somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃষ্টি-বিলাপ কিংবা মনোয়ারার দায় ও দায়মুক্তি ।

১৯ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। অকস্মাৎ সন্ধ্যা নেমেছিল বলে কোন কোনটার হেড লাইট ঘোলাটে আলোতে জ্বলে উঠছিল আর বৃষ্টির ছটা বিদ্রূপের মত কোন নিম্নমধ্যবিত্ত ত্বকে হুল ফুটিয়েছিল বলে গনপরিবহন গুলোতে ছড়াচ্ছিল অবিশ্বাস। পরশ্রীকাতর হতাশায় বাসের হেল্পার কোন গাড়িতে বসা যুবক-যুবতীর মাখামাখি প্রেমে অশ্লীল কিছু ইঙ্গিত করলে, বাসে বসে থাকা এক যুবক যার হাতে “স্পোকেন ইংলিশঃ ত্রিশ দিনে ভাষা শিখুন” বই, সে ছোটলোক বলে শাসায়, এবং সেও তাকিয়ে থাকতে থাকতে পরশ্রীকাতরতার সংক্রমণে অসহিষ্ণু বোধ করে আর হেল্পারটা তার দিকে তাকিয়ে জিতে যাবার হাসি হাসে এবং বৃষ্টি ঝরতে থাকে। শহরের ঘোলা আকাশ আর কাদাকাদা রাস্তায় ততক্ষণে জড়িয়ে গেছে স্থিতি। তাড়া থাকা মানুষগুলোর বুকে গুমোট ক্লান্তি। এতক্ষণ পায়জামা উঁচু করে হেঁটে যাওয়া মেয়েগুলো হাল ছেড়ে দেয় ফলে ঝুঁকে পরা মেরুদণ্ডগুলো স্বস্তি পায় এবং তাদের কারো কারো বুকে হেডলাইটগুলো কাটতি থাকা পত্রিকার হেডলাইনের মত মনোযোগ পায়।

বাস হেল্পারটার হতাশা কাটে সে হটাৎ বলে উঠে, “ওস্তাদ, আইজকা বাড়ি যাইতে যাইতে অনেক রাইত”- ড্রাইভার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করেনা, কিন্তু সে নড়েচড়ে বসে ।

এরকম বিশ্রী যানজট আর বিষণ্ণ শহুরে কাদা মাখা বর্ষায় জাভেদ হুসেইন তার গাড়িতে বসে কিছু জরুরি ফোনালাপ সারে। বাইরের ঘটে যাওয়া ঘটনায় সে তাড়িত হচ্ছেনা, দেহভাষায় যথেষ্ট প্রশান্তি। ফোনের অন্যদিকের কণ্ঠ এবং ব্যক্তিগুলো পরিবর্তন হতে থাকলেও তার চোখে কিংবা মুখের অভিব্যক্তিগুলো অপরিবর্তনশীল থেকে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের ড্রাইভার মিজানের পাশে বসে শুনে নিতে হয় জাভেদের কথোপকথন। যেহেতু গল্পগুলোতে “সাহেব” শব্দটি এতদিন তার ব্যবহারিক কারনে তার জৌলুস হারিয়েছে- ভারিক্কী এবং একঘেয়ে হয়ে উঠেছে, প্রৌঢ় হেরে যাওয়া, বোকা আদর্শবাদী অথবা সস্তা ভিলেন, মায়া চাপানোর জন্য “সাহেবেরা” স্ত্রী-প্রেমিক হন, যাদের ছিপছিপে এক কন্যা থাকে কিংবা বখে যাওয়া পুত্র, মাসের শেষে যার সংসারে টানাটানি থাকে, প্রমোশনের জন্য হাহাকার থাকে অথবা স্থলনের যৌক্তিক কারণ থাকে অথবা নিখাদ বাজে মানুষ হন অথবা অত্যাচারী হন- কাজের মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দ্যান, বাড়িওয়ালা হলে ভাড়াটাদের অযৌক্তিক কারনে ভাড়া বাড়ান, কিংবা মন্ত্রী হন, অথবা অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং অবসরহীন লেখক হন সেজন্য জাভেদ হুসেইনকে জাভেদ সাহেব বলতে দ্বিধা হয়। যদিও তার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া কাঁচা শাকসব্জির আড়তদার ইসমাঈল সরকার তাকে “জাভেদ সাহেব” বলেন আর হে হে করে হাসেন আর জাভেদের এটিকেটে হকচকিয়ে যান। তবে স্ত্রী জেবা যখন ফোনে কাউকে বলেন “আমার সাহেব”- জাভেদ হুসেইনের কাছে তা মোহময় লাগে, কিছুটা উত্তেজকও বোধ করি। পূর্ননাম- জাভেদ হুসেইন খুব পোশাকি, স্কুল কলেজ কিংবা ভিজিটিং কার্ডের বাইরে এই নামটা ওজনদার। লিখিত ফর্ম ছাড়া এই নামটি উচ্চারিত করেন তার মা মনোয়ারা বেগম। বছর দশেক ধরে যিনি হুইলচেয়ারে অভ্যস্ত, পক্ষাঘাতে, তার নিজের দিক থেকে বাম এবং আয়নার প্রতিবিম্বের বাস্তবতায় ডানপক্ষ নিশ্চলতার পক্ষ নিয়েছে। যেহেতু কর্পোরেট ব্যবসার রমরমে দিনে নামের আগে মিস্টার বলাটাই রীতি। যেখানে জাভেদ হুসেইন ভালো অতীত, সফল বর্তমান এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকা একজন পদস্থ করপোরেট ঘোড়া। তবুও মিস্টার শব্দটা ব্যবহার না করে, তার খালাতো বোন সাথীর মতই আমরা তাকে “জাভেদ” বলেই ডেকে যেতে পারি। সাথী পেশায় ডাক্তার, দুই সন্তানের জননী, কিছুটা অসুখী, গতকালকেও যার চেম্বারে ঘন্টা দুয়েক স্মৃতিচারণ করেছে জাভেদ।

