রাজায় সারাদেশে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষ। এ বিক্ষোভ ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই সচেতন হয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি। গতকাল এ কমিটির তোপের মুখে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ এনামুল হক। সরকারের আড়াই বছর অতিক্রাš- হওয়ার পরও লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে না পারায় কমিটির সদস্যদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন তিনি। এরই এক পর্যায়ে তাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন এক সদস্য।
এদিকে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও সারাদেশে লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ। সেহেরি থেকে ইফতার পর্যš- দফায়-দফায় লোডশেডিং হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে মহাসড়ক অবরোধসহ বিদ্যুৎ অফিস ভাঙচুর, পাড়ায়-পাড়ায় মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট এত সহজে কাটবে না। তবে ঘাটতি কিছুটা কমবে। তিন বছর পর বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে শুরু করলে বিদ্যুতের সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে আসবে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সদস্যরা প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের কাছে লোডশেডিংয়ের কারণ জানতে চাইলে তিনি পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। তিনি আরও জানান, সারাদেশে বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদা ৭ হাজার ৫০ মেগাওয়াট, এরমধ্যে ঢাকা মহানগরীর চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে বিগত জোট সরকারের রেখে যাওয়া ৩ হাজার ২৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের স্থলে গতকাল পর্যš- ৫ হাজার ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এ সময়ে কমিটির এক সদস্য বলেন, সরকারের আড়াই বছর পরও বিগত সরকারের দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালন করতে না পারলে আপনি পদত্যাগ করুন।’
পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে কমিটির সভাপতি বলেন, ‘বিদ্যুতের চলমান সমস্যা বর্তমান সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। এজন্য সরকারকে দোষারোপ করা যায় না।’ তিনি জানান, ৪০ বছরের ইতিহাসে মঙ্গলবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৫,০২৫ মেগাওয়াট। এদিকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জানায়, এর আগে ১৮ জুলাই বিদ্যুতের রেকর্ড উৎপাদন ছিল। এদিন বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৯৩৬ মেগাওয়াট। পিডিবির হিসাবে গতকাল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৫ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তবে বেসরকারি হিসাবে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সন্ধ্যায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন আবার কমে ৪ হাজার ৮০২ মেগাওয়াটে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে লোডশেডিং হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের মতো।
রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, মোহম্মদপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগ, মুগদা, বাসাবো, রামপুরা, খিলগাঁও, বনশ্রী, বাড্ডাসহ সারা ঢাকায় দফায় দফায় লোডশেডিং হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তার তুলনায় কম বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। ফলে লোডশেডিং করা ছাড়া তাদের কিছুই করা নেই। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে, পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকাগুলো থেকে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, তারা গত সোম ও মঙ্গলবার বিদ্যুৎ পেয়েছেন চাহিদা তুলনায় অর্ধেক।
পিডিবির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাসেম জানান, রমজানে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা কম। ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র নোয়াপাড়া ১০৫ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে। এছাড়া কেরানীগঞ্জ ১০০ ও আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট এবং পিকিং পাওয়ার প্লান্টের মধ্যে বাঘাবাড়ি ও দাউদকান্দি এ মাসের শেষে উৎপাদনে আসতে পারে। ফলে রোজায় মাত্র ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সোবহান বলেন, গরম বৃদ্ধি পাওয়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনের বেলা অফিস পাড়া ও মার্কেটগুলোতে এসি চালানো হচ্ছে ব্যাপকহারে। অন্যদিকে সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যš- আবাসিক এলাকায় এসির ব্যবহার এত বেশি যে, এজন্য প্রায় ৫০০ মেগাওয়াটের মতো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহƒত হচ্ছে। এসব এসির ব্যবহার বন্ধে গতকাল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যš- ডিপিডিসির ম্যাজিস্টেটের অধীনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এবং বেশ কয়েকটি সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ বহু এসির লাইন কেটে দেওয়া হয়।
বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যুতের যে সংকট চলছে তা দীর্ঘদিনের। এ সমস্যা সমাধান করতে হলে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে উৎপাদনে আসতে হবে। এই কেন্দ্রগুলো আসতে আরও অš-ত দুই/তিনবছর লাগবে। এর আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলেও সহনীয় হতে তিনবছর লাগবে। তিনি বলেন, এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করতে হবে। কিন্তু সরকার কয়লার বিষয়ে আগ্রহী নয়। তার বদলে এলএনজি ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বাজেটের কাজের বিষয়ে আগ্রহী।
পাবনার ফরিদপুর থেকে মির্জা বাসিত জানান, গতকাল দেড় হাজার গ্রাহক মিছিল নিয়ে পাবনা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-১-এর ফরিদপুর উপজেলা আঞ্চলিক কার্যালয় ঘেরাও করে। ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, যুবলীগের সম্পাদক সাইদুর রহমান ঠাণ্ডু ও ছাত্রদলের সভাপতি শাম্স উদ্দিন বাচ্চুর নেতৃত্বে এ মিছিল ও ঘেরাও কার্যক্রম চলে সকাল ১১টা থেকে ১২টা পর্যš-। এ অবস্থায় ফরিদপুর আঞ্চলিক অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওমর আলি ও তার অফিসের কর্মীরা থানায় আশ্রয় নেয়। পরে বিক্ষোভকারীরা থানার দিকে অগ্রসর হলে ওসির হ¯-ক্ষেপে পরিস্থিতি শাš- হয়। পরে বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বদাতা উপর্যুক্ত তিন নেতা, বিদ্যুৎ অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ওসির বৈঠক হয়।
এসএম ইউসুফ উদ্দিন রাউজান থেকে থেকে জানান, গতকাল দুপুরে রাউজান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর কার্যালয়ে বিক্ষোভ করে কয়েকশ গ্রাহক। রাউজান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর জিএম সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, আমরা চাহিদার অর্ধেকও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না।
সোহেল রানা সাদুল্যাপুর থেকে জানান, ৭ দিন ধরে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরে উপজেলার বাহুবলে বিদ্যুৎ না থাকায় ২ আগস্ট রাতে এলাকাবাসী ও মুসল্লিরা বিক্ষোভ মিছিলসহকারে পল্লীবিদ্যুতের সাদুল্যাপুর আঞ্চলিক অফিসের মূল ফটক ও জানালার কাঁচ ভাঙচুর করে। পরে তারা উপজেলা নির্বাহী কমকর্তার বাসা ঘেরাও করে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পল্লী বিদ্যুতের সাদুল্যাপুর এরিয়া অফিসের সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) মাসুম আহমেদ জানান, এ উপজেলায় প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া পিডিবি থেকে চাহিদা অনুয়ায়ী বিদ্যুৎ না পাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক বলেন, পল্লীবিদ্যুৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তার কিছু করার নাই। এছাড়া গত সোম ও মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের ফতুলা, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া মহাসড়ক অবরোধ করা হয় ও গাজীপুরে বিদ্যুৎ অফিস ভাঙচুর হয়। গত রোববারও বিদ্যুৎ অফিসে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




