এটা ঠিক যে, কিছু কিছু এলাকার ওয়াসা সরবারহকৃত পানি ফুটিয়ে পানযোগ্য করাও মুশকিল। তবে সব এলাকার চিত্র এটা নয়। ঢাকার অধিকাংশ এলাকার মানুষই পানি ফুটিয়ে পান করছেন এবং এটাই নিরাপদ পদ্ধতি। এই নিরাপদ পদ্ধতিকে ব্যবসায়ীক পণ্য দিয়ে প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়াকে সাধুবাদ জানানো যায় না। কেননা এতে নিরাপদ পানির মত মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হবার এবং নিন্ম ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাপনের খরচ বাড়ার পথ তৈরি হচ্ছে।
কিছুদিন পুর্বে ঢাকাবাসী ব্যানারে আমাদের প্রিয় মানুষ পরিবেশকর্মী মিজানুর রহমান পূর্ব জুরাইনের ময়লা পানির বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন এবং ওয়াসার এমডিকে সরবারহকৃত পানির শরবত পান করাতে গেছেন। আমরা দেখিনি যে, দেশের তারকাদের কেউ এই আন্দোলনে সাড়া দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন কিংবা নিরাপদ পানি বিষয়ে কিছু বাক্য ব্যয় করেছেন। সমস্যা সমাধানের আলাপ না তুলে দেশের তারকরা অর্থ তৈরিতে নেমেছেন, এটা খুব হতাশার। দেখা যাচ্ছে দেশের সমস্যার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের তারকাদের আয়ের পথও! ওয়াসার দুর্নীতি ও জবাব্দিহিতাহীনতার বিরুদ্ধে আমরা কথা বলে যাব, কিন্তু পানীয় জল সরবারহের যে মৌলিক সেবা এটাকে কোন ভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না।
ইউনিলিভার কয়েক ধরনের ফিল্টার বিক্রি করে। ফুটানো পানি ছুঁড়ে ফেলার বিজ্ঞাপনে একটা ফিল্টারের প্রমোশান করা হচ্ছে যেখানে উচ্চ ঘনত্বের পানি চাপের ফলে নিন্ম ঘনত্বের অংশে যায়, ফিল্টারের ভিতর দিয়ে, এতে পানি পরিষ্কার হয়। ফিল্টারের উপরের পানি প্রায় প্রতিদিনই বদল করে ফেলতে হয়, নাইলে পানিতে জীবানু হয়, দুর্ঘন্ধযুক্ত হয়। এতে পানিও নষ্ট হয়। এই ফিল্টারের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ মাইক্রো ফাইবার ম্যাশ বা ছাঁকনি প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করার পাশাপাশি বছরে কয়েকবার না বদলাতে পারলে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা অনেকাংশেই কমে যায়।
মূল বিষয় হচ্ছে, ফিল্টার করা এই পানিতে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান একেবারেই থাকে না। ফিল্টার্ড হয়ে যায়। ফলে শুধু তৃষ্ণা নিবারাণ হয় কিন্তু পানি পুষ্টির উপাদান রাখে না। দীর্ঘমেয়াদে এই পানি মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব তৈরি করে মানব শরীরে যা ভিটামিন ও মিনারেল নামে আলাদা কিনে খওয়া লাগে। সমস্যা হচ্ছে- নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা হীন দেশে বুঝে উঠার আগে বিশেষ করে শিশুদের পুষ্টিহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে। অন্যদিকে খনিজ উপাদানহীন পানি মানবদেহের ইলেকট্রোলাইটিক ব্যালেন্স দ্রুত নষ্ট করে দিয়ে, সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
এর বাইরে ইউনিলিভার আল্টিমা ফিল্টার বিক্রি করে। কেন্ট নামে আরেকটা ব্রান্ড বেশ চলে এবং এরকম বহু আছে। এই ফিল্টার গুলোতে এক লিটার পানি পরিশোধিত করতে গিয়ে অন্তত দুই লিটার পানি ফেলে দিতে হয়। একটা নল দিয়ে সবসময় ময়লা পানি আলাদা করার নামে পানি অপচয় ২৪/৭ চলতেই থাকে। হোটেল রেস্টুরেন্ট সহ বাসাবাড়ির সর্বত্রই এখন কেন্ট টাইপের ওয়াটার ফিল্টারের ব্যবহার বাড়ছে। এতে ভূগর্ভস্ত পানির ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। শহুরে ভূগর্ভস্ত পানি স্তর যেখানে দিনকে দিন গভীর হচ্ছে, সেখানে এভাবে ভূগর্ভস্ত পানি অপচয়ের বিপদ ভয়াবহ। শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেও এর কারণ থাকবে।
এটা ঠিক যে, পানি ফুটাতে গ্যাসের অপব্যবহার হচ্ছে। একটা প্রচলিত ভুল ধারণা আছে যে, পানি ২০ মিনিট বা কেউ কেউ বলেন ৩০ মিনিট ফুটাতে হয়। আসলে সেটা সম্পুর্ণ ভুল, এ জন্যই গ্যাসের অপচয় বেশি হচ্ছে। পানি রোলিং বয়লিং টেম্পারেচারে চলে আসলে (রোলিং বয়লিং বা উৎরানো শুরু হয়ে গেলে) সর্বোচ্চ ১ মিনিট অপেক্ষা করাই এনাফ। বুয়েটের স্যারদের একটা লেখার লিংক এখানে দিচ্ছি।
