.
★★ আগের কথা ★★
প্রচুর চেষ্টা করেও কোনও চাকরি-বাকরি না পেয়ে অশোক জ্যোতিষী হয়ে গেল। এক মফস্সল শহরের বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা ঘর ভাড়া করল। অনেক ভেবে চিন্তে নাম নিল অস্কার শাস্ত্রী। অশোক থেকে অস্কার। নামটার মধ্যে বেশ একটা ওয়েস্টার্ন ফ্লেভার আছে। পাব্লিক খাবে। সাইনবোর্ডেও লেখা আছে, "দেশীয় ও পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে কোষ্ঠী গণনা করা হয়..."
.
সামান্য টাকা ইনভেস্ট করতে হলো। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ, গেরুয়া পোশাক, কয়েকটা জ্যোতিষ শাস্ত্রের বই।
নেটে সার্চ করে অশোক দেখল, প্রচুর অ্যাপ আছে, ডাউনলোড করে নিলেই হল। তাতে জন্মতারিখ, সময় আর জন্মস্থান দিয়ে দিলেই রাশি- লগ্ন থেকে শুরু করে পুরো ভবিষ্যত হড়হড়িয়ে বেরিয়ে আসবে।
তাহলে আর কী চাই। শুরু করে দিল ব্যবসা।
.
প্রথম প্রথম খদ্দের আসতই না। অশোক সেই সময় বসে বসে মৃতবৎসা যোগ, বিষদঘটিকা যোগ থেকে কালসর্প যোগের মতো ভয়ংকর সব অশুভ ব্যাপার- স্যাপারগুলো বই পড়ে পড়ে শিখে নিল। এই ব্যবসার এটাই মূলমন্ত্র। ভয়। ভয় দেখাও আর কবজ-তাবিজ বেচো।
অশোক অবশ্য কবজ-তাবিজ নয়, শিকড় বেচবে। ইনভেস্টমেন্ট কম। শিকড় দিয়েই কালসর্পকে কেঁচো বানিয়ে দেবে সে।
.
খদ্দের আসা শুরু হলো। অশোক তো ল্যাপটপ থেকে সব পটপট বলে দিচ্ছে। তারপরেই আসছে শনি- রাহুর দৃষ্টি বা ভয়ংকর কোনও যোগ। ব্যাস কেল্লা ফতে! মিনিমাম তিনশো টাকার শিকড় আর তিনশো টাকা ফি।
একদিন এক বয়স্ক মহিলা এসে বললেন, "আপনার শিকড়ের কী গুণ বাবা! আমার মেয়েকে পরাতেই তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।"
অশোক তাজ্জব!
আর একদিন একজন ছেলে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে এসে বলল, "আপনার শিকড় পরার পরেই আমার চাকরি লেগে গেল।"
অশোক হাঁ হয়ে গেল।
গ্রাম থেকে শাক নিয়ে এসে বাজারে বসে এক বুড়ি তাকে দিয়েই শিকড়গুলো আনায়।
বুড়ি জিগ্যেস করেছিল, "কোন গাছের আনব?"
অশোক বলেছিল যে কোনও একটা গাছের হলেই হল। ব্যাগ ভর্তি করে শিকড় এনে দেয় বুড়ি। ওকে কিছু টাকা দিয়ে দেয় অশোক।
সেই শিকড় পরে চাকরি হয়ে যাচ্ছে! বিয়ে হয়ে যাচ্ছে!
.
'গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে।'
যা হয় আর কী, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল অশোক বা অস্কার শাস্ত্রীর 'ক্ষমতা'র কথা।
তার শিকড় সুপার- ডুপার হিট হয়ে গেল। খদ্দের সামলাতে একটা ছেলেকে রাখতে হল। শহরের যত বেকার ছেলে আর বিয়ে না হওয়া মেয়েদের বাবা -মায়েদের ভিড়ে ভিড়াক্কার। ফিস্ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দিল। টাকার সুটকেসের ওজন বাড়তে লাগল হররোজ।
.
