তখন বাঁকুড়ায় থাকি, চণ্ডীদাসে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি সাইকেলে করে, নুনগোলা রোডের মোড়টায় দেখি ঝগড়া চলছে। কার বৌ, নাকি মেয়ে কার সঙ্গে ভেগেছে, সেই নিয়ে দুই গার্জেন পক্ষের মহিলাদের ঝগড়া। আহা! সে মনোরম দৃশ্য দেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মেয়ের মা বলছে, ‘ছেলে তো নয়, যেন ধম্মের ষাঁড়! ছেড়ে রেখে দিয়েছে।’ ছেলের মা বলছে, ‘মেয়ে তো নয়, যেন ছেনালি! আমার ভোলাভালা ছেলেটাকে মাতিয়ে দিলে গো।’ আলটপকা একজন বলে বসল, ‘ব্যাটা ছেলে পাঁঠার জাত। দোষ তোমার, তুমিই মেয়েকে সামলাতে পারো নি।’ ছেলের মা তক্ষুণি বলে বসল, ‘তুমি কে হে, আমার ছেলেকে পাঁঠা বল?’ মেয়ের মা বলল, ‘তুমি কে হে আমার আজ্ঞাশাসন?’
সেদিন ইভনিং শো মিস করেছিলাম। ঝগড়া শুনতে গিয়ে অনেক শোই মাঠে মারা গেছে। কিন্তু এই ধরুন, ‘ছেনালি’, ‘ধম্মের ষাঁড়’ ‘আজ্ঞাশাসন’ এইসব শব্দ কোন সাহিত্যে পাবেন বলুন? ‘আজ্ঞাশাসন’ মানে বুঝতে আমাকে দীর্ঘ গবেষণা করতে হয়েছিল। এই সব ঝগড়াঝাঁটি শুনেই আমার ভোকাবুলারি হেবি বেড়ে গেছে, যেটা বর্তমানে আমার ফেবু-লেখক হিসাবে খুব কাজে দেয়।
আমার ছোটবেলার দিনগুলো, তখন ইন্টারনেট তো ‘দূর কি বাত’, টিভিও ছিল না। নাগালে সিনেমা হল ছিল না, খবরের কাগজ ছিল না, অথচ দিনগুলো কী বর্ণময় ছিল এই চলতি ঝগড়াগুলোর কারণে। মেগাসিরিয়ালের মতো চলত সেগুলো। আমরা খবর নিতাম, আজ শিশুলখি আর তার ভাগিনবৌএর ঝগড়াটা কোনদিকে টার্ন নিল, মানবাজারের খুড়ি উঠোনে বেড়া উঠল কি না, কাবিবুড়ির হাঁসচুরির কেসে নাজ্জামাইকে গাল দিচ্ছিল, বদলে নাতনি বুড়ির ওলাউঠা কামনা করছিল, সে হাঁস উদ্ধার হল কি না; এই সব করেই দিন কেটে যেত।
পাড়ায় আমাদের উঠোনটা বেশ বড় ছিল, গোবর দেওয়া নিকানো উঠোন, আর ইজি এন্ট্রান্স ছিল সদর রাস্তা থেকে; তো অনেক ঝগড়ার দুএকটা সিন আমাদের উঠোনেই অভিনীত হয়ে যেত। দুই পক্ষই তাদের বক্তব্য শুনিয়ে যেত, আর আমার ঠাকুমা, ‘বটেই তো, তুমি ঠিকই বলেছ রঘুনাথপুরের বৌ! সে আর বলতে।’ এই সব বাঁধা বুলি আওড়াতো।
ব্যাটাছেলেদের মধ্যে ভালো ঝগড়ুটে ছিল আমাদের হেমুদাদু। গাভাসকারের মতো স্টেডি ব্যাটসম্যান। তবে সত্যি কথা কী, হেমুদাদুর ঝগড়াটা আমার ঠিক পোষাতো না। বেশিরভাগ তার প্রতিপক্ষ তার গিন্নি, আর ওই গাভাসকারের মতোই, কখন যে রান নেবে, বোঝাই যেত না! মিনিটখানেক ঝগড়ার পরই হয়তো বলে দিল, ‘যাঃ! আর খাবোই না!’
