somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নব্য দাস প্রথা ... আর আমাদের চিরনির্লজ্জ সর্বংসহা চোখের পাতা ...

২০ শে এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিভিন্ন বাসায় গিয়ে দেখি , ফুটফুটে কাজের মেয়েরা ট্রে এনে চা-নাস্তা রাখছে। কাজ করছে। ভারি ভারি কাজ। আজকে দেখলাম এক বাড়িতে, এতো বড় একটা কলসি নিয়ে ৯/১০ বছরের বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে টানাচ্ছে । আমার দেখে প্রচণ্ড দুঃখ হল। আমি বলেই ফেললাম , "পারবা তো , নাকি আমি ধরবো?" মেয়েটার তখন হাত কাঁপছে। আমার জায়গায় , আপনি হলে এই দৃশ্য দেখে এটাই করতেন।


মেয়েটি অস্ফুট স্বরে পারবো বলল। কারণ , এদের নীতিতে পারবো না বলে কোন শব্দ নেই। "পারবো না" শব্দটি ব্যবহার করলে নির্যাতন ছাড়া যে আর কিছুই জুটবে না। মনে মনে ভাবি , মানবতার কি অসীম বিপর্যয়! এই বিপর্যয় ঘটছে প্রতি মুহূর্তে , প্রতিটা ইট-কাঠের খাঁচায় , আমাদের চিরনির্লজ্জ সর্বংসহা চোখের পাতার সামনে।



এদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার একটা কথাই মনে হয় , কি সুন্দরভাবে দাসপ্রথাকে ইম্প্রোভাইজ করে , অফিসিয়াল নামটা বদলিয়ে মানুষ কাজের মেয়ে হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে।



সবাই এটা মেনে নিচ্ছে। আর বইপত্রে পড়ছে , আজ থেকে এত "শ" বছর আগে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কেউ ভুলেও একবার অনুধাবন করতে পারছে না , এটা শিশুদের দিয়ে চালিয়ে নেয়া একটা সেমি-পর্যায়ের দাসপ্রথা। নামকরণ আর সংজ্ঞা বদলেছে , সামান্য কিছু মৌখিক সুবিধা পেয়েছে - শেষমেশ থেকে গিয়েছে সেই দাসই !



আগেকার সময়ে , দাসদের কোন স্বাধীনতা ছিল না।
- এই কাজের মেয়েদের কি সেটা আছে? দুইজন অফিসে গেলে , বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে যান না ? যখন ইচ্ছা ঘর থেকে বের হতে পারে ... না পারে না। সুদূর শহরে নিয়ে যাওয়া হয় , বছর বছর একবার দেখা হয় মা-বাবাদের সাথে।



দাসদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই ?
- এদের কি আছে। কয় পয়সা বেতন দেয়া হয়? হাতে দেয়া হয় , নাকি হতদরিদ্র বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। যারা , মেয়েটিকে যখন তখন নিয়ে যেতে পারে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েটার জন্যে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দিতে পারে না। যে বাসায় কাজে দিয়েছে , সে বাসায় গেলে এমন একটা ভঙ্গিমার সম্মুখীন হয় , মেয়েটিকে ওরা যেন কিনে নিয়েছে , বাবা-মা'দের দেখে মহাবিরক্ত। আমি এটা অনেক দেখেছি!



