somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিপাইমুখ বাঁধ: হুমকির মুখে হাওড় নদী

৩০ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে থাকে মানুষের অদূরদর্শীতার অভাবে। তেমনই এক চিত্র দেখা যায় টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে।
টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক নদীর ওপর নির্মিতব্য একটি বাঁধ। টিপাইমুখ নামের গ্রামে বরাক এবং তুইভাই নদীর মিলনস্থল। এই মিলনস্থলের ১৬০০ ফুট দূরে বরাক নদীতে ৫০০ ফুট উঁচু এবং ১৬০০ ফুট দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ভারত নিয়ে কাজ শুরু করে। মূলতঃ বন্যা নিয়ন্ত্রণের চাহিদার জন্যই এই বাঁধের মাধ্যমে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারণাটি আসে।১৯৭৪ সালে টিপাইমুখ স্থানটিকে বাঁধের জন্য চূড়ান্ত করা হয়।
তুইভাই ও তুইরয়ং নদীদ্বয়ের মিলিত স্রোতধারায় সৃষ্ট নদীর নাম বরাক। বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশের আগে দুই ভাগে ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা গ্রামে প্রবেশ করেছে, যা পরে মিলিত হয়ে মেঘনা গঠন করেছে। বরাক বাংলাদেশের প্রধানতম নদী মেঘনার সাথে যুক্ত বলে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। সমুদ্র সমতল থেকে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার গড় উচ্চতা মাত্র ৬-১২ মিটার। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে নিম্নাঞ্চল। এখানে বৃষ্টিপাতের ধরন কিছুটা ভিন্ন হলেও অন্যান্য অঞ্চলের মতো শীতের সময় বৃষ্টিপাত খুব কম হয়। স্বাভাবিকভাবে জলাভূমিগুলোতে তখন পানি সমতল নিচে নেমে যায়। অনেক জলাভূমি একেবারে শুকিয়ে যায়। এই সুযোগে নিচুভূমিতে তখন উচ্চফলনশীল বোরো আবাদ হয়।


টিপাইমুখ বাঁধের কারণে মণিপুর ও আসামের কাছাড় জেলার প্রায় ৩০০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি ডুবে যাবে। এই বাঁধের ফলে সৃষ্ট লেকের গ্রাসে ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের আটটি গ্রামের ১৫০০ মানুষ উদ্বাস্তু হবে এবং ভূমিহারা হবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। বাঁধের পানি নিয়ন্ত্রণের ফলে বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার প্রায় ৩ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরিবেশ ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসবে যার বেশিরভাগ প্রভার টিপাইমুখের নিম্ন অববাহিকা সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার প্লাবন ভূমির মানুষকে দারুণ ঋণাত্নকভাবে প্রভাবিত করবে।
টিপাইমুখ বাঁধের ফলে বাংরাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা এবং মেঘনা নদী ব্যবস্থা শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওই নদী ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত এতদঞ্চলের সকল নদ-নদী এবং জলাশয়ের পানি শুকিয়ে গিয়ে ওই অঞ্চলের নৌ যোগাযোগ দারুণভাবে বিঘ্নিত করবে এবং একই সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে ওই অঞ্চলের মৎস্যাধার ও জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র হাওড়গুলো। একইভাবে ই নদী ব্যবস্থার আওতাধীন পুরো প্লাবন ভূমি ভূঅভ্যন্তরস্থ পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ ভয়াবহরূপে বেড়ে যাবে।
ভারত টিপাই মুক বাঁধ দিলে শুধু সুরমা-কুশিয়ারা মরে যাবে না বরং বাংলাদেশের পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল সুরমা-কুশিয়ারা নদী অববাহিকায় অবস্থিত সারা এলাকার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। সুরমা-কুশিয়ারা মরে যাওয়ার সাথে সাথে প্রমত্তা মেঘনা ধূ ধূ বালুচরে রূপান্তরিত হবে।
বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহের সব কয়টি হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল সম্পূর্ণরূপে পানিশূণ্য হয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওই অঞ্চলের বিপুল সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হাওড়-বাঁওড়ে অতিথি পাখ-পাখালি আর ওইসব অঞ্চলে আসা যাওয়া করবে না। মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা , হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী নৌযোগাযোগ ও জলসংস্কৃতি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের হাওড়-বাঁওড় সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মেঘনা অববাহিকার ৭০ ভাগ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পণ্য পরিবহন নদ-নদীর দ্বারা সাধিত হয়। আর ওই অঞ্চলের হাওড়গুলো দেশের মিঠাপানির মাছের আধার ও পরিযায়ী পাখিদের অভয়াশ্রম বলে পরিচিত। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় জাতিসংঘ ঘোষিত ’ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ এর অন্তর্ভূক্ত। বিশ্বের ১০৩১ টি রামসার সাইটের মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওড় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ আর নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এই হাওড়ের স্ফটিকস্বচ্ছ জলরাশি, বিরল এবং বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য সম্পদের এক নিরাপদ আবাসস্থল।
বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ শতকরা ৬০ ভাগ থেকে ১১০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। এই বর্ধিত প্রবাহের ফলে নৌ চলাচল, সেচ ও মৎস্য চাষের বৃদ্ধি ঘটবে কিন্তু কিছু কিছু এলাকা থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যহত হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের হাওড়গুলো শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় কৃষকেরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে ওঠে যা এই মানুষগুলোর একমাত্র শর্করার উৎস। বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকা চাষাবাদ ব্যহত হবে।
ভারতীয় বার্মাপ্লেটের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। ভ’তাত্ত্বিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল অসংখ্য ’ফল্ট ও ফোল্ড’ বিশিষ্ট এবং এই অঞ্চলে ১৫০ রিখটার স্কেলে ৭ এর অধিক মাত্রার দু’টি ভ’মিকম্প হয়েছে যার মধ্যে শেষটি ছিল টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে। বাঁধ নির্মাণের ফলে কোটি কোটি টন পানির ওজনে এমন নাজুক এবং অস্থির ভূগাঠনিক ভ’মিকম্পপ্রবণ জোনে রিখটার স্কেলে ৭.৮ কিংবা এর চেয়ে বেশি মাত্রার প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে টিপাইমুখ বাঁধ। আর এর ফলে বিপুল জলাধার ভেঙে কিংবা ভূমিকম্পের তরঙ্গের আঘাতে ঘনবসতিপূর্ণ সিলেট মহানগরীসহ সংলগ্ন অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে; ধ্বংস হয়ে যেতে পারে সমগ্র পূর্বাঞ্চলের জীবনের স্পন্দন।
তাই এ কথা সহজেই বলা যায়, টিপাইমুখ বাঁধের সাথে বাংলাদেমের অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের নদীনালা, হাওড়-বাঁওড়, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবন ও জীবিকা অনেকাংশে এর ওপর নির্ভরশীল। এ সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র ভারতের অনুরোধে এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সরকারের অদূরদর্শীতার অভাব ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:১৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×