লেখাটি ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়।
"কিসে ভুল হলো?"
১৯৭২ সালে নব-প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান বীরের সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। তিনি তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। গত সপ্তাহে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছেন। দু'টি ঘটনার মাঝখানের ক'বছরে তার সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মোহ কেটে গেছে এবং সোনার বাংলার স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে। কিসে ভুল হলো?
মুজিবের ট্রাজেডি এই যে, চার বছরেরো কম সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর উচ্চতম মর্যাদা হারিয়েছিলেন। তার বিপর্যয়ের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রধানত তিনটি উপকরণ মিশে আছে।
প্রথমত, সামরিক বাহিনীর প্রধান হওয়া সত্ত্বেও মুজিব সেনাবাহিনীকে অবিশ্বাস করতেন। সেনাবাহিনীর এবং বাংলাদেশ আন্দোলনে প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে, এমন অনেক সামরিক অফিসারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার কোনো সুযোগ তিনি ছাড়তেন না। স্পষ্টতই তাদের ওপর তিনি গোয়েন্দাগিরি চালাতেন।
মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে অনুগত উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত, সুসজ্জিত ইউনিফর্মধারী রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রেশস্ত্রে, বেতন-ভাতায় ব্যয়-বরাদ্দে সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হতো। উভয়ের মধ্যে স্বার্থের অনেক সংঘাতেই মুজিব অন্ধকারে রক্ষীবাহিনীকে সমর্থন করতেন।
অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, সেনাবাহিনী সম্পর্কে দীর্ঘদিনের সন্দেহ ও ভীতি থাকা সত্ত্বেও মুজিব গত বছর পাচার ও দুর্নীতি উচ্ছেদ অভিযানে সেনাবাহিনীকেই নিয়োগ করেছিলেন। তার এই রাজনৈতিক চাতুরি মারাত্মকভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।
এতদিন সেনাবাহিনী সরকারের অবৈধ কার্যকলাপের কথা গল্প-গুজব শুনেছে মাত্র। এবার তারা এর ব্যাপকতার মুখোমুখি দাঁড়াল। দুর্নীতি নির্মূল অভিযানে বাধা এলো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। এতে তাদের অসন্তোষ আরো বেড়ে গেলো এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের আক্রোশ নিবদ্ধ হলো মুজিবের ওপর।
সেনাবাহিনীর সাথে মুজিবের বিরোধের ফলে একটি ঘটনা ঘটে যাতে গত শুক্রবারের সামরিক অভ্যুত্থানের মুখপাত্র মেজর ডালিম জড়িত ছিলেন। এক বিয়ের অভ্যর্থনা মজলিষে `মুক্তিবাহিনী'র এই বীর যোদ্ধার পত্নীকে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের প্রধান ও মুজিবের বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র গাজী গোলাম মোস্তফার ভাই অপমান করেন। মেজর ডালিম প্রতিবাদ করলে মোস্তফার ভাই একদল গুণ্ডা এনে সমবেত মেহমানদের সামনে ডালিম-দম্পতিকে বলপূর্বক উঠিয়ে মোস্তফার বাড়িতে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে অবিলম্বে তিনটি লরি বোঝাই তরুণ সিপাহি মোস্তফার বাড়ির উদ্দেশ্যে ধাওয়া করে। গোলমাল আশঙ্কা করে মোস্তফা মেজর ডালিম ও তার পত্নীকে নিয়ে মুজিবের বাসভবনে উপস্থিত হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই দু'পক্ষ মুখোমুখি হলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ডালিম-দম্পত্তিকে মুক্তি দিলেও মুজিব তরুণ অফিসারদের 'বিশৃঙ্খলার' জন্য তীব্র ভৎসনা করেন। এখানেই শেষ নয়। ক'মাস পর মুজিব নয়জন অফিসারকে বরখাস্ত করেন এবং প্রশংসনীয় সার্ভিস রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও মেজর ডালিমকে মাত্র ২৮ বছর বয়সে অবসর করিয়ে দেন। এই ভূতপূর্ব মেজরই গত শুক্রবার ভোরে মুজিবের ;স্বৈরতন্ত্রে'র অবসানের খবর ঘোষণা করেন।
মুজিবের পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশ শাসনতন্ত্র ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবমাননা অনিশ্চয়তাসূচক প্রমাণিত হয়েছে।
'এক হাজার মসজিদের শহর' বলে ঢাকা বরাবরই গর্ব করেছে এবং বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি ধর্মানুরাগী। অপর দিকে বাঙালি মুসলমানরা উপমহাদেশে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা অবিচলিতভাবে সমর্থন করেছিল বলেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল।
এই পটভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারাতি জনসমর্থন লাভ করেছেন। গত শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য কারফিউ উঠিয়ে দিলে মসজিদে এই জনসমর্থন অভিব্যক্ত হয়েছে।
তৃতীয়ত, মুজিব ক্রমেই জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। আওয়ামী লীগের মোসাহেবরা তার চারদিকে এমন বেষ্টনী গড়ে তুলেছিল, যার ফলে জনসাধারণের সাথে তার কোনো সংযোগ ছিল না।
স্পষ্টতই এই বিচ্ছিন্নতা চরমে পৌঁছল যখন এ বছর তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র বিলোপ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ও রাশিয়ার একদলীয় ব্যবস্থার সংমিশ্রনে এক অদ্ভুত শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করলেন। মূলত ব্যক্তিগত শাসন পাকাপোক্ত করার জন্যই তা করা হয়েছিল। বাংলার মানুষ, যারা তিন পুরুষ ধরে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে, তারা এটা বরদাস্ত করতে পারেনি।
গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও মুজিব তার নিজের উদ্দেশ্য সাধনে অবিচলিত ছিলেন।
পরিহাস এই যে, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায়ও মুজিবের কথায়ই বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে এবং তার কথাই ছিল দেশের আইন। এ ক্ষমতা ও মর্যাদা বাংলার মানুষ জাতির জনককে সরল মনেই দান করেছিল। মুজিব যখন এ দান আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যক্তিগত করে নিতে চাইলেন তখনই তারা বিদ্রোহ করল। ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপে তার ওপর আঘাত এলো। আর কোনো পথ ছিল না। মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখা ভয়ানক বিপজ্জনক হতো।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




