১.
জীবন আসলে কিছু অর্থহীন সময়ের সমষ্টি মাত্র। এই ভাবনার পোকাটা কবে যে আমার মাথায় এসে বাসা বেধেছে- ঠিক মনে করতে পারি না। তবে ইদানিং প্রায় এটা সময়ে অসময়ে নড়াচড়া করে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
অস্বস্তি বলছি এই জন্য, ভাবনটা আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায় এই অর্থহীন জীবন বয়ে নেয়ার কোন যুক্তি নেই। সমাপ্তি টানা প্রয়োজন। কিন্তু সমাপ্তি টানার সহজ স্বাভাবিক কোন প্রক্রিয়া আমার জানা নেই। কিংবা বলা যায় আমি ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না। তাই ব্যাপারটা অনেকটা ইয়েস-নো, নো-ইয়েস এর মতই হয়ে গেছে যেটা অস্বস্তিকরই বটে।
২.
এডমিন বিল্ডিং এর একই ফ্লোর দুই দুইটা লিফট। অথচ পুরো বিল্ডিং জুড়ে কোন লোকজনই তেমন চোখে পড়ে না। সারাক্ষন পিন পতন নীরবতা। সাথে পুড়া আগরের গন্ধ। বাছাই করা অনেক দামী আগর নাকি এখানে পুড়ানো হয়। অথচ দাদু যখন মারা গেল তখন পাড়ার দোকানের সস্তা যে আগরবাতি জ্বালানো হয়েছিল সেটার গন্ধও এরকমই ছিল। আগর পুড়ার গন্ধ তাই আমার ভেতর 'মরা বাড়ী মরা বাড়ী' এরকম একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি ঢুকিয়ে দেয়।
আমি ১১ তলা থেকে নীচে নামব। আমাকে 'ডাউন অ্যারো' চিহ্নিত বাটনে চাপ দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চাপল। সিদ্বান্ত নিলাম নিজে থেকে বাটন চাপব না। অপেক্ষা করব যতক্ষন না পর্যন্ত পর্যন্ত দুইটা লিফটের যেকোন একটাতে এই ফ্লোরে কেউ একজন আসে।
অপেক্ষা করছি। কেউ আসে না। অনেকক্ষন হয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে এটা কি ধরণের পাগলামী। এভাবে অযথা সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
পরক্ষণেই আবার মন বলছে, ধুরো!! তুমিই তো মনে করো, তোমার জীবন আসলে কিছু অর্থহীন সময়ের সমষ্টি মাত্র। তাহলে এখন আবার সময় নষ্টের কথা বলছো কেন?
হুম..ভেবে দেখলাম, কথা ঠিক। অর্থহীন সময় থেকে আরো কিছু সময় নষ্ট হলে কি এমন ক্ষতি হয়। আমি তাই অপেক্ষা করি।
বেশ..অনেকক্ষণ পরে একটা লিফট উপরে উঠে আসতে দেখি। আমি যে ফ্লোরে দাড়িয়ে আছি সেখানে আদৌ থামবে কি না কে জানে। তারপরও আমি আড়মোড় ভেঙ্গে নড়েচড়ে উঠি। ভেতরে একধরণের অন্যরকম অনুভূতি হয়। অনেকটা দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বড়শীতে মাছ ধরার মত।
লিফট এসে থামে। আমি ঠিক লিফটের সামনে গিয়ে দাড়াই। টিং করে একটা শব্দ হয়। দরজাটা দু'পাশে ধীরে ধীরে আলাগ হয়ে যায়। আমি তাকিয়ে দেখি ভিতরে এক অপরূপা সুন্দরী দাড়িয়ে। আর কেউ নাই। সে শুধু একা। তার রোদ চশমাটা মাথার উপরে চুলের সাথে আটকানো। আমি চমকে, থমকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকি তার দিকে ।
মনে হয় আমি শুধু একা না, সাথে পুরো পৃথিবীও থমকে আছে। তবে বাস্তবতা হলো থমকে যাওয়া ক্ষনটা বেশীক্ষন স্হায়ী হয় না।
সুন্দরী যখন 'হাই!' বলে মিষ্টি হেসে সামনে পা ফেলেন তখন বাধ্য হয়ে আমাকে সরে দাড়াতে হয়।
হাই এর জবাবে 'হ্যালো!' বলে সরে দাড়াতে দাড়াতে তার চোখের দিকে আমার চোখ পড়ে। নীল নয়নের কথা অনেক শুনেছি। এই প্রথম কোন নীল নয়না কে দেখলাম। সত্যি অদ্ভুত! ঘোর তৈরি করার মত সৌন্দর্য বলা যায় নিসন্দেহে।
৩.
