বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হলো। এবার আমাদের মন-মানসিকতাকে সুস্থ করার পালা।
ভিন্ন কোনো দেশকে সাপোর্ট করতে যেয়ে যখন এ দেশের ১২টি প্রাণ নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করে খুইয়ে বসে, আরো ২৭টি বা ততোধিক প্রাণ গুরুতর আহত হয়, জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জিত, বিব্রত হওয়া উচিত, নাকি আরো উৎফুল্ল হওয়া উচিত, সেটা আমাদের খতিয়ে দেখা অতি জরুরি।
আমার মতে, জাতি হিসাবে আমরা খুব একটা সুস্থ নই। একটা ভিন্ন দেশের কাপ জেতায় এভাবে লাফানো, তাদের দেশের বিরাটাকার পতাকা নিয়া মিছিল করা পুরাই একটা অস্বাভাবিকতার লক্ষণ। এর চাইতে অধিক আদিখ্যেতা আর কিছু হতে পারে
যে কখনো খেলাই দেখে না, সেও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জন্য পাগল, যে কালেভদ্রে একটা দু-দুটো ম্যাচ দেখে, সেও পাগল। যে-কোনোদিন মেসিকে বল নিয়ে দৌড় দিতে দেখলো না, অর্থাৎ, যে-কখনো খেলা দেখার সুযোগও পেলো না, সেও যখন বলে - মেসি অতিমানবীয় কিছু, ফুটবলের চাইতেও অধিক- তখন তাকে কী বলবেন? বস্তুত, কোনো মানবই অতিমানবীয় কিছু না। তারা আদৌ কোনো ঈশ্বর নন। মেসিও না, ম্যারাডোনা বা পেলেও না, নেইমার বা রোনাল্ডোও না। মেসির চাইতেও অধিক গোল করা খেলোয়াড় আছে। একই টুর্নামেন্টে একই ফাইনালে এমবাপ্পেই মেসির চাইতে বেশি গোল দিয়েছে। মেসি অতিমানবীয় কিছু হলে তার দলে অন্য খেলোয়াড়ের প্রয়োজন পড়তো না, একাই খেলতো, একাই জিততো। কথাগুলো বলছি কাউকে খাটো করার জন্য না, বলছি আপনাদেরকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য ও আবেগকে সংযত করার জন্য। মেসি আমারও প্রিয় খেলোয়াড়। তবে, আমি আবেগে অন্ধ না। রোনাল্ডো, বাপ্পে, পেলেও আমার প্রিয় খেলোয়াড়। কিন্তু আমি কখনো এটা বলবো না, তারা মহামানব শ্রেণির অন্তর্গত। তারা খেলোয়াড়, স্রেফ খেলোয়াড়। যখনই আপনি মেসিকে এরকম অতিমানবীয় কিছু আখ্যা দিতে যাচ্ছেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার প্রতিপক্ষও এমবাপ্পে, নেইমার, রোনাল্ডোকে মেসির চাইতেও অধিক উচ্চতার কোনো মহামানব বানিয়ে ফেলছেন। তখনই শুরু হচ্ছে আপনাদের মধ্যে মল্লযুদ্ধ। এ যুদ্ধের বার্তা আপনি থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পরিণতি হয় ভয়াবহ প্রাণনাশ। যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করা নিয়ে এ দেশে যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান! কী বিচিত্র আমাদের সোনার বাংলা। খেলাধুলা আর সুস্থ বিনোদনের মধ্যে সীমিত নেই। কী শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত, সবাই এ দুদলকে সাপোর্ট করা নিয়ে উত্তেজনার শীর্ষে উঠে বসে থাকেন! কী বিচিত্র আমাদের সোনার বাংলা আর তার সোনার সাপোর্টাররা! একটা ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, চৌদ্দগ্রামে প্রশাসন থেকে যখন মাইকিং করে বলা হচ্ছে, ব্রাজিল সমর্থকরা কেউ বাইরে বের হবেন না, আর্জেন্টিনার সাপোর্টাররা আপনাদের মারধোর করলে আমাদের কিছু করার থাকবে না। হয়ত এ ভিডিওটা ফেইক। কিন্তু এ থেকেও আমাদের সামাজিক অসুস্থতার এটা একটা নিকৃষ্ট দিক বেরিয়ে আসে। নইলে এরকম ফেইক ভিডিও তৈরি করে ছড়িয়ে দেব কেন? অবশ্য আমি নিশ্চিত নই, এটা ফেইক কিনা, তবে অনেকের কাছেই জানতে পেলাম ওটা ফেইক। যারা ওটা বানিয়েছেন, তাদেরকে আইডেন্টিফাই করে শীঘ্র আইনের আওতায় আনা উচিত।
ব্রাজিল হারার পর যেদিন আর্জেন্টিনা পরের রাউন্ডে উঠলো, ঐদিনই বিভিন্ন জায়গায় খবর উঠলো, ব্রাজিল সাপোর্টাররা আর্জেন্টিনার সাপোর্টারদের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। কী বিচিত্র আমাদের দেশ। আমাদের দেশের দুই বিবদমান রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডকেও হার মানাইয়া দিল!!