সাথী কালকে ফোন দিয়েছিল। বলেছিল, “জাভেদ, রোগী দেখতে দেখতে অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তুমি কি আসতে পারবে?”

সাথীকে তার কিশোরী বেলা পর্যন্ত জোর করিয়েও জাভেদকে “তুমি” বলানো যায় নি। মনোয়ারা বেগম তার ভাগ্নীকে বকেছে। শেষে না পেরে ছোটবোনকে আর বোন জামাইকে বলেছে, “দেখলা ও জাভেদ হুসেইনকে এখনো তুই তুই করে বলে!”

মনোয়ারা বেগমের ভেতর এক সামন্ত প্রভুত্ব ছিল। তার ধারনা ছিল জাভেদের সাথে সাথীর বিয়ে হবে এবং তার সিদ্ধান্ত তার নিজের কাছেই এমন অমোঘ মনে হত যে এর বিকল্প কোন চিন্তা থাকতে পারে সেটা তার মাথায়ই ছিলনা বরং তার ভেতরে এই ইচ্ছেটাকে তার বোনের প্রতি তার অসীম সহানুভূতির প্রকাশ বলেই মনে হত এবং সাথীর মা, মনোয়ারা বেগমের ছোট বোন রেবেকা বেগম, যার এই নামকরনটাও করেছেন বড়বোন মনোয়ারা, যিনি বোনের বোকামিতে পদে পদে চিন্তিত হন, রেবেকার স্বামী জোয়ার্দারের বৈষয়িক বুদ্ধিহীনতায় শঙ্কিত হন, আর তার বোনের মেয়ে, যে কিনা তার মনোনীতা পুত্রবধূ, সেই মেয়েটার “দাদাবাড়ি” ঘেঁষা চরিত্রের জন্য মাঝে মাঝে হা হুতাশ করেন। “হ্যাঁরে, রেবেকা- মেয়ের চুল এভাবে কাটাইছিস ক্যান ? জাভেদ হুসেইন সেইদিন আমার বিয়ার ছবি দেখে বলে মা তোমার কত বড় চুল ছিল, কি সুন্দর লাগছে”- জাভেদের বয়স তখন দশ, সাথীর আট, এই বয়সেই তার হবু পুত্রবধূর হবু-পতির বড় চুলকে সুন্দর লাগার কারনেই যেন সাথীর চুল কাটা যাবেনা। রেবেকা বেগম বোনের সামনে বরাবরই নিষ্প্রভ। তার নামকরণের কৃতজ্ঞতাই হোক, মা-হীন শৈশবে এই বোনের স্নেহ শাসনের অভ্যস্ততাই হোক কিংবা তার ব্যবসায় ফেল খাওয়া সুদর্শন পতিবরের আর্থিক অবস্থাজনিত হীনমন্যতার কারনেই হোক, তিনি বড়বোনের সাথে সহমত পোষন করেন। যদিও চুলটা কেটে দেবার পর তিনিই বলেছিলেন “ইস, চুলটা কেটে এতো সুন্দর লাগতেছে মেয়েটারে!” সেই তিনিই হরবর করে তার স্বামীর উপর চুল ছোট করার ভুল সিদ্ধান্তের দায় চাপিয়ে দেয়। তখন মনোয়ারা বেগম রেবেকা বেগমের বোকামি আর তস্য-পতি জোয়ার্দারের চ্যাংড়ামিতে উষ্মা প্রকাশ করেন।

