somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোবা বাঁশীর কান্না

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকালের ঘুমের মত এত আরামের ঘুম স্বর্গেও আছে কিনা তা আমার জানা নেই। বরং সকালের ঘুমকেই আমার স্বর্গীয় মনে হয়। সেই স্বর্গীয় ঘুমে হঠাৎ দোযখের আলামত টের পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেল আমার বেরসিক মোবাইল ফোন কর্কশ গলায় জানান দিচ্ছে- “ঘুম থেকে ওঠো ক্লাসে যাওয়ার সময় হয়েছে”। মোবাইল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি ৮:২০, কিন্তু আমি তো এ্যলার্ম সেট করেছিলাম ৮:০০! বুঝতে আর বাকী রইল না এই ক্ষুদ্র যন্ত্র তার ভোকাল কর্ডের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করেও আমার মত গণ্ডারের ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। রবার্ট ব্রুসের ন্যায় নিরাশ না হয়ে সে তৃতীয় দফায় চিৎকার করে আমার স্বর্গীয় ঘুম ভাঙ্গাতে সমর্থ হল। তড়িঘড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে গায়ে গরম কাপড় চাপিয়ে, দৌড়ে নামলাম ছয় তলা থেকে। নেমেই টের পেলাম আজ কপালে কী আছে, একে তো শীত তার উপর প্রচণ্ড বাতাস। ডরমিটরির গেটে টানানো আবহাওয়ার রিপোর্টে চোখ বুলাতেই দেখি আজ সর্বনিম্ন ২ আর স্বর্বোচ্চ ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই শীতে কম্বল মুড়ী দিয়ে ঘুমানোর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বেরসিক প্রফেসর গুলোর কারনে তা আর হয়ে ওঠে না। ঠিক ক্লাসে যেয়ে দেখব আমরা পৌঁছানোর আগেই প্রফেসর হাতে একটি গরম পানির ফ্লাক্স নিয়ে বসে আছে। জাগতিক কোন সুখ-দুঃখ কি এদের স্পর্শ করে না? এদের ঈশ্বর ভাল বলতে পারবেন।
মাফলার দিয়ে গলা মুখ ঢেকে ক্লাসের দিকে যাচ্ছি। বাতাসের প্রবল ঝাঁপটা আমার গরম কাপড় ভেদ করে হাড় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছে, আর দাতে দাঁত লেগে সৃষ্টি হচ্ছে শৈত্য সঙ্গীত। ক্লাসে পৌছাতে পৌছাতে ১০ মিনিট লেট। আমার শীতে নাজেহাল হওয়া অবস্থা দেখে ফিনল্যান্ডের মেয়েটা মিটি মিটি হাসে। আমি মনে মনে বলি ওরে সাদা ভাল্লুক তুই কী করে বুঝবি আমার কষ্ট, তুই তো থাকিস বরফের আড়ৎ-এ

ক্লাস শেষ হলো ১১ টায়। সকালের নাস্তা হয়নি, ক্যান্টিনে যেয়ে খাওয়া যায়। কিন্তু সকাল বেলা-ই বাংলার পেট চৈনিক খাবারের স্বাদ নিতে রাজী নয়। দেশে থাকা অবস্থায় চৈনিক খাবারের প্রতি যে প্রীতি ছিল তা চৈনিক নগরীতে আসার পর তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
রুমে আসার পর দেখি আমার শস্য ভাণ্ডারের মজুদ ফুরিয়ে এসেছে, উনুন জ্বালানো সম্ভব নয়। অগত্যা কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে বাজার মুখে রওনা হলাম। শীতের সাথে প্রচণ্ড বাতাস যা শরীরকে স্থবির করে দিতে চায়। কিন্তু জিহ্বার কাছে শরীরের পরাজয় দেখে মনে মনে বলি- হায়রে বাঙ্গালী সারা জীবন জিহ্বার দাসত্বই করলি। আমার ডরমিটরির থেকে বাজার খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র ৫-৭ মিনিটের পথ।
বাজারে ঢুকেই তড়িঘড়ি করে আলু, কপি, পিয়াজ, মরিচ, টমেটো আর শসার মতো দেখতে লাউ কিনে ফেললাম, মুরগী কিনলাম ১৮ পিছ। পাঠক দয়া করে চোখ কপালে তুলবেন না। এখানকার লোকজন শ্রেণীকরণে বিশ্বাসী। তাই তারা আস্ত মুরগী বিক্রি না করে - ডানা, মাথা, রান এর সবগুলোই আলাদা আলাদা করে বিক্রি করে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি অঙ্গের ঠাঁই হয় তার সমগোত্রে। মুরগী কেনা শেষ করে দেখি বাজার করা মোটামুটি শেষ। এখানে বাজার করলে এই এক যন্ত্রণা, পকেটে প্রচুর ধাতব মুদ্রার আগমন ঘটে। ভাগ্যিস এদের রাস্তা আবুল বানায়নি। তাহলে হয়ত গন্তব্যে পৌঁছে দেখা যেত পকেটের অর্ধেক পয়সা রাস্তায় বিসর্জন দিয়ে এসেছি। পকেটে পয়সা থাকলেও আরেক যন্ত্রণা, সে তার অস্তিত্ব জানান দেয় সমসময়।

