ব্যাংলাদেশে আমাদের মুসলমানের একটা বড় অংশ একদিকে ঘুষ, চাঁদাবাজি, প্রতারণা নির্ভর অবৈধ রোজগার করে। অর্থাৎ হারাম খায়। আবার নিয়মিত নামাজ রোজাও করে। নিয়ত ও কর্ম আমাদের শুদ্ধ নয়, অথচ লোকদেখানো ধর্মীয় চর্চা করি। সারাটাদিন সর্বপ্রকার আকাম কুকাম ও পাপ কাজ করে দিনশেষে আত্মশুদ্ধির অভিনয় করি। এই শ্রেণীতে যেমন আছি আমি আপনি, আছেন ব্যবসায়ী, আমলা, পেশাজীবী, তেমনি আছে আমাদের বেশধারী ধর্ম গুরুও। একই সাথে স্রষ্টা, সমাজ এবং নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার এই ত্রিমুখী প্রচেষ্টায় কখনোই একটা জনপদের মানুষের আত্মোন্নতি লাভ হতে পারে না, আসলে আমাদের তা হয়ও নি।
বাংলাদেশের উপনিবেশ উত্তর মিশ্র শাসন কাঠামো যেহেতু নিজেই স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ভরা, তাই দেশের নাগরিক আর্থিক চর্চাসহ অন্য প্রায় কোনো বিষয়েই রাষ্ট্র কাঠামোকে বিশ্বাস করেনি কখনও। ফলে সে যখন যেভাবে পেরেছে রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়েছে। একদিক থেকে বলা যায়, আইনের যে কোন স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ সমাজে বরং অপরাধ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে নৈতিকতার উপ্লভদ্ধি ও পরমার্থের বিশ্বাস অগভীর হয়ে গেছে বলে আমাদের ধর্ম চর্চা আমাদের পাপ থেকে দূরে রাখতে পারিনি। আমরা সুবিধামতো পরিসরে ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলামী নৈতিকতা (ইসলামী রিচুয়াল নিয়ে কথা বলছি না এখানে) মানার চেষ্টা করি, আবার অনেকেই করি না, তবে পাপ শেষে ভিতরে ভিতরে 'খোদা মাফ করে দিও' বলে আপাত বুঝাপড়া করে নেই।
মুসলমানদের ইসলামী নৈতিকতার বর্ণনায় ব্যক্তির ওপর ও ব্যক্তির সম্পদে মা-বাবা, আত্মীয়-প্রতিবেশী ও সমাজের এত এত অধিকার বর্তেছে যে, এখানে বস্তুবাদী জীবন পালনের কোনোই সুযোগ কম। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী, এতিম, মিসকিন, দুস্থ, রোগী- এদের সবার হক, গরিবের হক, প্রাণিকুল ও পরিবেশের হক, জাকাতসহ সমুদয় দায়িত্ব সামনে রেখে ব্যক্তি মুসলমান, যে কিনা একজন সত্যিকারের ‘আত্মসমর্পণকারী’, তার ভোগবাদী ও বস্তুবাদী হওয়ার সুযোগ সীমিত। যেহেতু এগুলোর অনেক কিছু নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র তার নিজের দায়িত্ব পালন করে না, তাই ব্যক্তি মুসলমান তার বিশ্বাসের পরিসরে থেকেই এসব পালন করে বা করে না। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হচ্চে, কিছু করুক বা না করুন তার জন্য সে মনে মনে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে দায়িত্ব সারে। একদিকে এই সহনীয় নৈতিক সীমানা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের নিজেরই নাজুক নৈতিক অবস্থা, এবং পাশাপাশি শাসকদের সীমাহীন দুর্নীতি-এই তিনে মিলে অপরাধ সংস্কৃতিকে বহু বিস্তৃত করছে।
মূলকথা কষ্টকর ইসলামী নৈতিকতা পালনে মুসলমানরা ব্যক্তিগত বোধে তাড়িত হয়ে যেখানে যতটুকু পারা যায় ততটুকুই নিজের সুবিধামতো ঠিক বা বেঠিকভাবে করেছে, বাকিটুকুর (এমনকি পাপ-মহাপাপও) জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে দায়িত্ব সারছে। এ যুগপৎ ধারায় সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি ও অপরাধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতারণা দুর্নীতি অপরাধ আমাদের জীবনাচারের অংশ হয়ে গেছে।
তবে সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহ জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি-দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে কিছু মানুষ পাঠান প্রতিটি সমাজে, তারা অন্ধকার হটিয়ে সমাজকে আলোকিত করেন। দেখা যাচ্ছে আমাদের আলোকিতরাই বেশি বড় চোর, বহু বুদ্ধিজীবী আর আলেমই বরং বড় ভন্ড হিসেবে আবির্ভূত।আমাদের সমাজে আমরা জ্ঞানীগুণী-জ্ঞানহীন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আল্লাহকে জঞ্জালমুক্ত করে সমাজ আলোকিত করার পাল্টা দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ দিয়ে রেখে নিজেরা যার যার সাধ্যমতো বেপরোয়া দুর্নীতি, আর্থিক ও সামাজিক অপরাধ, গরিবের হক লুট, মেহনতি মানুষের অধিকার নষ্ট, আত্মীয়-প্রতিবেশীকে ঠকানো, প্রাণ ও পরিবেশ ধ্বংসের অবিরাম চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি।
