরে, সম্মানের পদ কেড়ে নেয়। তারপর দেখা যায়, তারা সাক্ষাৎ বজ্জাতের হাড্ডি, না তাদের আচরণ ভালো, না জানে কোনো সামাজিকতা; মানুষের পায়ে পাড়া দিয়া করে ঝগড়া, আর কথায় কথায় ফুডানি মারায়, আমি এইডা, আমি ঐডা। ঐ বজ্জাতগুলো নাকি আবার মানুষ গড়ারও কাজ করে। কীভাবে সম্ভব? এগুলো দেখার কি কেউ নাই? শুদ্ধি অভিযান চালাইয়া প্রতিষ্ঠানরে পবিত্র করে না কেন কেউ? ঘুষের টাকায় পাহাড় বানাইয়া, গোপনে প্রকাশ্যে আকাম-কুকাম কইরা চাপা মারে- আমি নিজেরে পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ মনে করি। এই হালার পুতগো ধইরা ধইরা কান টাইন্যা ছিড়া দিতে হবে। গল্প করবি কর, একটু রইয়া সইয়া কর, যাতে মানুষ অন্তত বিশ্বাস করবার পারে এমন গল্প কর। কথায় কথায় কেন এত নিজের ঢোল পিডাইতে হবে? দ্যাশে কি তুমি ছাড়া আর কোনো পণ্ডিত নাই মনে করো? আমি ফেডাপ হইয়া গেলাম – যার সাথেই একটু পরিচয় হয়, তার জ্ঞানের ভাণ্ডার কয় গ্যালাক্সির সমান, তার পদের ওজন কত টন, তার সাহসের পরিমাণ হিমালয়ের চাইতে কয় ফুট উঁচু, এই বুলি দিয়াই বক্তব্য শুরু করে। দম্ভ আর অহঙ্কারে কেউ মাটিতে পাড়া দিতে চায় না। বংশের মর্যাদা, ক্ষমতার দাপট দেখাইয়া সবকিছু ভাইঙা চুইরা চুরমার কইরা দিতে চায়। কেউ কেউ নিজেরে মুক্তিযোদ্ধা দাবি কইরা বড়ো পদ দখল করে, প্রোমোশন পায়, পরে আবিষ্কৃত হয়, তেনারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নিয়াও চাপা মারতে হবে, মিথ্যা বলতে হবে? অনেকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কই করেছেন, কার সাথে করেছেন, কবে করেছেন, তার কোনো তথ্য তার জানা নাই। তাদের আচরণ হলো অসামাজিক, মানুষের সাথে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে অন্যকে সম্মান দিতে হয়, তা তাদের আচরণে নাই। আমার বিশ্বাস, তারাও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এদের কাজ কারবার দেখে কতক্ষণ স্থির, শান্ত থাকা যায়। তাই, এই মিথ্যা চাপাবাজদের উদ্দেশ্যে বলছি- ওরে বাটপার, ওরে ছিটার, এই হনু, ঐ হনু, কত কিছু হনু- তোদের এই বুলি বন্ধ কর এবং এই ‘কী হনুরে’ তোদের ঘরের কাঁথার নীচে ঢুকাইয়া রাখ। এইখানে এইগুলা ফুডাইবার কইছে কেডা? এইডা কি ফুডানি দেখাইবার জায়গা?
২২ এপ্রিল ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:২৯