বাজারের গেট থেকে বাইরে বেরুতেই একটি করুন সুর আমার কানে ভেসে আসল। সুরটি এতই করুন যে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল কেউ একজন হয়তো সুর দিয়ে কান্না করছিল। যতই সামনে এগুতে থাকি কান্নার শব্দ ততোই তীরের মত এসে বুকে বিঁধতে লাগলো। মেইন রাস্তা পার হলেই আমার ক্যাম্পাসে ঢোকার গেট। সিগন্যালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে সুরের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছি। হঠাৎ সুরের উৎস খুঁজে পেলাম। দেখি ফুটপাতের এক কোনায় বসে এক বৃদ্ধ লোক বাঁশি বাজাচ্ছে যার দুটো পা-ই কাটা। এই প্রচণ্ড শীতের মাঝে রাস্তায় বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে শুধু দুটো পয়সার জন্য। লোকটার গায়ে যদিও বেশ কয়েকটা গরম কাপড় ছিল কিন্তু শীতের তীব্রতার কাছে তারা হার মেনে যাচ্ছিল।

সামনে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে থালাতে ফেলতেই, লোকটি বাঁশির শব্দ থামিয়ে এমন ভাবে “শিয়ে শিয়ে” (চীনা ভাষায় ধন্যবাদ) বলে উঠলো যেন করুন সুরের সাথে কৃতজ্ঞতার ঢেকুর বেড়িয়ে আসলো। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল আমার দেশের সেই সকল মানুষের কথা, যাদের এই প্রচণ্ড শীতেও একটি পাতলা কাপড় ছাড়া আর কিছুই থাকে না গায়ে দেবার মত, আবার কারো কারো বেলায় তাও থাকে না। আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে, ওখানকার শীত সম্পর্কে আশা করি সবারই ধারনা আছে। আমি তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি, গ্রামের বাড়ী যেয়ে দেখি আমার বয়সী ছেলেরা সুপার ম্যানের মত গলায় তপন (সিরাজগঞ্জে লুঙ্গির আঞ্চলিক শব্দ) বেঁধে ঘুরাফেরা করছে। ছোট বেলায় ও দেখে খুব মজা পেলেও এখন তা মনে আসতেই চোখের কোণায় শিশির বিন্দু জমে উঠে। কারন তপন তারাই বাঁধতো যাদের ওই লুঙ্গিটাই শীতের একমাত্র অবলম্বন, যা দিয়ে শুধু পিঠের অংশটুকুই ঢাকা যায়। বাংলাদেশে এমন হাজার হাজার লোক আমরা প্রতিদিনই দেখি। যাদের গায়ে শীতের কাপড়তো দুরের কথা একটি পাতলা আবরণও নেই। এসব দেখতে দেখতে আমরা এখন অভ্যস্ত। তাদের দেখে আমাদের বিবেক আর জাগ্রত হয় না, অনুভূতিও নাড়া দিয়ে ওঠে না। আমাদের ভাবটা এমন, যেন এই ই নিয়ম, এটাই তাদের নিয়তি। শীত চলে এসেছে, আমরা সবাই শীতের কাপড়ের মজুত বাড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি আমার দেশের সেই সকল হতভাগাদের কথা যাদের এই শীত কাটাতে হবে রেল-ষ্টেশনে, বাস টার্মিনালে, ফুটপাতে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে অথবা আমাদের দৃষ্টি পৌছায় না এমন কোন জায়গায়।

এই হতভাগাদের দেখার মত কেউ নেই, ভাগ্যও এদের দিকে মুখ ফিরে তাকায় না।
আমরা কি পারি না তাদের জন্য কিছু করতে! আমরা কি পারি না তাদের জন্য আমাদের সহানুভূতির হাতটা একটু বাড়িয়ে দিতে!

৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×