somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পান্তাভাত

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধানমন্ডি স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টের ভিতর-বাহির পুরোটাই বেশ ছিমছাম। রাকুল রিকশা থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের বাইরের একটা খালি টেবিলে বসে পড়লো।

সুন্দর, নিরিবিলি একটা বিকেল। প্রতি উইকএন্ডেই অফিস থেকে ফেরার পথে এখানে থামে রাকুল। এখানকার শিক কাবাব এ শহরের সেরা। পরোটাও সেরা; নরম এবং একটু মচমচে, অন্যান্য রেস্টুরেন্টের পরোটার চাইতে আলাদা।
রাকুলের খুব ভালো লাগছে নরম রোদে রাঙানো হাসি ঝলমলে বিকেলটা। কয়েকটা টেবিলে যুবক-যুবতীরা জোড়ায় জোড়ায় বসেছে, কোথাও ছেলেমেয়েসহ দম্পতিরা। রাকুলেরও এমন রঙিন দিন সামনে ঘনিয়ে আসছে, রাকুল মনে মনে ভাবে।
রেস্টুরেন্টের ভিতরে একটু জটলা বেশি মনে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর প্রচুর ভিড় হয় এখানে। রাকুলের টেবিলটাই শেষ খালি টেবিল ছিল; একটু পর হয়ত কেউ না কেউ এসে এ টেবিলেও ভাগ বসাবে।
ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেল। দুটো পরোটা, ১টা শিক-কাবাব। এদের কুকিং ভালো, উন্নত হাইজিন, ওয়েটারদের সার্ভিসও ভালো। তারপরও, ওয়েটারদেরকে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না রেখে শুরুতেই ওদের হাতে ৫০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দেয় রাকুল। ওয়েটাররা দ্বিগুণ উৎসাহে সার্ভ করতে থাকে।

আজকের কাবাবটা যেন অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই আলাদা এবং মজাদার। পরোটাটাও কম যায় না। রাশান সালাদ অনন্য। টুকরো টুকরো করে পরোটা ছিঁড়ে সালাদ আর কাবাব দিয়ে মাখিয়ে খেতে থাকলো রাকুল।
এখানে খেতে বসলে মুহূর্তেই সে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। ভার্সিটি লাইফেও মাঝে মাঝে এখানে আসতো সেরিনাদের সাথে। সেরিনার মা-বাবা ওদের দু ভাইবোনকে নিয়ে প্রতিমাসে অন্তত দুদিন বাইরে লাঞ্চ বা ডিনার করতেন, এবং অন্তত একদিন তাদের সাথে রাকুল থাকতো। রাকুল সেরিনাকে পড়াতো। খুব ভালো ছাত্রী ছিল সেরিনা। ওরা দু ভাইবোন ওকে ‘ভাইয়া’ ডাকতো, আর সেরিনার মা-বাবা ওকে নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। ছাত্রজীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল রাকুলকে, নিজের টাকায় আজকের মতো এরকম বিলাসী খাবার খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেরিনার বাবা হাসান সাহেবের কাছে রাকুল চিরকৃতজ্ঞ। তিনি সেরিনাকে পড়ানো বাবদ কোনো ফিক্সড অ্যামাউন্ট দিতেন না, বরং হঠাৎ হঠাৎ জোর করে কিছু পকেট খরচও দিতেন, যদিও তা নিতে রাকুলের খুব লজ্জা হতো। বলতে গেলে পুরো ভার্সিটি লাইফই সে হাসান সাহেবের টাকায় পার করে দিয়েছিল।
হাসান সাহেব তাকে খুব উৎসাহ দিতেন পড়ালেখায়। রাকুল এমনিতেই মেধাবী, তার উৎসাহে সে আরো জ্বলে উঠতো। হাসান সাহেবই তাকে কর্মসংস্থানের নানান পথঘাট দেখিয়ে দিয়েছিলেন, যে-পথ ধরে হেঁটে রাকুলের আজকের এ উন্নত অবস্থানে আরোহণ। সে খুব খুশি এ কারণে যে, সে হাসান সাহেবের সততা ও একাগ্রতা নিজ জীবনে গ্রহণ করে তা বজায় রাখতে পারছে।

খাওয়াদাওয়া একেবারে শেষের দিকে। ইতিমধ্যে আরেকজন মধ্যবয়সী দম্পতি কোথাও খালি টেবিল না পেয়ে একটু ইতঃস্তত দাঁড়িয়ে থেকে ওর টেবিলেই যথাযথ সৌজন্য প্রদর্শন করে বসে পড়েছেন। রাকুল তাদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে ‘প্লিজ বসুন, সমস্যা নেই’ বলে চেয়ার একটু অ্যাডজাস্ট করে বসেছিল।
কাবাবের শেষ টুকরোটি অবশিষ্ট পরোটা দিয়ে ধরে সালাদ মাখিয়ে মুখে তুলতে তুলতে আনমনে বামদিকে তাকালো রাকুল, এমন সময় অদূরে একটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো নোংরা জামা পরা ময়লা চেহারার ৪/৫ বছরের শুকনো মেয়েটার দিকে চোখ যায় তার, সে কাবাবের টুকরোটি ওভাবেই ধরে রেখে কী ভেবে যেন মেয়েটাকে বলে বসলো, ‘খাবি?’ মনে হলো, কথাটা মুখ থেকে বের হওয়ার আগেই মেয়েটি এমন ভাবে ডান হাত বাড়িয়ে ছুটে আসতে লাগলো, যেন এতক্ষণ ধরে সে এই ‘খাবি?’ কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
রাকুল মুহূর্তের মধ্যে চলে গেল ওর ছোট্ট বেলায়। ওদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বাবা খুব কষ্ট করে যা আয় করতেন, তাতে ওদের দুবেলা পেট পুরে খাওয়া জুটতো না। একবেলা ভালো করে খেতে পারলেও আরেক বেলা হয় না খেয়ে অথবা আধপেট খেয়ে কাটাতে হতো।

