somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার ভাবনার তারগুলো,

২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার ভাবনার তারগুলো, চিন্তার সূত্রগুলো আস্তে আস্তে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। আমার গবেষণাকে মনে হলো নতুন একটি বাঁকে এসে আটকে গেছে। আমরা কি দৃশ্যমান সমস্যার সমাধান ও সম্ভাবনা খুঁজতে গিয়ে মূলত কোনো সংকট বা সমস্যার মধ্যেই কানামাছির নির্ধারিত উড়ালের জায়গাটুকুতে জিম্মি হয়ে উড়ছি? নাকি বেঁচে থাকার একটি অলক্ষ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অপ্রস্তুতভাবে অতিক্রান্ত হচ্ছি জোড়াতালির দ্রুতলয়-বর্তমানের শরীর বেয়ে বেয়ে ঠেলে দেওয়া আশাহীন ভবিষ্যতের অতলান্ত ও অন্ধকার গহ্বরে? আমরা কি আমাদের মতো করে বেঁচে থাকতে পারছি? নাকি আমাদেরকে কারো ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে? আমাদের জীবন ও বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে কি কেউ অলক্ষে চালিত করছে আমাদের বদলে তাদেরই মর্জি, ইচ্ছা ও প্রয়োজনের জন্যে? এ তো এক ঘোষণাহীন যুদ্ধই; যেখানে সুসজ্জিত ও সুপরিকল্পিত প্রতিপক্ষ আমাদেরকে ঘুমন্ত ও অজ্ঞাত অবস্থায় রেখে প্রতিনিয়ত হনন করছে, হত্যা করছে, নিঃশেষ করছে!
মানসিকভাবে সদ্য-উত্থিত নানা জিজ্ঞাসার প্রক্ষেপে শারীরিকভাবে আর বসে থাকতে পারছি না আমি। আমার সমগ্র চেতনাপ্রবাহ আর চিন্তামণ্ডলী তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমি এই সমাজ চিন্তকের কাছ থেকে অতিদ্রুত বিদায় নিয়ে উদ্‌ভ্রান্তের মতো রাতের প্রায়-নিমগ্ন পথে নেমে এলাম। ভূতে পাওয়া একজন একাকী-নিঃসঙ্গ মানুষের মতো আমি হাঁটছি নগরীর প্রশস্ত এভিনিউ দিয়ে নদীস্রোত ও মানব-মানবীর স্রোতের মিলিত ধারার দিকে। আমার মগজের ভেতরে ভাবনার উত্তপ্ত ও টগবগে আরেকটি লেলিহান দুশ্চিন্তার তৃতীয় স্রোতের নবজন্ম হয়েছে।
মগজে নবসৃষ্ট তৃতীয় স্রোতে ভেসে এসে নাড়া দিলো একটি বিখ্যাত উক্তি : ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি’। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন দ্য রিয়েল ওয়ার গ্রন্থে এমন কথাই বলেছিলেন গত শতাব্দীর শেষ পাদে এসে। বলেছিলেন : ‘দুনিয়া নিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকে কেবল সামরিক দিক দিয়ে দেখলে তা হবে প্রাণঘাতী ভ্রান্তি। ‘প্রকৃত বন্ধু’কে লড়তে হচ্ছে অনেক ফ্রন্টে। এ লড়াই চলছে অর্থনৈতিক ফ্রন্টে, চলছে ভাবনা ও আদর্শের জগতে, গোপন কাজকর্মে ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে, চলছে তা প্রচারণার ক্ষেত্রে। পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত বিভিন্ন বিশ্বাস ও ব্যবস্থার বিভিন্ন রণক্ষেত্রে চলছে এ-লড়াই। সামরিক দিক থেকে আমরা বিপুলভাবে সেরা হতে পারি; কিন্তু তা হলেও অর্থনৈতিক, আদর্শগত ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা হেরে যেতে পারি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এ-লড়াইয়ে হেরে গেলে আমরা ‘প্রকৃত যুদ্ধে’ হেরে যাব।’
শুধু নিক্সন কেন, পরবর্তী প্রতিনিধিগণ, বুশ ও ওবামারা পর্যন্ত নানা স্তরে মার্কিন ও তার মিত্রবর্গের স্বার্থের যুদ্ধটি অব্যাহতভাবে চালিয়েই যাচ্ছেন। এই অদৃশ্য যুদ্ধরত বিশ্বব্যবস্থায় আমরা কী করছি; আর আমিই বা কী করবো? চরমভাবে বিভ্রান্ত ও এলোমেলো বোধ করছি আমি। সিদ্ধান্তহীনতার স্খলিত পদক্ষেপে আমি কী আমার নিয়োগকারী প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের লোভ ও লাভ-চমকিত বিনিয়োগের কথা বলবো; নাকি সন্তর্পণে চলমান বেঁচে থাকার যুদ্ধের রক্তস্রোতের কথা জানিয়ে প্রস্তুতির ডাক দেবো?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ইতিহাস কি তাহলে আবার ফিরে এলো? মসলিনের হাত ধরে ঔপনিবেশিক প্রেতাত্মাদের দৌরাত্ম্যে? নাকি পুনর্জন্ম হলো, প্রত্যাবর্তন হলো ঐতিহাসিক বিশ্ব-সংকটের? যে বিশ্ব-সংকটের গহ্বরে ওঁৎ পেতে আছে আমাদেরও বহু বিপদ। যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে ধস, পুঁজির সংকট, বিক্রয় বাজারের সঙ্কোচন, উৎপাদন হ্রাস, প্রকৃত আয়ের ধারাবাহিক নিম্নমুখী প্রবণতা, ব্যাপক ছাঁটাই ও কর্মসংস্থানের সংকোচনের মধ্যে।