সাথী ছেলেবেলা থেকেই তার বড়খালার সাথে একধরনের “প্রতিযোগীতা” অনুভব করে। এটা বোধ করি জাভেদের উপর অধিকারবোধের জায়গা থেকেই। “জাভেদ হুসেইন” বলে মনোয়ারা বেগম ডেকে উঠলেই সাথীর হাড়ি-পাতিল সংসার খেলার উঠোন থেকে জাভেদ এমন অস্থির ভাবে ছুটে যেত যেন বেজে উঠেছে শিঙ্গা কিংবা প্রকৃতি ডেকে বসেছে তাকে। সাথী তার শৈশবের দারুণ কৌতুকভরা চোখে অবজ্ঞা হেনে জাভেদের এই মা ভক্তিকে টিটকারী দিত। তার ছোট্ট মুঠোতে জাভেদের হাত ধরে রেখে বলতো, “তুই কি তোর মাকে ভয় পাস- খবরদার যাবি না।” জাভেদের মুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠতো। সে সাথীর মুঠোকে শক্তি দিয়ে উপেক্ষা করতে পারতোনা আবার জাভেদ হুসেইন নামের সেই ডাকের কাছে তার যে অভ্যস্ততা তাও কাটাতে পারতোনা। সাথী ঠোঁটের কোনের কৌতুক জাভেদের ভীতিতে প্রীত হত, বলতো- “যাহ, ভীতুর ডিম!”

সাথীর বাবা জোয়ার্দারের ব্যবসার উন্নতি হতে থাকলে এবং সাথী তার কৈশোরে উপনীত হতে থাকলে মনোয়ারা বেগমের আধিপত্য কেবল তার ছোটবোনের উপরে সীমাবদ্ধ থাকে। যদিও জাভেদকে জোয়ার্দার খুব পছন্দ করতেন এবং সাথীও। তারপরও কেবল মনোয়ারা বেগমের কোন ধারণাকে অস্বীকার করবার পথ হিসেবে একদিন বাপ-বেটি রেবেকা বেগমকে বোঝায়- মনোয়ারা বেগমের কিছু আচরণ অপমানজনক এবং জাভেদকে সাথী কোনক্রমে বিয়ে করতে পারবেনা।

এরপর রেবেকা আসলেও তার স্বামী-কন্যা আর জাভেদদের বাসায় আসতেন না। মনোয়ারা বেগম ব্যাপারটা বুঝে ফেলেন। তিনি অসহায় বোধ করেন। তার ছেলে জাভেদ হুসেইন কারো দ্বারা প্রত্যাখ্যত হবে এই ব্যাপারটা তার ভেতরে ভেতরে তাকে পোড়াত কিন্তু তিনি রাগ কিংবা ক্রোধ অনুভব করেন না।

জাভেদ হুসেইন মনোয়ারা বেগমের অনেক প্রার্থনার ফসল। দুটো মৃত সন্তানের জন্ম দেবার অনেক পরে জাভেদ হুসেইনের পৃথিবীতে আগমন। মনোয়ারা বেগম তার সমস্ত মনোযোগ আর যত্ন দিয়ে ছেলেকে বড় করেছেন আর ছেলের ভেতরকার তীব্র প্রতিভা সম্পর্কিত তার ধারনা সত্যায়িত হতে থাকে স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে, বৃত্তি পরীক্ষায়। পরবর্তীতে বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্টে প্রথম পাঁচে থেকে এবং শৈশব কাটিয়ে প্রথম কৈশোরে ঢুকেই জাভেদ হুসেইন অনুভব করে সে আলাদা, সে তীক্ষ্ণ, যে সফলতার জন্য মানুষ হা-হুতাশ করে, সেই দৌড়ে সে তার পারিপার্শ্বিকতার তুলনায় অনেক “ফিট”। সাথীর ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ থাকেনা। যেহেতু তার কাছে এটার কোন আলাদা অর্থ বহন করেনা।

হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার রেজাল্টের পর তাকে মনোয়ারা বেগম ছোটখালার সাথে দেখা করতে পাঠান। জাভেদ যায়। সাথীর সাথে দেখা হয়। খালুর সাথে দেখা হয়। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় এবং খুব স্বাভাবিক থাকে সম্পর্ক। যদিও এর অনেকদিন পরে সাথীর বিয়েতে রেবেকা বেগম বড়বোনের পা জড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন- বলবেন, “বুবু তুমি মন থেকে আমারে মাফ করে দিও।” বলতে বলতে রেবেকার চোখ বেয়ে নামতে থাকবে লজ্জা, অসহায়ত্ব এবং সর্বোপরী নিবেদন । মনোয়ারা কিছুটা বিব্রতবোধ করেন কিন্তু বোনের এই আনুগত্য আর জাভেদ হুসেইনকে প্রত্যাখান করার “ভুলটা” যে তার বোন বুঝতে পারে, তাতে তার শিরায় বহমান রক্তের সাথে বোনের রক্তের মিল পান এবং বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন ।

শহরের আকাশ আর রাজপথ অধিকার করা বৃষ্টির দিনে জাভেদ হুসেইন যখন তার খালাতো বোনের চেম্বারে গতকালের আলাপচারিতা রোমন্থন করেন কিংবা স্ত্রীকে ফোন করে জানান রাস্তায় বিশ্রী যানজটের কথা অথবা ড্রাইভার মিজানকে জিজ্ঞেস করেন গাড়ির তেল ট্যাংকির বর্তমান অবস্থা। ঠিক তখনই আট ন বছরের একটা ফুলবিক্রেতা মেয়েকে দেখেন তার গাড়ির জানালায় ফুল হাতে দাঁড়িয়ে। মেয়েটার মুখ বৃষ্টির কারনেই হোক আর রক্তশূন্যতার কারনেই হোক, একটা ফ্যাকাশে ভাব দেখা যায়। রাস্তা আর ঘোলা আকাশের থেকে তা একটু ভিন্ন হতে পারে। হেডলাইটগুলোর আলোতে সেটা রহস্যময় হতে পারে কিংবা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটা মেয়ের জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলার কারনেও হতে পারে। জাভেদ গাড়ির জানালাটা খোলে। ফ্যাকাশে মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার কথাগুলো এবার শোনা যায়, “স্যার- আমার বোনটা বোবা- একটা ফুল কেনেন”- ফুল কিনবার প্রয়োজনীয়তা বোধ না করলেও জাভেদ মানিব্যাগ খোলে। দশটাকার একটা নোট বাড়ালে যে মেয়েটা বোবা নয় সে ছোঁ মেরে নেয় আর বোবা মেয়েটা একটা বিবর্ণ ফুল বাড়িয়ে দেয়। জাভেদ সেটা নিতে গেলে ছোট্ট মেয়েটার ত্বকের ঠাণ্ডা তার গোটা শরীরে শীত হিসেবে ছড়িয়ে পরে। গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে। মিজানকে বলে, “মিজান অনেকদিন মায়ের কাছে যাইনা, এখন কুমিল্লা রওয়ানা দিলে যাওয়া যাবে?” মিজান বলে “হ্যাঁ স্যার, ঐ দিক আজকে ফাঁকা।” জাভেদ আবার চোখ বন্ধ করে। তার প্যারালাইজড মায়ের মুখে খুব অস্ফুটে বেড়িয়ে আসা শব্দ “অভিশাপ”- যেন তার মেরুদণ্ড বেয়ে নামতে থাকে।

জাভেদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের কিছু পরের কথা। দেশের বাইরের কোনো ইউনিভার্সিটিতে একটা স্কলারশীপ পেয়েছে। বিদেশ যাত্রার আগে তার অফুরন্ত অবসর, বন্ধুদের ঈর্ষা আর মায়ের গর্ব আর্দ্র চোখের সামনে সে সাবলীল। রাত জেগে পড়াশুনা আর তারুন্যপ্রাপ্ত উত্তেজক রাত।

