somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেন্টমার্টিন: বিপন্ন পরিবেশ, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

১৩ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এই দ্বীপটিকে বলা হয় বাংলাদেশের স্বর্গ । এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। উপমহাদেশে সেন্টমার্টিন ছাড়া একমাত্র ভারতের দক্ষিণে রামেশ্বরে আরেকটি প্রবালদ্বীপ রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভূমি সেন্টমার্টিন । টেকনাফ উপজেলার বদরমোকাম হতে ১০ কি:মি দক্ষিণ-পশ্চিমে মাত্র ৫৯০ হেক্টর আয়তনের ৭.৮ কি:মি: দীর্ঘ এ দ্বীপটি অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে দ্বীপটি নারিকেল জিনজিরা বা জিনজিরা নামে পরিচিত।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও এর সংলগ্ন জলভাগ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। উপকূলীয় জলরাশিতে রয়েছে প্রবাল ও শৈবালের সুন্দর সমন্বয় যা দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। দ্বীপটিতে ১৫৪ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির স্থলজ গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ৬৮ প্রজাতির প্রবাল (এরমধ্যে ১৯ প্রজাতির জীবাশ্ম, ৩৬ প্রজাতির শক্ত ও ১৩ প্রজাতির নরম প্রবাল), ১৯১ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৩৪ প্রজাতির মাছ (এরমধ্যে ৮৯ প্রজাতির মাছ প্রবালসংলগ্ন এলাকার), ৪ প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। দ্বীপে ৭৭ প্রজাতির স্থানীয় পাখি, ৩৩ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিসহ মোট ১১০ প্রজাতির পাখি ও ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এছাড়া রয়েছে চুনাপাথর, জীবাশ্মযুক্ত বেলে পাথর, কনগ্লোমারেট শিলা, চুনাযুক্ত বেলে পাথর, খোলসযুক্ত চুনা পাথর, বালুচর ও ঝিনুক পাহাড়। অমেরুদন্ডি প্রাণীর মধ্যে স্পঞ্জ, পাথরি কাঁকড়া, সন্ন্যাসী কাঁকড়া, শঙ্খ শামুক, লবস্টার, ঝিনুক ও সমুদ্র শশা দেখা যায়। দ্বীপে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ দেখা যায়। এদের মধ্যে এঞ্জেল মাছ, সজারু মাছ, রাঙ্গা কইমাছ, শুই মাছ, প্রজাপতি মাছ, সারজন মাছ, রাস মাছ, বাইন মাছ, বোল মাছ, লাল মাছ, নাককুরাল মাছ, প্যারোট ফিস, সারজন ফিস, রাস মাছ, উড়ুক্কু মাছ উল্লেখযোগ্য। সামুদ্রিক কচ্ছপের (গ্রিন টার্টল ও অলিভ টার্টল প্রজাতি) ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।
সেন্ট মার্টিনে মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকা দেখতে দেয়ালের মতো যে প্রবাল প্রাচীর দেখা যায় তা গঠিত হয় এক ধরনের প্রাণীর শরীর থেকে। প্রজাতিভেদে এদের আকৃতি ভিন্ন হয়। এরা দলবদ্ধ জীবনযাপন করে। কোটি কোটি প্রবাল জমে সৃষ্টি হয় প্রবাল প্রাচীরের। হাজার হাজার বছর ধরে এসব প্রবাল তাদের শরীরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমিয়ে থাকে। ফলে একসময় তা জমে শক্ত হয়ে যায়। এভাবেই বছরের পর বছর প্রবাল জমে আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকে প্রবাল প্রাচীর। মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকা এ প্রবাল প্রাচীর সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করে সাগরতীরের স্থলভাগকে। সুনামি কিংবা জলোচ্ছ্বাসের বিপরীতে প্রাকৃতিক দেয়ালের মতো কাজ করে থাকে এ প্রবাল প্রাচীর। প্রবাল দ্বীপ সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বনাঞ্চল যেমন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, প্রবাল প্রাচীর ও তেমনি সামুদ্রিক মাছের আশ্রয় ও খাবার যোগান দেয়।
সেন্ট মার্টিনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল প্রাচীর আজ হুমকির মুখে। এর একটি প্রধান কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। এর পাশাপাশি মানুষের অতি লোভও কাজ করছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের পানিও উষ্ণতর হয়ে উঠছে, যা প্রবাল জমার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে। পর্যটকবাহী জাহাজ থেকে নির্গত তেলের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের প্রবাল। পাশাপাশি ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে এখনও কিছু প্রবাল-শৈবাল থাকলেও অবাধে আহরণের কারণে শিগগির তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। স্থানীয় বাসিন্দারা বেআইনিভাবে প্রবাল সাগর থেকে সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন পর্যটকদের কাছে।
প্রতি বছর সেন্টমার্টিনে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক আসে। এর কারণে অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট তৈরি করা হচ্ছে। এই ছোট দ্বীপটিতে বর্তমানে রিসোর্টের সংখ্যা প্রায় ৮৮টি। এসব রিসোর্টের কোন সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। তাই আবর্জনা সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বসতি স্থাপনের মাত্রা। ১৯৭২ সালে এ দ্বীপে যেখানে ১১২টি বসতি ছিল বর্তমান সেখানে দেড় হাজার পরিবারের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষের বসবাস। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
প্রতি বছর প্রজনন ঋতুতে হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে সেন্টমার্টিন সৈকতে ডিম পাড়তে আসে কাছিম। এ সময় জেলেদের জালে আটকা পড়ে অনেক কাছিম প্রাণ হারায়। এছাড়া রাতের বেলা সৈকতে সংশ্লিষ্ট হোটেল-মোটেল ও দোকানের অতিরিক্ত আলো এবং পর্যটকদের জ্বালানো আগুনের জন্য সামুদ্রিক কাছিমের ডিম দেয়ার পরিবেশ গত পাঁচ বছরে নষ্ট হয়ে গেছে। যা সামুদ্রিক কাছিমের বংশ বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করছে।

উপকূলীয় ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে পরিবেশ অধিদফতর ১৯৯৫ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকত ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুসারে (গেজেট ১৯৯৯) সঙ্কটাপন্ন ওই এলাকায় প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক সংগ্রহ ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে মাছ, কচ্ছপ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো ধরনের কাজ; পাথুরে ও প্রবাল শিলা আহরণ, যে কোনো নির্মাণ কাজে পাথুরে ও প্রবাল শিলার ব্যবহার। এ আদেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যদিও এসব আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউই। পরিবেশ অধিদফতরেরও আইন বাস্তবায়নে তেমন আন্তরিকতাও চোখে পড়ছে না কারও।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের গর্ব। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দূরদর্শীতার অভাবে দ্বীপটি তার গৌরব হারাতে বসেছে। ইকো-টুরিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, তেমনিভাবে পর্যটনশিল্পেরও প্রসার ঘটানোও সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন দ্বীপের বাসিন্দা, পর্যটক ও নীতিনির্ধারকদের সচেতনতা। প্রকৃতির এই বিস্ময়কর দানকে আমাদের নিজেদেরই সংরক্ষণ করতে হবে এবং এখনই তার উপযুক্ত সময়।

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×