সন্ধ্যায় আলাপরত ভাবুক-অধ্যাপক কথায় কথায় ঠিকই বলেছিলেন, নীল বা দানিয়ুব বা মিসিসিপি বা ইরাবতী অথবা হোয়াং হো বা কর্ণফুলীর স্রোতের ছুটে চলার মতো, সেসব নদী-স্রোতেরই ধারাবাহিকভাবে জীবন-সংগ্রামরত মানব-মানবীর ছুটন্ত স্রোতের মতো, বিশ্ব অর্থব্যবস্থা - যার অন্য নাম পুঁজিবাদ, তাকেও অনিবার্যভাবে প্রতিনিয়ত ছুটতে হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র ও প্রান্তে প্রান্তে বাজার আর মুনাফার খোঁজে; প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধন করে চলতে হচ্ছে উৎপাদনের হাতিয়ার আর তার প্রযুক্তিতে, উৎপাদন পদ্ধতিতে এবং প্রক্রিয়ায়। সমপ্রসারণ ও বিস্তৃতির এই সীমাহীন ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদ তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও ব্যবস্থাটিকে কায়িক হলেও টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, গড়ে তুলতে পেরেছে প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির এক তথাকথিত ‘সোনালি স্বপ্নের মায়া’। কিন্তু বাস্তবে সেই সোনালি স্বপ্নটাই দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক চোরাবালির স্তূপের ওপরে। বাঁকসর্বস্ব বিপুল সমৃদ্ধির মধ্যেই নিহিত আছে এক চরম ও অমীমাংসেয় দ্বন্দ্ব। সেটাই বিশ্ব অর্থব্যবস্থা বা পুঁজিবাদের অনিবার্য সংকটের মূল উৎস। সেই দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণের ফলেই ১৯২৯-৩০ সালে সমগ্র দুনিয়াকে নিয়ে পুঁজিবাদ নিমজ্জিত হয়েছিল এক অভূতপূর্ব বিরাট সংকটে। ইতিহাসের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতেই কি শুরু হয়ে গেছে সেই সংকটের এক নতুন পর্ব, নবতর ঘূর্ণাবর্ত?
সংকট হতে পারে, সংকট হয় এবং এর উত্তরণও ঘটে। কিন্তু ঘাপলাটা অন্যত্র। গবেষণার শেষ পর্যায়ে এসে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সংকটের বিপদ সম্পর্কে আমাদেরকে কিছুই বলা হচ্ছে না। না মালিকপক্ষ, না শ্রমিকপক্ষ, না সরকারপক্ষ; কেউই খারাপ খবরটি আগাম জানানোর দায়িত্ব নিতে নারাজ। প্রস্তুতির প্রসঙ্গ তো দূর অস্ত! বদলে বরং জানানো হলো দুনিয়ার অর্থনৈতিক রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ ‘বিশ্বায়ন’ নামক একটি চমৎকার নাটকের শিরোনাম সম্পর্কে বহু তত্ত্বকথা ও উচ্ছ্বাস। বিশ্বায়নকে তুলে ধরা হলো ‘নতুন যুগের অর্থনীতি’রূপে। এবং বিশ্বায়ন হয়ে উঠল নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক তত্ত্বের মূল কর্মসূচি। চারিদিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনি হতে শোনা গেল এর তীব্র প্রচার ও প্রশংসা। বলা হলো, এই নতুন অর্থনীতি আমাদের সামনে খুলে দেবে অভূতপূর্ব-নজিরবিহীন ‘গতিশীল’ একটি বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : বাজারই যেখানে প্রভু - দুনিয়াকে যা পৌঁছে দিচ্ছে এবং দেবে অবাধ সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের জগতে। প্রশস্ত করবে অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক প্রগতির পথকে। এবং এভাবেই প্রমাণিত হবে যে, পুঁজিবাদী বিশ্বায়নই মানুষের অগ্রগতি ও মুক্তির সঠিক ঠিকানা –
সমাজ-ইতিহাসের চূড়ান্ত ও সর্বশেষ অধ্যায়!
