আমাদের মা-টা ভীষন পাগল। পুকুর ঘাটে ওজু করতে গিয়ে যদি লাঠির খোঁচা লাগে কোন মতে, তবে ঘরে এসে মরিচ চিবুবে, কাসার চামচ কপালে ছুঁইয়ে পরীক্ষা করবে সাপে কামড়ালো কিনা। মার ভীষন ইচেছ হয় আবার ছোট হয়ে যেতে, তবে সেখানে একটা শর্ত আছে-আমরা তিন ভাইবোনও তার ছেলেবেলাতে সঙ্গে থাকব এবং চার মায়ে ছায়ে একসঙ্গে খেলাধুলা ছুটোছুটি করব। সবার মা-ই সন্তানদের ভালোবাসে, তবে আমাদের মা আমাদের একটু বেশিই ভালোবাসে। এমন ভীষণ ভালো পাগল মায়ের সন্তান হওয়া কম সৌভাগ্যের কথা নয়।
আমরা যখন ছোট তখন মা একটা বেতের লাঠি আনিয়ে ছিল- দুপুরে আমাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য আর পড়ার সময় ভয় দেখানোর জন্য। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। মা কাউকে হাত দিয়ে মারতে পারে না। চড়, চাপড় মারলেই তার হাতের আঙ্গুল, তালু ফুলে টুপটুপা হয়ে যায় এবং মার ধারণা ব্যাথাও করে। প্রায়ই দুপুরের পরে মা'র অফিস শেষে আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। বিছানায় দুপাশে আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে শুয়ে মা বলত,"রেডি, ওয়ান, টু, থ্রি, চোখ বন্ধ"। আমরা সবাই চোখ বন্ধ করতাম। একটু পরেই সাবধানে ঘাড় উঁচু করে দেখার পালা, কে ঘুমালো আর কে ঘুমালো না। দেখা যেত আমরা তিনজনতো বটেই মা নিজেও ঘাড় উঁচু করে দেখছে। আর তারপরেই হাসির বিস্ফোরনে ঘুমের পালা শেষ। প্রথমে মা শুরু করত আমাদের সুড়সুড়ি দেয়া। দু'টি দল হয়ে যেতাম দেখতে দেখতে। বড় বলে আমিই হতাম মার প্রধান প্রতিপক্ষ। ছোট দুটি আমার কিংবা মার দলে ভিড়ে যেত সুযোগ মত, অন্য দুজনকে সুড়সুড়ি দেবার জন্য। সমস্ত বিছানা জুড়ে হুটোপুটি। সে এক আড়ম্বরপূর্ণ দৃশ্য। এমন মজার মা কি আর কারও আছে-পারলে কেউ বুকে হাত দিয়ে বলুক দেখি?
আসল কথাটাই বলা হল না, এত ঘটা করে আনা বেতের লাঠি কখনো ব্যবহার করা হয়নি। ছোট দুটিকে মাঝে মাঝে শাসালেও ওদের হাতের ব্যাথা মার হাতে বুকে সংক্রমিত হবে বলে মা কখনও লাঠি তুলতে পারে নি।
বাবার ধারণা চাকরির সুবাদে তিনি দূরে থাকতেন বলে চাকরিজীবি মা আমাদের শাসন না করে করে নষ্ট করেছেন। আমরা তিনটি ভাইবোনই মার কাছ থেকে "ভালোবাসতে" শিখেছি। আমরা মাকে যে কতটা ভালোবাসি তা মা নিজেও জানে না। এমন ভীষন ভালো মায়ের কাছ থেকে যে সন্তানদের মাঝে পেটে খিল ধরানো হাসি রোগ আর ভালোবাসার ক্ষমতা সংক্রমিত হয়, তারা যদি নষ্ট হয়, তবে সব মায়েদের উচিত সন্তানদের এমন করে নষ্ট করা।
মাঝে মাঝে আজকাল মাকে দোষারোপ করি- “ মা, তুমি যদি আর একটু খেয়াল দিতে তাহলে হয়ত রেজাল্টটা আর একটু ভালো হত” , “ এমন একটা ভুল হয়ে গেল, মা, তুমি একটু দেখলে না”। মা খুব কষ্ট পায়, বলে, “আমি তোদের অযোগ্য মা”। কতটা ব্যাথায় সে আমরা বুঝি। শুধু মাকে কখনো বলা হয়নি, অনেক "যোগ্য" মায়ের চেয়ে তার বিবেচনা বোধ অনেক উর্ধ্বে।
সে যাই হোক, আমি ঠিক করেছি প্রথম যেদিন উপার্জনের টাকা হাতে পাব, সেদিন সব টাকা দিয়ে মার জন্য উপহার কিনব। আর কারও জন্য নয়।
মা যদি জানত! আমরা তিনটি ভাইবোন বেঁচে আছি কেবল মা এখনও নিশ্বাস নেয় বলেই..........। আমাদের চেয়ে গভীর ভাবে নিজের মাকে ভালোবাসতে কেউ পারে কিনা জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