দাসদের সাথে ব্যবহার খারাপ এবং শারীরিক নির্যাতন হয় -
- বাংলাদেশে এমন কোন কাজের মেয়ে নাই , যে কোন না কোনদিন শারীরিক নির্যাতনের ( মানসিক নির্যাতনের কথা ডাল-ভাত দেখে বললাম না) স্বীকার হয়নি। সাথে ছোটলোকের বাচ্চা আর সম্ভাব্য চোর ( যা কিছু হারায় , গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর) খেতাবদ্বয় তো পদে পদে থাকেই। অনেক উঁচা ডিগ্রিধারী থেকে শুরু করে সাধারণ চাকুরীজীবী - সবার ক্ষেত্রেই এমনটা দেখেছি। ব্যবহারের কথা নাহয় নাইই বললাম , সবচেয়ে তেল চিটচিটে চাদর, মশারি , বালিশ হচ্ছে এদের সঙ্গী। এক প্লেটে ভাত দেয়ার চিন্তাকে এখনো হাস্যকর দেখা হয় এই তথাকথিত সভ্য সমাজে। প্রাচীন জাত-পাতের যুগের মত প্লেট-গ্লাসটাও পর্যন্ত আলাদা। কি নিদারুণ বিপন্ন মানবতা। প্রত্যেকটা কথা মিলিয়ে নিন। আপনার বাসায় কোন কাজের মেয়ে থাকলে , এমনই হয়। সে আজকের রাতের ভাতটা খেয়েছে , তার নির্দিষ্ট করে দেয়া প্লেটে, গ্লাসে। এখন ফ্লোরে বিছানা করে তেল চিটচিটে বালিশ আর মশারির ভিতরে একটা ক্ষুদ্র জন্তু-জানোয়ারের সমপরিমাণ মর্যাদা নিয়ে ঘুমাচ্ছে। কথাগুলি সত্যি , অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।



ব্যতিক্রম দেখেছি এসব ক্ষেত্রে , তবে সংখ্যায় এতই কম যে সেটা উল্লেখ করার মত না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে অতিশায়ন! আর এখানে একটা কথা বলি - কাজের মেয়ে রাখা বাসার প্রতিটার গৃহকর্তা-গৃহকর্তাকে , আমি ১০০% ক্ষেত্রে ( ৯৯% নয় , ১০০% ক্ষেত্রেই) বলতে দেখেছি , আমি এই মেয়েকে কি যত্নের সাথে রাখি কল্পনাই করতে পারবেন না। যে যত বেশি বলে , সে তত অযত্নকারী এবং নির্যাতনকারী সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।



আপনাদের আর ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই - কেন একজন কাজের মেয়েকে দাস বলা যাবে কিংবা যাবে না। মানব সভ্যতা এখনো পরিপূর্ণ হয় নি , কিন্তু আমরা ভং ধরে আছি পরিপূর্ণ সভ্যতার। এই ভং ধরে থাকা , অসভ্য থাকার চেয়েও বিপজ্জঙ্ক। কারণ , অসভ্য থাকে সভ্য হওয়া যায়। কিন্তু সভ্যের ভান ধরে বসে থাকলে , ভবিষ্যতে কখনো সভ্য হওয়া অসম্ভব।




তাই প্রথম কাজ এই ভান ধরে থাকার ব্যাপারটা বোঝা। তাহলেই সমস্যা সমাধান হবে , নইলে নয়। আমি নাকি-কান্না করতে এতো কিছু লিখি নাই। লিখেছি , একটা উদ্দেশ্যে সবাই যেন এই ভান ধরে বসে থাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাহলেই , একদিন না একদিন সমস্যা মিটবেই।



এর আগে কয়েকটা প্রাসঙ্গিক কথা বলে দেই। এইসব কথাগুলি আমি অযথাই বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্সের তথ্যমতে , বাংলাদেশে নব্য দাসের সংখ্যা ৬৮০৯০০ জন ( লিঙ্ক কমেন্টে )। বিশ্ব নব্য দাস প্রথার লিস্টে বাংলাদেশ ৫৯ তম। বাংলাদেশের অবস্থা খুব ভাল নয়। তবে অন্যান্য কিছু দেশের চেয়ে ভাল। ইন্ডিয়া এই নব্য দাসপ্রথায় পঞ্চম। পাকিস্তান ষষ্ঠ। রাশিয়া ৩২তম। দাস বলতে তাদেরই বোঝায় যাদের সাথে আচার-আচরণ দাসপর্যায়ে চলে যায়। কাজের মেয়েগুলিও এই পর্যায়ে পড়তে বাধ্য। ইটভাটার শ্রমিক , দাদন খাওয়া জেলে , চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ইত্যাদি দাস পর্যায়ে পড়ে ক্ষেত্রবিশেষে। এখনো বাংলাদেশে মঙ্গা এলাকাগুলিতে শ্রমিকবাজার বসে। একমাস-দুইমাসের জন্যে শ্রমিক কেনা-বেচা হয়। আমি তাদের রিপোর্টটি পড়েছি। আপনারাও পড়ে নিতে পারেন। কথা দিচ্ছি , অবাক হবেন। সভ্যতার ভান ধরে থাকা যে কত ভয়ানক সেটা টের পাবেন।