★★ আজকের কথা ★★
চেম্বার বন্ধ করে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় একজন যুবক দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল।
অশোক অবাক হয়ে বলল, "কী চাই?"
ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "আমায় একটা শিকড় দেবেন বাবা? চাকরি হওয়ার শিকড়? আমার চাকরির খুব দরকার।"
অশোক বলল, "কাল এসো।"
ছেলেটা ঝপ করে অশোকের পা ধরে নিলো। তাকে তুলে অশোক জিগ্যেস করল, "এমন করছ কেন?"
ছেলেটা বলল, "আমাকে একটা শিকড় দিন। একটা কাজ আমার চাইই চাই। মা আর ছোট ছোট তিনটে বোন তিনদিন প্রায় কিছুই খায়নি। আমার একটা কাজের খুব দরকার।"
অশোক বলল, "শুধু শিকড়-পাথরে কিছু হয় না ভাই, চেষ্টা করো ঠিক কোনও কাজ পেয়ে যাবে।"
ছেলেটা ম্লান মুখে বলল, "ও আমি টাকা দিতে পারব না বলে বলছেন? আমি টাকা দিয়ে দেব। কাজ একটা পেলেই দিয়ে দেব।"
.
...কষ্টে অশোকের বুক ফেটে গেল।
এই তো সে। কিছুদিন আগেও যে ছেলেটা যা হোক কোনও একটা চাকরির জন্য পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করেছে, লোকের পায়ে পড়েছে।
কিন্তু কী করে এই ছেলেটিকে বোঝায় যে এই অস্কার শাস্ত্রী একজন প্রতারক, যে মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধোঁকাবাজি করে যাচ্ছে। টুপি পরিয়ে রোজগার করছে। যার চাকরি হয়েছে তার নিজের ক্ষমতাতেই হয়েছে, ওই ফালতু শিকড় কিচ্ছু করেনি।
.
অশোক তার সহকারীকে বলল দরজা খুলতে।
সে আবার চেম্বারে গিয়ে ছেলেটাকে একটা শিকড় আর পাঁচশো টাকা দিয়ে বলল, "যাও মা- বোনেদের জন্য খাবার কিনে নিয়ে যাও।"
নাহ্ ঢের হয়েছে। আর নয়। আর মানুষের সঙ্গে বুজরুকি করে রোজগার করবে না। একটু কষ্টে-সৃষ্টেই থাকবে না হয়। কত মানুষই তো থাকে। কিন্তু এই মানুষ ঠকানো ব্যবসা ছেড়ে দেবে সে। কাল থেকেই... হ্যাঁ কাল থেকেই..
.
তার নতুন কেনা গাড়িতে উঠে বসল অশোক। নরম গদিতে গা এলিয়ে দিতেই এসির হিমেল ঠান্ডায় তার ক্লান্ত শরীর জুড়িয়ে গেল। বড় আরাম! ঘুমিয়ে পড়ল নিমেষেই।
বাড়ি পৌঁছে ড্রাইভার ডেকে তুলল তাকে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে সে ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে উঠল, "আজ তোমার আসতে অনেক দেরি হয়েছে। সময়ে না আসতে পারলে ছেড়ে দাও আমি অন্য লোক দেখে নেব। অপেক্ষা করতে করতে দূর থেকে আসা কয়েকজন আজ চলেও গেছে। এরকম করলে তো চলবে না। সব লাটে উঠে যাবে। কাল একটুও দেরি যেন না হয়।"
ড্রাইভার বলল, "মেয়েটার জ্বর, মাথায় জলপট্টি দিয়েছি সারারাত, তাই দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি হবে না স্যার।"
অস্কার শাস্ত্রী শুনতে পেল না... সে তখন তার পুরনো বাড়ির পাশের জায়গায় নির্মীয়মাণ নতুন বাড়ির দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে ...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১২:২৩