ব্যস্। এই স্ট্রোকটা মিস হয়ে গেলে জানতেই পারতাম না ঝগড়া চলছে। হঠাত হয়তো খবর পেলাম, ‘আজ চার দিন চলছে, হেমুদাদু অনশনে।’ খবর পেয়ে আমরা তার বোনকে খবর দিতাম; বোন এসে চপ খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করাতো।
হেমুদাদু গাভাসকার হলে জগুদাদু ছিলেন শ্রীকান্ত। জগুদাদু দিনমানে খুব রসিক লোক। আমার তো দারুণ বন্ধু ছিল। আমি, আমার লঙ্গোটিয়া লালু, বছর চারেকের ছোট আনন্দ, আর জগুদাদু, চারজনা শ্রাদ্ধ ভোজের পার্টনার ছিলাম। আগ্নেয়গিরি সদৃশ লুচির পাহাড়, চূড়ায় গলিত লাভার মতো ধূমায়মান বুটের ডাল আর পর্বতপাদদেশের কিঞ্চিৎ পরিমাণ রক্ত মরিচ লাঞ্ছিত ম্যাগমা সদৃশ ডিংলার ঝাল কীভাবে নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যেত; সেসব গল্প না হয় অন্যদিন হবে।
তা জগুদাদু ঝগড়া করত রাত্রে। সন্ধেবেলায় ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে একটু ‘ব্যোমভোলে’ করে এসে ঝগড়াটা বাড়িতে বেশ চুটিয়েই করত। একবার সে ঝগড়া বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে, জগুদাদুর হাতে পেল্লাই লাঠি, ঘুরছে শনশন্, শনশন্, আর ডাক করে করে নিজের মাথা বাঁচিয়ে চলেছে জগুগিন্নি। দুচারজন দর্শকও উপস্থিত; কেউ বলছে, ‘সাবাশ জগুগিন্নি, সাবাশ। দুকদম বাঁয়ে, বাঃ। কী সুন্দর স্টেপ।’ কেউ বলছে, ‘জিও জগুকাকা, আধ ইঞ্চির জন্য মিস হয়ে গেল! একটু বাঁদিক ঘেঁসে চালাও।’
তো আমিও গেছি দর্শক হিসাবে, আমার দাদাও। দাদা তখন ষোলো সতেরোর জোয়ান, একটা লাফ দিয়ে জগুদাদুকে জাপটে ধরতেই জগুগিন্নিও লাফিয়ে পালালো। জগুগিন্নি বলল, ‘তুই না থাকলে যে আজ কী হত!’ আর জগুদাদু বলল, ‘শ্লা দাঁত থাকলে কামড়ে দিতাম ছেলেটাকে!’ তারপর স্বামী-স্ত্রী হাত ধরাধরি করে বাড়ি ঢুকে গেল।
তখনকার দিনে প্রায় সব পাড়াতেই দু-একজন করে দজ্জাল মহিলা থাকত, ত্রিসীমানায় চিল কাওয়া বসতে পারত না তাদের ব্যাবহারে। তবে এরা খুবই অহিংস ও গান্ধিবাদী ছিল। এদের প্রধান অস্ত্র ছিল গালি, আর তার সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি। আলাদা আলাদা গালির সঙ্গে আলাদা আলাদা মুদ্রা আলাদা আলাদা অঙ্গ দিয়ে নিপুণভাবে উপস্থাপন করত। সমাজে এদের আলাদা কদর ছিল। পাশের বাড়িকে টিট দিতে হবে, বে-পাড়া থেকে এদের একজনকে সকাল সকাল ভাড়া করে নিয়ে আসুন। চাহিদা এদের বেশি না; জলখাবার-খাওয়া দাওয়া, আর পান দোক্তা। ব্যাস, সারাদিনের জন্যে প্রতিপক্ষকে উথালি-পাথালি করে রেখে দেবে।
প্রাতঃস্মরণীয় এই সব মহিলারা হারিয়েই গেলেন সমাজ থেকে।
আমার ফ্রেন্ডলিস্টে তো সেরকম আর কেউ নেই।