এমনই কোন রাতে তার মা মনোয়ারা বেগমের পোষ্য তের চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী, চোখে যার অপার বিস্ময়। এবং যে বাক-প্রতিবন্ধী । মনোয়ারা বেগম মেয়েটাকে কাজের লোক হিসেবে নিয়োগ করলেও এই নিয়োগে একটা কল্যাণকর মানবতার সন্ধান পান। তিনি এই অবলা মেয়েটার ভবিষ্যৎ তার হাতে আসে বলে- মেয়েটার প্রতি আল্লাহর অপার করুনা দেখতে পান। তার বোনের নামকরনে তার সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মেয়েটাকে “জুঁই” নাম দেন। তো জাভেদের কোন ঘোর লাগা রাতে, জুঁই জাভেদের ঘরে পানি দিতে এলে কিংবা মশারি টানাতে এলে, জাভেদ তাকে আকর্ষন করার চেষ্টা করে- জাভেদ সেসময় এমন একটা অনুভূতির ভেতরে ছিল, তার নিজেকে মনে হত তার সমস্ত প্রস্তাব মূলত অপরপক্ষের প্রতি দয়া কিংবা করুনা । তাই জুঁই যখন তার স্পর্শে আতংকে চোখ উল্টে ফেলে, তার ত্বক থেকে সংক্রমন করে মৃত শীত, জাভেদ মেয়েটাকে বিরক্তির সাথে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসে আবার বইয়ের পাল্টা উল্টাতে থাকে। তার নিজের উপর খানিকটা রাগ হয়- সে আর মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকায় না ।

পরদিন মনোয়ার বেগম বিছানায় জ্বরতপ্ত মেয়েটার চোখে মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখেন। তিনি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করেন, নিজের উপর বিরক্ত হন। মনে হয় এই উটকো ঝামেলাটা তিনি কাঁধে না নিলেই পারতেন। পরিচয়হীন এই মেয়েটার পরিচর্যা করার মত তার সময় থাকেনা এবং তার বেশী ভয় হতে থাকে মেয়েটার ভেতরে হয়তো বাকহীনতার থেকে বড় কোন অসুখ আছে আর সে যদি তার বাড়িতেই মরে, তাহলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। তাই তিনি আজিজ বলে এক সকল কাজের কাজীকে ডাকেন, যে তার কিছুদিন আগেই বিরক্তিকর বেড়াল পরিবারকে বস্তাবন্দী করে চালান দেন দূরে। সুতরাং তার হাতে ৭০০ টাকা দিলে, মনোয়ারা বেগমের উপর উটকো আপদ হয়ে সওয়ার মেয়েটাকে কোন মানসিক হাসপাতালে দিয়ে আসেন ।

জাভেদ ঘটনাটাকে কখনোই বড় কিছু হিসেবে দেখে নাই। যেহেতু মেয়েটার শীতলতায় সে নিভে গিয়ে ক্ষান্ত দিয়েছিল এবং পরের ঘটনাপ্রবাহে মনোয়ারা বেগমের তার সন্তান জাভেদ হুসেইনের উপর আচরণের কোন পার্থক্য না লক্ষ্য করায় জাভেদের এটা নিয়ে বিব্রত হবার কোন কারণ দেখা যায়না । সেহেতু কেবল ফুলবিক্রেতা মেয়েটার শরীর থেকে বেড়িয়ে আসা শীত তাকে আক্রান্ত করার দিন প্রথম সে ব্যাপারটা ভাবে। তার পক্ষাঘাতগ্রস্থ মায়ের জন্য তার বুক হু হু করে উঠে। যার চোখ এখনো তার ছেলেকে দেখে চকচক করে উঠে সেই মহিলার আধা নিঃসাড় শরীরটা অভিশাপ বয়ে বেড়ানোর জন্য বড় ভঙ্গুর মনে হতে থাকে।

সে যখন তার মায়ের বাড়িতে পৌঁছায় তখন অনেক রাত। জানালার পাশে হুইল চেয়ারে বসে থাকা মনোয়ারা বেগম যেন জাভেদের জন্যই প্রতীক্ষা করে বসে ছিলেন কিংবা জাভেদ মনোয়ারা বেগমের এই প্রতীক্ষার ব্যাপারে অবগত। তাই এই দুজনের কিছু উচ্চারণ করার প্রয়োজন হয়না, তারা হাত ধরে কাঁদতে থাকেন। মনোয়ারা বেগমের দৃষ্টি হারানো চোখটাও শহরের ঘোলাটে মেঘের মতই স্যাঁতস্যাঁতে বৃষ্টি ঝরায় ।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×