কেউ কেউ মনে করেন, উর্ধ্বপাতন পানীয় জল পরিশোধনের সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি, এটা ভুল কথা। কারণ, উর্ধ্বপাতন জাত পানি আসলে পুষ্টি ও খনিজ উপাদান হীন 'পরীক্ষাগার পানি'। মরুভূমির দেশগুলো সাগরের স্যালাইন পানি ডিস্যালাইনের মাধ্যমে পানীয় জলের ব্যবস্থা করে, সেখানে পরে তারা পুষ্টি উপাদান যুক্ত করে অর্থাৎ মিনারেল যুক্ত করে। অন্যথায় দীর্ঘ মেয়াদে মিনারেলহীন পানি স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করার কারণ হতে পারে। নিকট ভবিষ্যতেই বাংলাদেশেরও সি-ওয়াটার ডিস্যালাইনেশান লাগতে পারে, কেননা উপকূলে স্যালাইন পানির পেনিট্রেশান বাড়ছে, আবার বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষা ও ধলেশ্বরীর পানি শোধন অযোগ্য হওয়ায় জশলদিয়ায় পদ্মার পানি শোধনে প্রকল্প নেয়া লেগেছে। অন্যদিকে সারফেইস ওয়াটারকে কৃষি কাজের জন্য সংরক্ষণ করা লাগবে শুকনো মৌসুমে, বৃষ্টির পানি ব্যবহারের বড়সড় পরিকল্পনা লাগবে, শহরে আবাসিক কম্পাউন্ডে ও শিল্পে পানি রিসাইকেলের বড় পরিকল্পনা লাগবে। মোটকথা ডিস্যালাইন্ড পানিতে খনিজ উপাদান যোগ করা লাগবে। আর যে কোন খনিজ উপাদান (আর্সেনিক, আয়রন) মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, দরকার তার স্বাস্থ্যসম্মত পরিমাণ। ক্ষতিকর হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ যা কিছু কিছু এলাকায় এখন দেখা যাচ্ছে। ওয়াসা সহ পানি সরবারহকারী আঞ্চলিক সিটি/পৌর কৃর্তিপক্ষের উচিৎ সরবারহকৃত পানির গুণগত মানের স্টান্ডার্ড সেট করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু, রিভার্স ওস্মোসিসের খনিজ হীন পানি পানের ব্যাপারের বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করেছে। বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন-"এটি পর্যাপ্তরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে স্বল্প খনিজ পদার্থের জল গ্রহণের ফলে শরীরের হোমিওস্টেসিস প্রক্রিয়া গুলিতে ও বিপাক প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ে।'' রিভার্স অসমোসিস জলের ব্যবহার "দেহের জলে ইলেক্ট্রোলাইট দ্রবীভবন বেড়ে যায়। দেহের অঙ্গগুলোর মধ্যে অপর্যাপ্ত খনিজ বিতরণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির ক্রিয়াকলাপে আপোস করে। এই অবস্থার একেবারে শুরুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং মাথাব্যথা অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘ্যমেয়াদী গুরুতর লক্ষণগুলি হ'ল পেশী ক্র্যাম্পিং,হৃদস্পন্দন এবং প্রতিবন্ধীত্বের লক্ষণ"
সবমিলে পানীয় জলের একটা টেকসই সমাধান দরকার। আমরা ওয়াসাকে নিরাপদ পানীয় জলের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নিবার দাবী জানাই। ঘুষ ও দুর্নীতিকে পশ্রয় দেয়া হয়েছে বলেই যত্রতত্র পানির লাইন টেম্পার করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সরবারহের লাইনে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। সমাধান হচ্ছে সরকার সিটি ও পৌর করপোরেশান গুলোর প্রায় শত বছর পুরানো পানীয় জল সরবারহের স্টান্ডার্ড এ গুণগত মান আনবে। ওয়াসার ঘুষ দুর্নীতি বন্ধে এবং দুর্বিত্তদের লাইন টেম্পারিং যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নিবে।
ওয়াসা ঢাকা-নাগঞ্জ, চট্রগ্রামে পানি সরবারহ করে যার কিছু এলাকায় সরবারকৃত পানির মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সিটি ও পৌর কর্পোরেশানের পানি ফুটিয়ে পান করা নিরাপদ। কিছু এলাকায় আর্সেনিক ও আয়রনের প্রভাব রয়েছে তার সমধানও আছে। সারাদেশ বিবেচনায় আনলে 'ফুটানো পানি ছুঁড়ে ফেলা' বড় রকম ধৃষ্টতা মনে হয়।
তারকরা দেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বেখবর, নাকি অর্থরুজির ধান্ধায় তারা ফুটানো পানি ছুঁড়ে ফেলে মৌলিক সেবাকে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন, সেটা একেবারেই বোধগম্য নয়!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:১৭