কী মর্মান্তিক ভুল স্বপ্নের জগতে আমাদেরকে বসবাস করতে বাধ্য করা হলো এবং হচ্ছে! মৌলিক বাস্তবতা তীব্রতর হয়ে হঠাৎ ঘটল কী প্রলয়ঙ্করী কাণ্ড!! এ কী অদ্ভুত প্রত্যাবর্তন!!! মাত্র দু-আড়াই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে চরম হুলস্থূল বেধে গেল এই নতুন যুগের তথাকথিত অর্থনীতিতে, বিশ্বায়নে!!!! এই নতুন দুনিয়ার প্রধান পরিচালক বা মূল স্বর্গরাজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হাবুডুবু খেতে লাগল চরম অর্থনৈতিক সংকটের অথই সাগরে। তাবৎ পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯২৯-১৯৩০ সালের ‘বিরাট মন্দা’জনিত অর্থনৈতিক সংকটের পর আজকের মতো বিরাট ধাক্কা ও সংকট আর কখনো আসেনি বলে সাদা চামড়ার পণ্ডিতেরা অবশেষে বাধ্য হয়ে সত্য তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে রূঢ় আতঙ্কটিও প্রকাশ করলেন। করবেনই না কেন! কতই আর আড়াল করবেন বাস্তব-সত্য! দেখা গেল প্রথমে ধস নামতে শুরু করে ফটকাবাজির ওপর নির্ভরশীল মার্কিন আর্থিক সংস্থাগুলোতে। সেই ফটকাবাজিকে বাঁচাবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল খোদ মার্কিন সরকার। লাখ লাখ ডলার ঢেলে দেওয়াও হলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেওয়া করের টাকা থেকে। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় ভূমিকাকে শূন্যতে নামিয়ে রাখার পক্ষে সবচেয়ে বড়ো উকিল স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বুশ তোড়জোড় শুরু করলেন ব্যাংকসহ বিপদগ্রস্ত সংস্থাগুলোতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে। তবু সংকটের তীব্রতা কমেনি; বরং বেড়ে গেছে বহুমাত্রায়। এবং অগ্নিময়-লাভাস্রোতের মতো গলগল ছড়িয়ে পড়ছে দুনিয়ার উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সমস্ত দেশেই।
মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ধাবমান দাউদাউ আগুনের চেয়েও অগ্নিগর্ভ একটি লেলিহান বিপদের তাড়া খেতে খেতে আমি এবং আমার মতো সংখ্যাহীন মানুষ নিজেরই অগোচরে পৃথিবীব্যাপী হাঁটছি, দৌড়াচ্ছি, পালাচ্ছি। বাস্তবে চেয়ে দেখি হাঁটতে হাঁটতে আমি চলে এসেছি শহরের একপাশে সমুদ্র-মোহনায়, নদীস্রোত সমান্তরাল মানব কিংবা মানবী স্রোতের সঙ্গমময় আলোড়ন-ঘেরা আমার গবেষণার কেন্দ্রস্থলে। আমি চলছি আর পাশে আমারই সঙ্গে সঙ্গে অবিরাম বয়ে চলছে কর্ণফুলীর স্রোত। চলছে আমাকে ঘেঁষে বাড়িমুখী শ্রম-বালিকাদের পরিশ্রান্ত ফিরতি স্রোত। তাদের হাতে খাবারের থলি, টিফিনের বাক্স, পথ-বাজার থেকে কমদামে কেনা শাক-সবজি ও মাছের সামান্য কিছুটা। বামে নদী, বন্দর, জেটি আর ডানে সারি-সারি গার্মেন্টেসের মধ্যে থেকে উত্থিত স্রোত মনে হলো যৌথভাবে আমাকে ভাসিয়ে নেবে কোনো অজানা, অনিশ্চিত গন্তব্যে। রাতের নদীতে চিকচিক করছে নোঙর-করা জাহাজের ছিটকানো