এসব অস্বাভাবিকতাকে কখনো সায় বা সাপোর্ট দেয়া যাবে না। এগুলো বন্ধের জন্য ক্যাম্পেইন করার দায়িত্ব আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির উপরই বর্তায়। যারা এই গণ শ্রেণির সাপোর্টার, তাদের বড়ো অংশই সুন্নী সাপোর্টার। খেলা দেখার সময় পান না অনেকেই, বা খেলা তেমন একটা বোঝেনও না অনেকে। শুধু হুজুগে সাপোর্ট করেন আর সদল বলে প্রতিপক্ষকে ট্রল করার আনন্দে মেতে ওঠেন।
এই যে চিৎকার করে বলে ওঠেন - ইয়াহু, আলহামদুলিল্লাহ, জিতে গেছি - এটা আপনার অসুস্থ মানসিকতার চূড়ান্ত রূপ। আপনি জিতেন নি, জিতেছে অন্য একটা দেশ। অন্য একটা দেশকে নিয়ে এভাবে লম্ফঝম্ফ করাই হলো অস্বাভাবিকতা। এ ব্যাপারটা কোনো একটা সময় পর্যন্ত সিদ্ধ ছিল। কিন্তু আপনি এভাবে চিৎকার করে উঠছেন তাতে জেতার আনন্দের চাইতেও আপনার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার আনন্দ বেশি। আর্জেন্টিনা হেরে গেলে ব্রাজিল সাপোর্টাররা আনন্দে অস্থির, তেমনি, ব্রাজিল হেরে গেলে আর্জেন্টিনা সাপোর্টররা আনন্দে উন্মাতাল হয়ে যান। কী জঘন্য মানসিক অবস্থা আমাদের! এটা কখনোই কোনো সুস্থ বিনোদনের প্রকাশ হতে পারে না।
আমাদের দেশে খেলাধুলা সাপোর্ট করা হয়ে গেছে কোনো রাজনৈতিক দল করার মতো - আমি অমুক দল করি, সারাজীবন নীতিগতভাবে আমাকে সেই দলই করতে হবে। অথচ, খেলাধুলা সাপোর্ট করা এরকম না। সাপোর্ট করার জন্য আমার কোনো নির্দিষ্ট দল যে থাকতেই হবে, ব্যাপারটা তা না। এটা হলো সঙ্গীত বা সাহিত্যের মতো। যার যে গানটা আপনার ভালো লাগে, আপনি সেই গানটা শোনেন, বার বার শোনেন। যে কবিতাটা আপনার ভালো লাগে, ওটা বার বার পড়েন। তেমনি, যে খেলাটা আপনার ভালো লাগবে, আপনি ঐ খেলাটা প্রাণ ভরে উপভোগ করবেন। আমাদের সাপোর্ট হতে হবে এরকম। খেলাধুলার দলকে সাপোর্ট করা কোনো রাজনৈতিক দল করা না যে আমার সাপোর্ট বদল হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের সাপোর্টাররা এতই মৌলবাদী যে সাপোর্ট চেঞ্জ করা নিয়েও ট্রল, রেষারেষি, মারামারি হয়। কেন? সুস্থ মানুষের মন সাপোর্ট দেয় ভালো খেলা ও খেলোয়াড়কে। আমরা সেটা পারি না। কারণ, আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক নই, অসুস্থতা আমাদের পেয়ে বসেছে।
আমরা যে হারে মাতামাতি করি, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, পর্তুগাল নিজেদেরব দেশেও এত পাগলামি করে বলে মনে হয় না। আমরা করি, তার কারণ, আমাদের অসুস্থতা ও হীনমন্যতা। আর এই যে সমগ্র বাংলা ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার সমর্থক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে গেছে, এ নিয়ে গর্ব করে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা হলো হীনমন্যতা ও নিজেদের অপমান বা ছোটো করার আরেকটা ক্ষেত্র। তাদেরকে দেখানো, সারা বিশ্বে একমাত্র আমরাই সমগ্র জাতি একসাথে সাপোর্ট করছি। আদিখ্যেতার একটা সীমা অবশ্যই থাকা উচিত।
এ অবস্থা থেকে আমাদের শীঘ্র বেরিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে কিছু জিনিস নিষিদ্ধ করতে হবে, যেমন :
১। এ দেশে অন্য দেশের পতাকা ব্যবহার করা যাবে না। ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা শেষ হলেই দেখা যায় বিশাল আকৃতির পতাকা নিয়ে পথে বের হয়েছে। যেন বাংলাদেশ জিতেছে, আর বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা তারা। এই মিছিল-শোভাযাত্রা হলো মারামারি লাগার মোক্ষম অবস্থা। এগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
২। সেন্ট্রালি বড়ো পর্দায় খেলা দেখার ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। ঝগড়া লাগার এটা হলো আরেকটা বড়ো উৎস।
৩। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতিপক্ষকে নিয়ে ট্রল করা, বিদ্রূপ করা, গালিগালাজ করার বিষয়টি আইনের আওতায় আনা উচিত। তেমনি, মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো বন্দনা বন্ধ করতে হবে। এই বন্দনাগীত থেকে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ।
৪। আমাদের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে নিয়ে অনেক বেশি মাতামাতি হয়। সেগুলোও বন্ধ করতে হবে। এ দুদলকে সাপোর্ট করা নিয়ে নাটক নির্মাণ করা হয়। সেগুলোও বন্ধ করতে হবে।
সবার আগে আমাদের নিজেদের সংশোধন হতে হবে, অন্যদেরকে সুপথে ফিরে আসতে সাহায্য করতে হবে।
শুভ কামনা সবার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:০৭