
১৯৯২-৯৩ সালের কথা।
আমার বয়স তখন পাঁচ। আমরা থাকি ডেমরার সারুলিয়া নামের একটা জায়গায়। জায়গাটার কথা আমার এখন ভালো মনে নেই, আর যা মনে আছে বাস্তবে তা নিঃসন্দেহে অকার্যকর। আমরা যখন ডেমরায় থাকতাম তখন আশপাশ ছিলো প্রায় গ্রামের মত। মফস্বল বলতে যা বোঝায় তাও সম্ভবত প্রযোজ্য ছিল না।
ঐ এলাকার সবচেয়ে ভালো স্কুল ছিল হাজী রহমতউল্লাহ ফোরকানিয়া উচ্চবিদ্যালয় (নিশ্চিত নই নামটা ঠিক লিখলাম কি না)। চার বছর বয়সে আমাকে সেখানকার কেজি লেভেলে ভর্তি করানো হল। কিন্তু আমাকে রাখা গেলো না। স্কুল আমার জন্য যতটা বিতৃষ্ণার বিষয় ছিল, তার চেয়ে বড় সমস্যা ছিল মাকে ছাড়া থাকতে হবে সেটা। মাত্র কয়েকদিন গিয়েছিলাম ঐ স্কুলে সুতরাং ওটাকে আমার প্রথম স্কুল বলা চলে কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ।
ঐ বছর আমার আর স্কুলে যাওয়া হলো না। মা বাসায় আমাকে অ-আ-ক-খ শেখালেন। কতটুকু শিখেছিলাম তা জানি না। বাসায় হুজুরও রাখা হয়েছিল। আলিফ-বা-তা-সা ইত্যাদি চললো। আর এবিসিডি তো আছেই।
মাঝে মাঝেই বিকেলে আমরা ঘুরতে যেতাম। অনেক পাড়া প্রতিবেশীর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয়ও ছিল, যাদের সাথে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে হলে খাতা কলম হাতে নিয়ে ডায়াগ্রাম এঁকে বুঝতে হত।
এরকমই এক বিকালে আমরা যখন বাসায় ফিরছি, তখন আমার চোখে পড়ল একটা স্কুল। মোটেই আকর্ষণীয় কিছু নয়, আকারে বেশ ছোট। তবে আকর্ষণীয় একটা দিক ছিল, সেটা হল স্কুলটার ক্লাসরুমগুলোর মেঝে ছিলো একটা ছোট জলার ওপরে কাঠের তক্তা ফেলে বানানো। বাঁশের বেড়া দিয়ে ক্লাসগুলো আলাদা করা ছিলো। তবে এ বিষয়গুলো আমি খেয়াল করেছি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে। প্রাথমিকভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছিল স্কুলের আকাশী নীলরঙা সাইনবোর্ড।
স্কুলটির নাম ওরিয়েন্টাল হাই স্কুল।
আমি বাবাকে বললাম,'আমি ঐ স্কুলে পড়ব।'
চিন্তা ভাবনা করে বলা নয়, শুধু যেন আমি নীলরঙা সাইনবোর্ডটার মোহেই কথাটা বলেছিলাম।
স্কুলের সাথেই হেডমাস্টার তথা মালিকের বাসা। তিনি সপরিবারে সেখানেই থাকেন। তার একটি ছেলে, নাম ছিলো নাহিদ, সম্ভবত আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। আর ছিলো একটি মেয়ে, নাম শারমিন, আমার সমবয়সী কিংবা এক বছরের বড়।
বাবা আমার সামনেই হেডমাস্টারের সাথে কথা বললেন। কি কথা হয়েছিল জানি না, তবে আমাকে যে কোন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় নি এ কথা স্পষ্ট মনে আছে।
আমার মা কথা বললেন স্যারের সাথে। জানালেন তাঁর ছেলের অতিমাত্রায় মাতৃভক্তির কথা যার কারণে তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। স্যার বললেন,'কোন সমস্যা নেই, আমার স্কুলটি ছোট, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও কম। আপনি চাইলে ছেলের সাথে ক্লাসে থাকতে পারেন। আমার ধারণা কিছু দিনের মাঝেই সে এই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।'
সেটা সম্ভবত '৯২ এর ডিসেম্বরের দিকের কথা। '৯৩ এর জানুয়ারিতে আমি ভর্তি হলাম ওরিয়েন্টাল হাই স্কুলে, কেজি বাদ দিয়ে সরাসরি নার্সারীতে যাতে আমার ইয়ার লসের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা যায়।
আমার পরম সৌভাগ্য যে আমাকে এখনকার সময়ে বাচ্চাদের মত একদম গোড়া থেকে পড়ার চাপে পড়তে হয় নি। বইয়ের সংখ্যা ছিল কম। ফলে শৈশবের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ আমার ছিল। শিক্ষকদের মান কেমন ছিল তা বলা আমার জন্য বেশ কঠিন কারণ শিক্ষকের মান নির্ধারণ করার মত মানসিক পক্বতা আমার তখনো হয় নি। তবে বেশ কয়েকজন টিচারের পড়ানো ভালো লাগত। তাদের মাঝে ছিলেন আফরোজা ম্যাডাম, শিরিন ম্যাডাম, মিজান স্যার প্রমুখ।
জানি না আজ তাঁরা কোথায় আছেন।
স্কুলটি ছিল কোএডুকেশন। খুব দ্রুত বেশ কিছু ছেলেমেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমার শৈশব হয়ে উঠল বর্ণিল আর আনন্দময়।
তাদের কথাই লিখব পরবর্তীতে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