আলোকমালা। গার্মেন্টসের ভেতরেও আলোর ঝিলিক। সুইং মেশিনগুলোর কবরের কফিনের মতো স্তব্ধ পাটাতনে নিত্য কাজের শেষে নিজেদের অঙ্গুস্তানা খুলে রেখে এসেছে শ্রম-বালিকারা। তাদের উন্মুক্ত হাতে এখন জীবনের সওদা। মসলিন-শিল্পীদের মতো হাতের আঙুলগুলো কর্তিত ও বিদ্ধ হয়নি তাদের, হবেও না হয়তো। এই তথাকথিত আধুনিকতা ও মানবাধিকারের চিৎকারে হয়তো অবশেষে তাদের শ্রমমাখা হাত, হাতের পবিত্র অঙ্গুলি রক্ষা পাবে। কিন্তু চারপাশ থেকে ঘিরে-আসা অক্টোপাসের মতো বহুমুখী-অগ্নিপ্রভ সংকট থেকে কি তারা বাঁচতে পারবে! যে-ধাবমান সংকটের কথা জানে না শ্রম-বালিকারা; তাদেরকে কিছুই জানানো হচ্ছে না যে জ্বলন্ত বিপদ সম্পর্কে; তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধটুকু গড়ার সুযোগটিও কি পাবে তারা!! কুলসুম এবং তার সহকর্মীরা!!!
কুলসুম এখন কোথায়? আমি চারপাশের ভিড়াক্রান্ত স্রোতের মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজতে চেষ্টা করি। ওকে পেলে হয়তো তাদের প্রস্তুতি না-হোক, অপ্রস্তুতির বিবরণটুকু জানা যেত। গবেষণার শুরুর দিকে ইপিজেডের গেটে ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম কুলসুমের। তার সঙ্গে ছিল আরো কয়েকজন সহকর্মী। তারা কেবলমাত্র জানে মাসের খরচের হিসাব : বাড়িঅলার টাকা, দোকানের পাওনা, বাজারের ব্যয়, মায়ের ওষুধ, ভাইয়ের বেতন, সন্তানের দুধ আর জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষুদ্রতম মুহূর্তের যুদ্ধের খবর। আমাকে বিশেষ সময় পর্যন্ত তারা দিতে পারেনি। বলেছিল, ‘বেশি কথা জানতে চাইবেন না। বাসায় অনেক কাজ। সেখানে জীবন থেমে আছে। আমাদেরকে তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই স্তব্ধ জীবনকেও চালাতে হবে।’ কারখানা থেকে সংসার পর্যন্ত জীবনের চাকা সচল রাখার যুদ্ধ করতে করতে নিজেই যে অচল হয়ে যাচ্ছে সে কেন আন্তর্জাতিকভাবে ধেয়ে-আসা আরো একটি একতরফা যুদ্ধের মধ্যে পড়বে! যে জানে না, যাদের জন্যে উদয়াস্ত শ্রম ঢেলে যাচ্ছে সে, তারাই তাকে অজান্তে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে একটি সম্ভাব্য একপক্ষীয় যুদ্ধের ঘোরতর বিপদের অভ্যন্তরে।
বিশাল সমুদ্র প্রবল বাতাসের প্রাচীর নিয়ে সামনে এসে না-দাঁড়ালে আজ আর মনে হয় আমার হাঁটা শেষ হতো না। আমি হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের প্রযত্নে এসে থমকে যাই। আমি এখন দাঁড়িয়ে নদীর মোহনায় সমুদ্র-শোভিত পতেঙ্গার উপকূলে। আমার সামনে আর কোনো পথ নেই। শুধুই অথই জলরাশি। উপকূল রক্ষাবাঁধের সদস্য একটি ব্যর্থ ও পরাজিত জ্যামিতিক কংক্রিট খণ্ডের ওপর বসে সামনে দেখছি কেবলি জল-বেরি আন্ধার। আমি আর কোনো গবেষণা-ফলাফল আমার চোখের সামনে কিংবা ভাবনার বিন্যাসের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি দেখছি চলমান চলচ্চিত্রের এক