মাফলার দিয়ে গলা মুখ ঢেকে ক্লাসের দিকে যাচ্ছি। বাতাসের প্রবল ঝাঁপটা আমার গরম কাপড় ভেদ করে হাড় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছে, আর দাতে দাঁত লেগে সৃষ্টি হচ্ছে শৈত্য সঙ্গীত। ক্লাসে পৌছাতে পৌছাতে ১০ মিনিট লেট। আমার শীতে নাজেহাল হওয়া অবস্থা দেখে ফিনল্যান্ডের মেয়েটা মিটি মিটি হাসে। আমি মনে মনে বলি ওরে সাদা ভাল্লুক তুই কী করে বুঝবি আমার কষ্ট, তুই তো থাকিস বরফের আড়ৎ-এ
ক্লাস শেষ হলো ১১ টায়। সকালের নাস্তা হয়নি, ক্যান্টিনে যেয়ে খাওয়া যায়। কিন্তু সকাল বেলা-ই বাংলার পেট চৈনিক খাবারের স্বাদ নিতে রাজী নয়। দেশে থাকা অবস্থায় চৈনিক খাবারের প্রতি যে প্রীতি ছিল তা চৈনিক নগরীতে আসার পর তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
রুমে আসার পর দেখি আমার শস্য ভাণ্ডারের মজুদ ফুরিয়ে এসেছে, উনুন জ্বালানো সম্ভব নয়। অগত্যা কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে বাজার মুখে রওনা হলাম। শীতের সাথে প্রচণ্ড বাতাস যা শরীরকে স্থবির করে দিতে চায়। কিন্তু জিহ্বার কাছে শরীরের পরাজয় দেখে মনে মনে বলি- হায়রে বাঙ্গালী সারা জীবন জিহ্বার দাসত্বই করলি। আমার ডরমিটরির থেকে বাজার খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র ৫-৭ মিনিটের পথ।
বাজারে ঢুকেই তড়িঘড়ি করে আলু, কপি, পিয়াজ, মরিচ, টমেটো আর শসার মতো দেখতে লাউ কিনে ফেললাম, মুরগী কিনলাম ১৮ পিছ। পাঠক দয়া করে চোখ কপালে তুলবেন না। এখানকার লোকজন শ্রেণীকরণে বিশ্বাসী। তাই তারা আস্ত মুরগী বিক্রি না করে - ডানা, মাথা, রান এর সবগুলোই আলাদা আলাদা করে বিক্রি করে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি অঙ্গের ঠাঁই হয় তার সমগোত্রে। মুরগী কেনা শেষ করে দেখি বাজার করা মোটামুটি শেষ। এখানে বাজার করলে এই এক যন্ত্রণা, পকেটে প্রচুর ধাতব মুদ্রার আগমন ঘটে। ভাগ্যিস এদের রাস্তা আবুল বানায়নি। তাহলে হয়ত গন্তব্যে পৌঁছে দেখা যেত পকেটের অর্ধেক পয়সা রাস্তায় বিসর্জন দিয়ে এসেছি। পকেটে পয়সা থাকলেও আরেক যন্ত্রণা, সে তার অস্তিত্ব জানান দেয় সমসময়।
বাজারের গেট থেকে বাইরে বেরুতেই একটি করুন সুর আমার কানে ভেসে আসল। সুরটি এতই করুন যে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল কেউ একজন হয়তো সুর দিয়ে কান্না করছিল। যতই সামনে এগুতে থাকি কান্নার শব্দ ততোই তীরের মত এসে বুকে বিঁধতে লাগলো। মেইন রাস্তা পার হলেই আমার ক্যাম্পাসে ঢোকার গেট। সিগন্যালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে সুরের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি। হঠাৎ সুরের উৎস খুঁজে পেলাম। দেখি ফুটপাতের এক কোনায় বসে এক বৃদ্ধ লোক বাঁশি বাজাচ্ছে যার দুটো পা-ই কাটা। এই প্রচণ্ড শীতের মাঝে রাস্তায় বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে শুধু দুটো পয়সার জন্য। লোকটার গায়ে যদিও বেশ কয়েকটা গরম কাপড় ছিল কিন্তু শীতের তীব্রতার কাছে তারা হার মেনে যাচ্ছিল।
সামনে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে থালাতে ফেলতেই, লোকটি বাঁশির শব্দ থামিয়ে এমন ভাবে “শিয়ে শিয়ে” (চীনা ভাষায় ধন্যবাদ) বলে উঠলো যেন করুন সুরের সাথে কৃতজ্ঞতার ঢেকুর বেড়িয়ে আসলো। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল আমার দেশের সেই সকল মানুষের কথা, যাদের এই প্রচণ্ড শীতেও একটি পাতলা কাপড় ছাড়া আর কিছুই থাকে না গায়ে দেবার মত, আবার কারো কারো বেলায় তাও থাকে না। আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে, ওখানকার শীত সম্পর্কে আশা করি সবারই ধারনা আছে। আমি তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি, গ্রামের বাড়ী যেয়ে দেখি আমার বয়সী ছেলেরা সুপার ম্যানের মত গলায় তপন (সিরাজগঞ্জে লুঙ্গির আঞ্চলিক শব্দ) বেঁধে ঘুরাফেরা করছে। ছোট বেলায় ও দেখে খুব মজা পেলেও এখন তা মনে আসতেই চোখের কোণায় শিশির বিন্দু জমে উঠে। কারন তপন তারাই বাঁধতো যাদের ওই লুঙ্গিটাই শীতের একমাত্র অবলম্বন, যা দিয়ে শুধু পিঠের অংশটুকুই ঢাকা যায়। বাংলাদেশে এমন হাজার হাজার লোক আমরা প্রতিদিনই দেখি। যাদের গায়ে শীতের কাপড়তো দুরের কথা একটি পাতলা আবরণও নেই। এসব দেখতে দেখতে আমরা এখন অভ্যস্ত। তাদের দেখে আমাদের বিবেক আর জাগ্রত হয় না, অনুভূতিও নাড়া দিয়ে ওঠে না। আমাদের ভাবটা এমন, যেন এই ই নিয়ম, এটাই তাদের নিয়তি। শীত চলে এসেছে, আমরা সবাই শীতের কাপড়ের মজুত বাড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি আমার দেশের সেই সকল হতভাগাদের কথা যাদের এই শীত কাটাতে হবে রেল-ষ্টেশনে, বাস টার্মিনালে, ফুটপাতে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে অথবা আমাদের দৃষ্টি পৌছায় না এমন কোন জায়গায়।
এই হতভাগাদের দেখার মত কেউ নেই, ভাগ্যও এদের দিকে মুখ ফিরে তাকায় না।
আমরা কি পারি না তাদের জন্য কিছু করতে! আমরা কি পারি না তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতির হাতটা একটু বাড়িয়ে দিতে!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