দুই
-----------------
সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি, পাপাচার থেকে নিবৃত হওয়া, অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে সংযত করা। বস্তুবাদী এবং ভোগবাদী জীবন যাপনকে পরিহার করা। যাকাত এবং সম্পদ বন্টনের নৈতিক এবং মানসিক দীক্ষা নেওয়া। ব্যক্তি জীবনে নিয়মানুবর্তীতা এবং শৃঙ্খলাবোধ তৈরির জন্য সিয়াম অনন্য। বাহুল্য বর্জন এবং নিজের সম্পদের যে অংশকে আল্লাহ্ গরীবের হক বলে নির্ধারিত করে দিয়েছেন তার অবমুক্ত করন, এই সম্পদ বিয়োগের জন্য মন মানসিকতাকে পরিশুদ্ধ এবং প্রস্তুত করাই সিয়ামের অন্যতম প্রধান তাৎপর্য।
রোজা মনের লাগামহীন ইচ্ছা বিলাসকে নিয়ন্ত্রিত করে, অপ্রয়োজনীয় কর্ম তৎপরতা ও কর্ম পরিধিকে সংকুচিত করে স্রষ্টার প্রার্থনার ইচ্ছাকে ইহজাগতিক ইচ্ছার উপর প্রাধান্য এনে দেয়। এই আধ্যাত্মিক প্রাপ্তির যোগ ইবাদতে মনোযোগ এবং তৃপ্তি আনে। এর বাইরে আরেকটি তাৎপর্য্যমন্ডিত ব্যাপার হোল- মনের বস্তুবাদী বাসনাকে দুর্বল করে রোজা ব্যক্তিকে সম্পদ বিয়োগের জন্য তৈরি করে। জাকাত প্রদানে, দানে, আত্মীয় প্রতিবেশীর হক অবমুক্তকরনে ব্যক্তিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে। অর্থাৎ রোজা একদিকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাকওয়া আনবে অন্যদিকে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে মনকে প্রস্তুত করে তুলবে।
ভোজন ও পানাহারে ধনীর অতি বাড়বাড়ি, অমিতব্যয়ী জীবনাচার, সম্পদ কুক্ষিগত করার একচেটিয়া মানুষিকতায় আমাদের সমাজে রোজা শুধুমাত্র উপবাস আর উদজ্জ্বপন সংস্কৃতির মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছিল। আমরা পাপচার ছাড়ছি না, হারাম উপার্জন ত্যাগ করছি না, ঘুষ ও দুর্নীতি পরিহার করছি না, আত্বশুদ্ধির কিছুই করছি না, ব্যক্তি জীবন নিয়মানুবর্তী ও শৃঙ্খলিত করছি না, বাহুল্য এবং অপচয় কমাচ্ছি না, সম্পদের যে অংশ গরিবের হক হিসেবে নির্ধারিত তা অবমুক্ত করছি না। স্বল্পাহারের মাধ্যমে শরীরকে দুর্বল এবং মনকে সংযত করার যে মহৎ উদ্দেশ্য আজ সে মহৎ উদ্দেশ্য ভোজনবিলাস চরিতার্থের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মনে হয়।
এমতাবস্থায় করোনাকালে রোজা এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে হাজির হয়েছে এবারের 'রোজা'। আমাদের চারপাশে এক দৃশ্য ও অদৃশ্য ক্ষুধার রাজ্য ছড়িয়ে গেছে স্থবির অর্থনৈতিক অবস্থায়। রোজা যে মানবীয় গুনের বিকাশ ঘটায়, ক্ষুধার্তকে খাবার দিতে উৎসাহ দেয়, তা যেন অন্তত এই বছর ভুলভাল না হয়। আমরা যাতে খুঁজে খুঁজে ক্ষুধার্তকে সাহরি ও ইফাতারে খাবার দেই। ব্যক্তির এগিয়ে আসার মাধ্যমে রোজার মাসে ক্ষুধা পরাজিত বলেই আমার বিশ্বাস। তথাপি সাম্মিলিত নৈতিক জাগরণে রাষ্ট্রকেই ক্ষুধার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার কৌশলও প্রয়োজন, রোজা শেষে আমরা যাতে তাও ভুলে না যাই!
আজ থেকে আমাদের ধর্মীয় রিচুয়াল ও উদজ্জ্বপন কেন্দ্রিক ধর্ম চর্চা, আইডেন্টিটি নির্ভর ধর্মীয় চেতনা, মানবিক উপ্লভদ্ধির গভীরতা হীন ধর্মীয় জীবনাচারের পরিবর্তন হয়ে যাক। লোভ এবং কৃপণতার কারনে যাকাত, ফিতরা, দান, খয়রাতকে অস্বীকার করার বক্রতা গুলো মুছে যাক, সম্পদ বিয়োগের অনীহা দুর হয়ে যাক। আমাদের দীনতার পরিবর্তন হোক। ক্ষুধার রাজ্য পরাজিত হোক। অপরাধ, বৈষম্য আর নিপীড়ন জর্জরিত সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক। মহৎ কাজ, আত্মশুদ্ধির অনুপম চর্চা গুলো জীবনাচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক!
খোশ আমদেদ, মাহে রমজান।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২০ রাত ৮:৪৬