একদিন সকালবেলা মাঠ থেকে গরুর ঘাস কেটে এনে বাসায় এসে খেতে বসেছে রাকুল। খিদেয় ওর পেট খুব জ্বলছিল। কিন্তু ওর জন্য মাত্র কয়েক লোকমা পান্তাভাত হাঁড়ির তলায় পড়েছিল, আর ছিল হাঁড়ির বুক পর্যন্ত পান্তাভাতের সাদাটে পানি। রাকুল সেই কয়েক লোকমা নরম পান্তাসহ হাঁড়ির সবটুকু পানি ঢেলে থালা ভরে ফেললো। এরপর একটা কাঁচামরিচ লবণ দিয়ে ডলে পেঁয়াজ দিয়ে খেতে থাকলো। মাত্র তো কয়েক লোকমা পান্তা। পুরো থালায় জালের মতো আঙুল দিয়ে ভাতগুলো ছেঁকে খেতে থাকলো; মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। পেটের খিদে যেন আরো দাও দাও করে জ্বলে উঠলো। পাতের পানিটুকু খেলেই হয়ত সেই আগুন সামান্য হলেও কমবে। সে দু হাতে থালা তুলে কেবল মুখের কাছে ধরেছে, অমনি ওর ছোটোবোন মালেকা, যে এতক্ষণ ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো ভাইয়ের খাওয়া দেখছিল, খুব করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ভাই, তুই কি পানিডা খাবি?’ রাকুল বোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ‘নে খা’ বলতেই মালেকা যেন ছোঁ মেরে ভাইয়ের হাত থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে দ্রুত ঢকঢক করে খেয়ে ফেলেছিল থালাভর্তি সবটুকু ভাতের পানি। পাতের পান্তাভাতের পানি কেউ এভাবে চায়? কিন্তু মালেকার খিদেটাও এত তীব্র ছিল যে, সে ভাইয়ের কাছে ঐ পানিটুকুও চেয়ে খেতে লজ্জা কিংবা কুণ্ঠাবোধ করে নি। রাকুলের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছিল। ওর ঘাড়ের সামান্য কাছেই বোনটা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তাকে একমুঠো পান্তা না সেধে ও পুরোটা কীভাবে সাবাড় করে ফেললো! এ দুঃখটা এখনো ওর বুকের ভিতর দগদগে ক্ষতের মতো জেগে আছে।

মেয়েটা ময়লা পোশাকে একেবারে ওর কাছে চলে এসেছে; হয়ত বাতাসে এক-আধটু উড়ে এসে ওর জামাটা রাকুলের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ধরে এসেছিল, এখন হাত নামিয়ে নিয়েছে, একটু বিব্রত ও আশাহত ভঙ্গিতে। হয়ত ভাবছে, আগে সাধলেও এখন আর হাতের টুকরোটি ওকে দেয়া হবে না। কিন্তু রাকুল হঠাৎ অতীতে মগ্ন হয়ে যাওয়ায় মুখের কাছে কাবাবের টুকরোটি স্থির স্ট্যাচুর মতো ধরে রেখেছিল।
মেয়েটা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে। রাকুল সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নিজেও একটু বিব্রত হয়। চারপাশে মানুষ। তার টেবিলে আরো একজোড়া নর-নারী। এত কাছে একটা মেয়েকে ডেকে এনে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, মানুষ হয়ত এখন ওর মানবিকতার চেয়ে নিষ্ঠুরতার দিকটাই দেখতে পাবে।
রাকুল ত্বরিত নিজেকে সামলে নেয় এবং পূর্বাপর কিছু না ভেবেই বলে ‘হাঁ কর তো’, মেয়েটাও খুব স্বাভাবিকভাবে সামান্য ঝুঁকে পড়ে মুখ হাঁ করে – তারপর কাবাবের টুকরোটি মেয়েটার মুখে ঢুকিয়ে দেয় রাকুল। মেয়েটা কি কখনো ভেবেছিল, এমন ‘সাহেবি’ পোশাকের কেউ ওকে এরকম কখনো-চেখে-না-দেখা কাবাবের একটুকরো মাংস নিজ হাতে ওর মুখে তুলে দিবে?
তারপর রাকুল কী করলো? ওর পাশে একটা খালি চেয়ার টেনে নিল, অনেক আদর করে মেয়েটাকে ওখানে বসালো, আর ওয়েটারকে আরো কাবাব আর পরোটার অর্ডার দিয়ে আনিয়ে মেয়েটাকে খাওয়াতে লাগলো, যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটা খেতে পারলো।

৮ আগস্ট ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×