একটি এপিসোড। পূর্বসূরি মসলিন-শিল্পীদের কর্তিত অঙ্গুলি থেকে যেভাবে টপটপ করে ঝরেছিল রক্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায়, সেভাবে শ্রম-বালিকাদের হৃদয় থেকে বয়ে যাচ্ছে রক্তস্রোত ভবিষ্যতের অনাগত পৃষ্ঠাগুলোর দিকে। নদীস্রোত আর মানবস্রোতের যূথবদ্ধ সমান্তরাল ধারার সঙ্গে এই সমুদ্র-উপকূলের চিরায়ত মোহনায় এসে যুক্ত হয়েছে শ্রম-বালিকাদের বিক্ষত হৃদয় থেকে উৎসারিত রক্তস্রোতটিও। নদী, মানব ও রক্তের স্রোতধারার সঙ্গে এসে মিশেছে আন্তর্জাতিকভাবে ধেয়ে-আসা অগ্নিগর্ভ-লাভাস্রোত, যার সম্মিলিত প্রতাপ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে; আমার চারপাশের টালমাটাল সব কিছুকে; উপদ্রুত আমাদের সবাইকে; সারা দেশ এবং সমগ্র বিশ্বকে।
সৈকতের নৈঃশাব্দিক অন্ধকারের ভেতর থেকে আচমকা নিকষ-কালো-দানবীয় একটি নাঙা প্রশ্ন আমার টলোমলো-ভাসমান অস্তিত্বের সামনে এসে হিমালয়ের উচ্চতায় দাঁড়ালো। সে যেন মহাজাগতিক পৃথিবীর কাছ থেকে অলক্ষ উপস্থিতিতে অনতিশ্রুত কণ্ঠে অন্ধকারের পর্দা ছিঁড়ে জানিয়ে গেল : ‘সাবধান! তোমাদেরকে এখন জোরপূর্বক হাজির করানো হয়েছে কতিপয় স্বার্থান্ধ, সুযোগসন্ধানী, ধান্ধাল ও তথাকথিত-অগ্রসর এবং তথাকথিত-আধুনিক-মনুষ্য-সৃষ্ট প্রলয়ঙ্করী ‘নূহের প্লাবনের’ সীমাহীন বিপদ ও সংকটের সামনে!!’
আমাদের বসবাসের এই পৃথিবীর কাঠামোতে চতুর্দিক থেকে ধেয়ে-আসা এক-একটি অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎপাতের লকলকে স্রোত প্রবাহের দিগ্বিদিকশূন্য-মাতাল-আক্রমণের ভয়ে, আতঙ্কে, উত্তেজনায় কম্পমান আমি পালিয়ে যাওয়ার একটি পথও খুঁজে না-পেয়ে প্রার্থনায় অবনতচিত্তে মনে মনে বলি, হে খোদা, তুমি আমাকে, আমার সকল অস্তিত্বকে, আমার সমস্ত চেতনাপ্রবাহকে আবার মাতৃক্রোড়ে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। সেখান থেকে আরো গভীরে, আরো নিরাপদে, আরো ঊর্ধ্বাকাশে, আরো দূরের কোনো অচেনা আকাশে; সেই আকাশের ওপরের আকাশে, তার চেয়েও ওপরের আকাশমণ্ডলীতে এবং এর আরো অনেক সীমাহীন ওপরের কোনো রুহের নিরাপদ জগতে; যেখান থেকে স্মৃতির ঝাপসা অবলোকনে সমগ্র পৃথিবীকে ধ্বংসকুণ্ডের বদলে সৈকতের বালুকাবেলার শিশুদের খেলাঘরের চেয়েও অস্পষ্ট, অচেনা কিন্তু নিরাপদ দেখায়। চিরদিনের চিরচেনা মেঘলোক, তারামণ্ডল, নিসর্গ-প্রকৃতি, আকাশের নীলিমা, সমুদ্রের নীল এবং অতিচেনা অতি আপন মানবমণ্ডলী - এ সবকিছু অনেক দূরের, অনেক অপরিচিত, তবু হন্তারক বলে মনে না হয়। কোনো প্রাচীন পর্যটক আবার কখনো যদি ফিরে আসেন এখানে, তবে এই দেশটিকে যেন তিনি চিনতে পারেন। ভালোবাসতে পারেন আগের মতোই। গর্বভরে বলতে পারেন, ‘এই তো আমি! অপরাজিত মানুষের দেশ, বাংলাদেশে এসেছি।’
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:১২
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×