নাকি-কান্না করার জন্যে এতো কথা এখানে বলি নাই। বলেছি , আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্যে। আমাদের বাবা-মা'দের অনেকেই যুগের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই কাজ করেন। আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না। দৃষ্টি ভঙ্গিটি সমাজে প্রচলিত। তাই , উনারা সেটাই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু, আমাদের এই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে আগাচ্ছে। এক রাতে কোনদিন সামাজিক বিপ্লব হয় না। হয় ধীরে ধীরে। এই প্রজন্মরা অন্তত প্রতিজ্ঞা করুক , আমরা নিজেরা এইরকম কাজের মেয়ে রাখবো না। যদিও বা কোনকারণে রাখি- তাহলে মনে রাখবো এরাও মানুষ। জাস্ট এইটুকুই। আমাদের বিবেক পূর্ব প্রজন্মের চেয়ে অনেক পরিছন্ন। কারণ , পূর্ব প্রজন্মরাই শিল্প , সাহিত্য , সংস্কৃতি , মূল্যবোধ এগুলো সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে। আমরা তাি , অহংকারের সাথে বলতে পারি - আমাদের বিবেক আর পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্ন বিবেক কখনো ভুল করতে পারে না। আমরাও ভুল করতে পারি না।



তাই , নিজেরা প্রতিজ্ঞা করি , আমরা কাজের মেয়ে রাখবো না। দরকার হলে , নিজের সময় কাটানো আর কাজের সঙ্গীর জন্যে মেয়ের মত করে এতিমখানা থেকে এডপ্ট করবো। তবু , কাজের মেয়ে নিবো না , আমাদের ঘরে যে কাজের মেয়েটির আমাদের তথাকথিত সভ্যতাকে প্রতিনিয়ত ধিক্কার দিয়ে চলেছে , তাদেরকে মানুষ ভাববো। জাস্ট এইটুকুই। একজন মানুষের সাথে একজন সত্যিকারের বিবেকবান মানুষ কেমন ব্যবহার করে , সেটা আমার বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ , মানুষ শব্দটার মর্যাদা একমাত্র সত্যিকারের মানুষেরাই বোঝে।

( http://www.globalslaveryindex.org/country/bangladesh )

( তথ্য , পরিসংখ্যানের ভিড়ে একটুি দুর্বোধ্য উইকিপিডিয়া টাইপ লেখা লিখতে চাই নি , তাই , এতো পরিসংখ্যান উপস্থাপন করিনি। চেয়েছি , শুধুমাত্র অনুভূতি জাগ্রত করতে। এতো তথ্য-পরিসংখ্যান জেনে কীইবা লাভ হবে , যদি না অনুভূতি না জাগে...)


সংযুক্তি - এই লেখাটা দুদিন আগে ফেইসবুকে লিখেছিলাম। আজ যখন আবার লিখছি , তখন সেই মেয়েটি বাসা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি খবরটা শুনে আরেকবার নিশ্চিত হলাম , দাসপ্রথার সাথে যে এদের তুলনা করেছি , সেটা একেবারেই ভুল নয়। )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:৫৩
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×