আমি এ গল্পটি আমার ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট আবদুল করিমের কাছ থেকে শুনেছি। গল্পটি আমাদের স্কুলজীবনের অন্য দুই ক্লাসমেটকে নিয়ে। গল্পটি সত্য। আমাদের বেশিরভাগ ক্লাসমেটই সে-সময়ে গল্পটি জানতো। কিন্তু এসএসসি পাশের পর আমাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল বলে গল্পটি আমি অনেক পরে করিমের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম।
সামসু আর বাদল গল্পের দুই নায়ক। সুশ্রী নায়িকা চরিত্রে ছিল পাশের গ্রামের এক মেয়ে। তার নাম বকুল। বকুল ফুলের মতো স্নিগ্ধ তার রূপ, দশ গেরামের সেরা সুন্দরী বকুল।
বকুলের বড়োবোনকে বিয়ে করেছে সামসুর বড়ো ভাই। অর্থাৎ, সামসু আর বকুল ছিল বেয়াই আর বেয়াইন। রসিকতার সম্পর্ক। রসিকতা করতে করতেই দুজনের মধ্যে মন বিনিময়ও হয়ে গেল। দশ গেরামের ঝাড়া সুন্দরী হওয়ায় বকুল ছিল সকল যুবকের স্বপ্নের নায়িকা। সকলেই একটু সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো বুকল ফুলের তাজা গন্ধ ও স্পর্শের জন্য। কিন্তু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সুবাদে সামসু আর বকুলই শেষ পর্যন্ত প্রেমের জুটি বাঁধতে সমর্থ হলো।
শুধু সেরা সুন্দরীই না, নামকরা গার্লস স্কুলের সেরা ছাত্রীও বকুল। বকুল স্কুলে যায়, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে। সামসু চলার পথে বকুলকে গার্ড দেয়, চলার পথে প্রেমও করে। জীবনটা রোমাঞ্চে ভরে ওঠে দুজনেরই।
একদা জীবিকা নির্বাহের জন্য মাঝপথে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে সামসু মিডল ইস্টে পাড়ি জমালো। বিদেশে যাওয়ার আগে প্রিয়তমা বকুলকে কোনো একজনের পাহারায় জিম্মা রেখে যেতে হবে। কে সে? সে হলো সামসুর প্রাণাধিক প্রিয়বন্ধু, যাকে সে সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন মনে করে- বাদল। বাদল, সামসুকে অভয় দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিল। বাদল জীবিত থাকতে বকুলের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাবে- সেই চোখ কাঁচি দিয়ে উপড়ে ফেলবে না? নিজের জীবন দিয়ে হলেও বন্ধুর প্রেমিকাকে রক্ষা করবো। এমনই কিছু নাটকীয় ডায়ালগে সামসুকে আশ্বস্ত করলে খুশিমনে সামসু বিদেশে চলে গেল।
বিদেশে বসে সামসু প্রতি সপ্তাহে বকুলের দুটি করে চিঠি পায়। খুব ভালো লাগে। মন হয় চাঙ্গা। প্রাণোচ্ছলতায় ভরপুর মন নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দিন গোনে, কবে সে বেশ বড়োসড়ো একটা সঞ্চয় নিয়ে দেশে ফিরে আসবে, প্রিয়তমা প্রেমিকাকে প্রিয়তমা স্ত্রী হিসাবে ঘরে তুলে নেবে।
আপনারা যা অনুমান করছিলেন এ গল্পের শুরু থেকে, মাস ছয়েক পর ঠিক তাই হয়ে গেল। বকুল চিঠি লেখা বন্ধ করে দিল। এটা সেই সময়ের কথা যখন পৃথিবীতে মোবাইল ফোনের আবিষ্কার হয় নি। বিদেশ থেকে গ্রামগঞ্জের বাড়িতে ল্যান্ডফোনে কথা বলা ছিল স্বপ্নেরও অনেক অতীত।
ব্যতিক্রমী কিছুই হলো না, সবই স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে গেল।
