বাংলাদেশের ইতিহাসে সব নির্বাচনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটে। গুরুত্ব ছিল প্রধান দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারগুলোরও। সব সময়ই কথার ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছে দলগুলো। ক্ষমতায় গিয়ে তারা প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেছে সামান্যই। পরের নির্বাচনে জনগণ কথা না রাখার শোধ তুলেছে ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু অবস্থার খুব বেশি হের ফের হয় নি। মানুষের কাছে নির্বাচনী ইশতেহার তাই প্রতারণার দলিল হিসেবেই আবির্ভূত হওয়ার কথা।
সাধারণ যুক্তিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যত বড় বড় কথাই লেখা থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত কিন্তু তা উপরের কথাগুলোর বাইরে নয়। মানুষ যে আগাগোড়া আওয়ামী লীগের কথা বিশ্বাস করেছে তা কিন্তু নয়। সে হিসেবে দেখলে আওয়ামী লীগের এত বিশাল ব্যবধানে জয়ের কোন কারণ নেই।
কিন্তু আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটিই সব হিসেব নিকেশ এলোমেলো করে দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে দুই কোটি ভোটার ছিলো যারা নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি আর তাদেরকেই মূলত ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি। সকল বিশ্লেষক মহলেই এখন খুব জোর দিয়ে বলা হচ্ছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিই এবারের নির্বাচনে একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। পরাজিত পক্ষ এই ব্যাপারটি নিয়ে ছিলো সম্পূর্ণ অসচেতন। আমি বাজি ধরে বলতে পারি - নির্বাচনের আগে বিএনপি যদি টের পেতো যে জামাতের কারণে তাদের এত বড় ভরাডুবি হতে চলেছে, তাহলে তারা নিঃসন্দেহে জোট ভেঙে দিত।
এবারে নিজের কথা বলি। কেন আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিলাম?
কারণটা সোজাসাপ্টাভাবে বলি। আজ আমি যে মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছি তার মূল্য নিজামী মুজাহিদের সন্তানেরা না বুঝতে পারে, উচ্চবিত্তের ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়া সন্তানেরাও না বুঝতে পারে কারণ তারা আসলে শুধুমাত্র নামেই এই দেশে জন্ম নিয়েছে, আসলে তারা এখানকার প্রতিনিধি নয়। তারা প্রতিনিধিত্ব করে পাশ্চাত্যের কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের। কিন্তু আমি তো তাদের দলে নই। আমি জানি আমার জীবন এই দেশে, মৃত্যুও এই দেশে। কখনো যদি বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় যাবো, কিন্তু আবার ফিরেও আসবো। আমার যোগ্যতা আছে এই দেশে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে বসবাসের, সেখানে আমি উন্নত বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার জন্য লালায়িত হব কেন?
যে কারণে আজ আমি আমার দেশে পরবাসী নই, যে কারণে আমি সামনের দিকে এগুনোর স্বপ্ন দেখতে পারি, যে কারণে বাংলাদেশ আজ ফিলিস্তিন নয়, সেই কারণটিই হল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা এর বিরোধীতা করেছিলো তারা এই দেশের শত্রু, আজ থেকে এক হাজার বছর পরেও তারা এ দেশের শত্রুই থাকবে। ইতিহাসকে কখনো ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে না।
আমি নিজে জন্মেছি মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দেড় যুগ পরে, মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে কিছু ভিডিও, বই আর ছবিতে তৈরি এক অপূর্ব রোমাঞ্চকাহিনী। আমি আমার পূর্বপুরুষের বীরত্বগাঁথা নিয়ে গর্ব করতে পারি। কিন্তু বাধা আসে শুধু একটি জায়গা থেকে। মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন যারা এর বিরোধীতা করেছিল, শুধু বিরোধীতা নয়, পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল এ দেশের মানুষের ওপরে তাদেরকে এখনও দেখি এ মাটিতে ঘুরে বেড়াতে। বছর কয়েক আগে দেখলাম আমাদের প্রাণের প্রিয় পতাকা উড়িয়ে আমাদের জাতীয় সংসদকে অপবিত্র করে চলেছে খুনীর দল। আমি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, কিন্তু আমার কানে বাজে শুধু পূর্বপুরুষের হাহাকারধ্বনি।
এ জন্যই কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম?
মনের ভেতর থেকে উত্তর পাই - না। আমার পূর্বপুরুষ এজন্য নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন নি। কোন খুনী দেশবিরোধী কেন আমার দেশকে অপবিত্র করবে?
কি উপায় ছিলো আমার হাতে? কিছুই না। সাতটি বছর শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কতকিছুই তো হল এর মাঝে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের অবস্থানের তেমন কোন পরিবর্তন হল না।
সাতটি বছর পরে আমরা শুনলাম আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি। ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, দেশের সিংহভাগ তরুণকে আন্দোলিত করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি। আজ আওয়ামী লীগ যদি এ ব্যাপারে গড়িমসী করে তাহলে তাদের পরিণতি হবে বিএনপির চেয়ও ভয়াবহ। আমার মনে হয় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। তাই হয়তোবা তাঁরা মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জামাতকে দাওয়াত দেন নি।
যারা এখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত, যারা এখনও বলার চেষ্টা করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে, তাদেরকে বলি - আপনারা দেশের মানুষের মতামতকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন না। দলীয় সংকীর্ণ চিন্তা আপনাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যদি আপনার নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন না করেন, তাহলে ইতিহাস আপনাদেরকেও আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না।
(একবারে বসে লিখলাম। মাথায় যা এসেছে তাই লিখেছি। অসংলগ্নতার জন্য দুঃখিত)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





