(১৯৮৬ সাল। ঢাকা কলেজ, ১০১ নম্বর উত্তর ছাত্রাবাস। একজন টোকাই প্রতিদিন আমাদের হোস্টেলের সামনে ময়লা কুড়াতো, ডাস্টবিনে খাবার খুঁটতো)
প্রতিদিন হোস্টেলের বারান্দায়
কুড়োয় সে কাগজ। কখনো চেটে খায়
কাগজে লেগে থাকা উচ্ছিষ্ট সালুন কিংবা হালুয়া।
কখনো-বা নর্দমায় ফেলে দেওয়া
পঁচা রুটি কুড়িয়ে সে খায়, যদি পায়।
নোংরা-ইতর বলে থুথু ফেলি আমরা তার গায়।
তবু সে প্রতিদিন আসে
আমাদের হোস্টেলের বারান্দার পাশে।
কাঁধের ওপর দিয়ে তার
পিঠে ঝোলে বাম হাতে মুঠিচাপা চটের ঝুলি। বার বার
উবু হয়ে একটি একটি করে
কাগজ কুড়িয়ে ঝুলির ভেতরে
সে পুরে রাখে।
ঝুলিটার আস্তে আস্তে বুক ফুলে উঠতে থাকে।
তখন তার চোখ দেখে মনে হয়,
এক ঝুলি কাগজেই এ টোকাই একান্ত বিশ্বকে করবে জয়।
কখনো রাতের তিন প্রহরে হোস্টেলে ফিরি-
সামনে একধাপ সিঁড়ি
এবং তার নীচেই আধখণ্ড
ইটে মাথা রেখে তীব্র শীতে কিংবা মশার প্রচণ্ড
উৎপাতেও শুধু প্রাণপ্রিয় ঝুলিটাকে গায়ে জড়িয়ে
টোকাইকে দেখি কেমন নিশ্চিন্তে আছে ঘুমিয়ে।
কখনো সিঁড়ির ধারে, কখনো-বা বিরান ফুটপাতে
এমনি দেখেছি তাকে অজস্র রাত-বিরাতে-
এমনি সে বেঁচে আছে, এমনি সে রাত্রি কাটায়।
এ অনাথ কিশোর জানে, এ ধরায়
সে একা, লোকারণ্য এ বিশাল পৃথিবীতে
তার কেউ নেই একবিন্দু স্নেহস্পর্শ দিতে।
তবুও সে বাঁচতে চায় পথে পথে কাগজ কুড়িয়ে আর
ডাস্টবিনে খুঁটে খুঁটে আমাদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার ।
এমনি সময় চলে গেছে, এমনি সময় চলে যায়, তবুও কারো
একটুও সময় যেন নেই কিঞ্চিৎ ভাববার-
জ্বরাক্লিষ্ট, নামগোত্রহীন এ বালকেরও সাধ আছে পৃথিবীতে বাঁচবার।
এমনি কেটে গেছে বহুকাল,
পৃথিবীর সভ্যতার আজও সে পায় নি নাগাল।
তবুও মনে হয়,
সুনিশ্চিত একদিন আসবেই সময় :
হয়ত কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে,
কিংবা ১৬ই ডিসেম্বরে,
কিংবা ধরুন কোনো এক ২৬শে মার্চের উজ্জ্বল সকালে
জেগে উঠবেন উদ্ভাসিত, সহৃদয় একজন,
শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়াবেন তিনি, বুকে রাখবেন হাত,
তারপর করবেন দৃঢ় উচ্চারণ :
এ আমার অঙ্গীকার- ডাস্টবিন হতে
অসহায় এ শিশুকে তুলে আমি আনবো রাজপথে,
আমার শিশুদের সাথে
একপাতে
তাকেও তুলে দেব সুষম খাবার;
তার
ছেঁড়া কাগজের ঝুলিটাকে ফেলে সুর্য-খচিত ঐ হাতে
তুলে দেব একটি বই, জীবনের কুসুম ফোটাতে।
• ১৯৮৬
ফুটনোট
কবিতা পড়েই কবিতার পটভূমিকা বোঝা যায়। তবুও বলছি, তখন কলেজে পড়ি। ২য় বর্ষে। ঢাকা কলেজ, উত্তর ছাত্রাবাস, ১৯৮৬ সাল। একটা ছেলেকে (টোকাই) দেখতাম, প্রায় প্রতিদিনই হোস্টেলের চারপাশে কাগজের টুকরো, নাস্তার ঠোঙা, আরো কত কী কুড়াতো। যে-সময়ে বইখাতা হাতে তার স্কুলে যাওয়ার কথা, সে-সময়ে সে এ দরিদ্র-কাজগুলো করতো। এ ছেলেটা শুধু একটা উদাহরণ। এমনি কতশত কিশোর, শিশু ঢাকা শহরসহ সারাদেশের আনাচে-কানাচে বেঁচে থাকার সংগ্রামে কঠোর ও নিঠুর জীবন টেনে যাচ্ছে। সেদিন যা ছিল, আজ কি তা থেকে কোনো উন্নতি ঘটেছে? ঢাকা শহরে কি টোকাইদের সংখ্যা কিছু কমেছে, নাকি তার থেকে ২০ গুণ বেড়েছে? টোকাই, ভিক্ষুকসহ দরিদ্র এ গোষ্ঠীর ভবিষ্যত কী? ভাবলে অস্থির হতে হয়। তবু মন বলে, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া এ দেশে একদিন কোনো টোকাই থাকবে না, ভিক্ষুকও থাকবে না। তাদের জন্য সুপরিকল্পিত পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এমন একটি দিনের শুভ সূচনা হতে পারে ২১শে ফেব্রুয়ারির মতো যে-কোনো মহান দিবসের সূর্যোদয়ের লগ্নেই। সে প্রত্যয়ে এ কবিতাটি পোস্ট করা হলো। এটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত আমার 'অন্বেষা' কাব্যের অন্তর্গত।)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