সামসু বিদেশ থেকে আসার আগেই জানতে পারলো বাদলের সাথে বকুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। প্রিয়বন্ধু সামসু তার প্রিয়তমা প্রেমিকাকে তার জিম্মায় রেখে গেছে, বাদল খুবই বিশ্বস্ততার সাথে অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করতো, আর বকুলকে সে সবসময় চোখে চোখে রাখতো, পাহারা দিত। বকুল স্কুলে যেত, সাথে পাহারায় থাকতো বাদল। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতো, পাহারায় থাকতো বাদল। কিছুদিন পর বাদল ভাবলো, পরের জিনিস এত কষ্ট করে পাহারা দিচ্ছি কেন? আমি নিজেই তো এ জিনিস নিজের করে নিতে পারি। বকুলও তাই ভাবছিল। ব্যস- দুজনে দুজনার হয়ে গেল অনায়াসে।
একটু চটুল গ্রামীণ প্রবাদ আছে - শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়া। আমাদের প্রিয়বন্ধু সামসু, আমাদের আরেক প্রিয়বন্ধু বাদলের কাছে নিজের প্রেমিকাকে গচ্ছিত রেখে যায় নি, আসলে সে শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিয়েছিল, আর স্বাভাবিক ভাবেই সেই মুরগি খোয়া গেল। এটা পৃথিবীর কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, ব্যতিক্রমী ঘটনা হতো সেটাই, যদি সামসু তার প্রেয়সীকে বাদলের কাছ থেকে সুরক্ষিত অবস্থায় ফেরত পেত।
দেশে ফিরে এসে অনেকদিন পর্যন্ত সামসু দিওয়ানা ছিল, তারপর বিয়েশাদি করে নতুন জীবন শুরু করেছিল।
আমাদের আরেক প্রিয়বন্ধু আবুল কালাম শেরখান এ ঘটনায় একটা তথ্য যোগ করে বলেছিল, সেবার বকুল প্রাইজ বন্ডের ফার্স্ট প্রাইজ হিসাবে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিল। সেটা ৮০’র দশক। সে আমলে ৫০ হাজার টাকা একটা বিরাট অংক, আপনারা জানেন। বাদলের নজর পড়ে বকুলের ৫০ হাজার টাকার প্রাইজ বন্ডের উপর। এ টাকাও তাকে আরো অনেক লোভাতুর করে তুলেছিল বকুলকে পাওয়ার জন্য।
সামসু আজও আমাদের অনেক প্রিয়বন্ধু। স্কুলজীবনে যতখানি প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল ছিল, বকুলকে হারানোর ধকল ও বেদনা কাটিয়ে উঠে সে আগের মতোই উচ্ছলতায় ভরপুর, সংসারী হয়েছে, একজন ভালো স্বামী হিসাবেও নিজেকে গড়ে তুলেছে। কিন্তু বাদল এই বেইমানির দ্বারা আমাদের সবার কাছ থেকে চিরতরে দূরে সরে গেল- আমরা কেউ কোনোদিনই খোঁজ নিই না, বাদল কেমন আছে। এটাই ওর শাস্তি।
তবে, যদিও আমাদের ক্লাসমেট বাদলকে আমরা কালপ্রিট হিসাবে সাব্যস্ত করছি, কিন্তু মেয়েটাও কি সমান দোষে দোষী নয়? বাদল যেমন সামসুর আমানতের খেয়ানত করেছে, মেয়েটাও কি তার প্রথম ও মূল প্রেমিকের সাথে বেইমানি করে নি? আমি জানতে পারি নি, ঠগ এবং লোভী বাদলের কাছে বকুল প্রকৃতই সুখী হতে পেরেছিল কিনা, কিন্তু একটা বিষয় সহজেই অনুমান করা যায়। বকুল যখন দেখলো, বাদলের বন্ধুরা সবাই বাদলকে প্রত্যাখ্যান করে দূরে সরে গেছে, এটা নিশ্চয়ই তার মনকে দগ্ধ করেছে। তার মেয়েবান্ধবীরাও এটাকে সহজ ভাবে মেনে নেয়ার কথা না। অতএব, আমরা বলতে পারি, বাদলকে হারিয়ে সামসু যতখানি আঘাত পেয়েছিল, বাদলের বিশ্বাসঘাতকতা তাকে যতখানি মর্মবেদনা দিয়েছিল, তার বিনিময়ে বাদল ও বকুল দুজনেই প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসাবে আজীবন মানসিক শাস্তি ভোগ করে আসছে, যা আগামীতেও তাদের মনকে কুরে কুরে দগ্ধ করতে থাকবে।
সামসুরও একটা দোষ ছিল এক জায়গায় – সে ভুলে গিয়েছিল যে, শেয়ালের কাছে কখনো মুরগি বর্গা দিতে নাই।
অফ টপিক : আবদুল করিম আর আবুল কালাম শেরখান নামদুটি ছাড়া বাকি নামগুলো কাল্পনিক।
২৩ আগস্ট ২০১৪
পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত : রাত ১১ঃ৩৯ ঘটিকা, ০৭ অক্টোবর ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১১:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