লিফটে উঠি। GF(গ্রাউন্ড ফ্লোর) লেখা বাটনে চাপ দিতে দিতে মনে হয় এরকম একজন GF (গার্ল ফ্রেন্ড) আমার জীবনে থাকলে কবিতা জন্ম দেয়ার জন্য আমাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হত না। অন্যসময় অন্যকোথাও হলে এই নীল নয়নার সুতীব্র সৌন্দর্য আর আমার ভাবাবেগের সঙ্গমে একটা কবিতার ভ্রুন তৈরি হয় যেতে পারতো। কিন্তু পুড়া আগরের গন্ধ তখন আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে সঞ্চারিত। অনেক চেষ্টা করেও তাই আমার কবি সত্তাকে জাগাতে পারিনা। বরং নিজের অজান্তেই এক ধরণের কষ্টবোধের জন্ম হয় আমার মাঝে। খানিকটা বিষন্নতাও। এটা কি শুধু কবিতার ভ্রুন তৈরির ব্যর্থতা? না কি নীল নয়নাকে এই জীবনে দ্বিতীয়বার না দেখার যন্ত্রনা- ঠিক বুঝতে পারিনা। এক রাশ কষ্টকে সঙ্গী করে নিয়েই লিফটের সাথে সাথে আমিও পতিত হতে থাকি।
৪.
লিফট কিছুদূর নীচে নামার পর হঠাৎ গড় গড় শব্দ করে থেমে যায়। আমি অবাক হই এরকম তো হবার কথা না। প্রতি সপ্তাহে এদের স্বাস্হ্য পরীক্ষার জন্য লোকজন আসে। কোথাও সমস্যা হলে ঠিক করে যায়। তাহলে কি এই ব্যাটা লিফটও 'নীল নয়নার' জন্য মন খারাপ। এটা মনে করে নিজে নিজে হাসি। হাসি থামিয়ে হালকা ঝাকুনি দেই। না..লিফটের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বিভিন্ন বাটনে চাপাচাপি করি। না..এবারও কিছু হয় না। কি করা যায় ভাবছি। এমন সময় হঠাৎ দেখি, লিফট উপরে উঠতে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পরে থেমে যায়, আবার সাথে সাথে গড় গড় শব্দ করে দ্রত নীচে নামতে থাকে।
লিফটের ভেতরে যে ডিসপ্লে আছে সেটার দিকে চোখ পড়তেই মনে হল আমার মেরুদন্ডের মধ্য দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। ডিসপ্লেতে তখন দেখাচ্ছে..out of service।
কি হবে, কি করব ভেবে পাচ্ছি না। আজ কি তবে আমার শেষ দিন? আহ! জীবনে কত কিছু এখনো বাকী রয়ে গেল। যে আমি ভাবতাম জীবন কতগুলো অর্থহীন সময়ের সমষ্টি, তার কাছে জীবন কে তখন খুব আপন মনে হতে লাগলো। মনে হল বেচে থাকা চরম এবং পরম পাথেয়।
হঠাৎ লিফটটি থেমে যায়। থেমে গেলে দরজাটি নিজ থেকে খুলে যাবার কথা। কিন্তু খুলে না। ম্যানুয়ালি দরজা খোলার জন্য যে বাটনটি আছে সেখানে চাপাচাপি করি। কাজ হয় না। এবার দুহাত দিয়ে লিফটের দরজাকে দুপাশে নেয়ার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হই। আবার চেষ্টা করি। এভাবে বেশ কয়েকবার চেষ্টা পর দরজা কিছুটা ফাঁক হয়। সেখান দিয়ে দেখি কোন একটা ফ্লোরের মাঝামাঝিতে আছি। কোনমতে শরীরটাকে সেই ফাঁক দিয়ে গলিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি।
তারপর জোরে জোরে হাটতে থাকি। পিছন দিকে আর তাকানোর সাহস পাইনা। বার বার কেন জানি মনে হচ্ছিল, কে যেন প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পেছন ফিরলেই বলবে..তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। শেষ মূর্হতে উপর থেকে নির্দেশ আসায় এবারের জন্য ছেড়ে দিলাম। যাও পারলে জীবনের বাকীটা সময় কাজে লাগাও।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১১ রাত ২:১৫