somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ: আহমদ ছফা, কিস্তি ১

০৪ ঠা জুলাই, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একজন সাহিত্যস্রষ্টার সবচাইতে বড় হাতিয়ার তাঁর ভাষা। ভাষার মধ্যেই তাঁর প্রাতিস্বিকতার অনেকখানি নিহিত। একজন লেখক বা কবি যে ভাষারীতিটি প্রকাশমাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেন তাতেই তাঁর সবটুকু পরিচয় ফুটে ওঠে। সাহিত্যের প্রাণবস্তুর মধ্যে নতুন কোন উপাদান যুক্ত হলে ভাষা ব্যবহারের ভঙ্গীতে অবশ্যই তার ছাপ পড়বে। সাহিত্যের প্রাণ এবং প্রকাশরীতি এ দুটো কোন আলাদা ব্যাপার নয়। ‘পুরনো বোতলে নতুন মদ’ পরিবেশন করার প্রচলিত প্রবাদটি সাহিত্যের বেলাতে কোন অর্থই বহন করে না। নতুন সাহিত্যের নতুন প্রকাশরীতি চাই, নইলে নতুনকে চেনার উপায় থাকে না।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় প্রচলিত পয়ার-ত্রিপদী এ সকল ছন্দ তাঁর প্রতিভার প্রকাশমাধ্যম হওয়ার অযোগ্য বিবেচনা করেছিলেন। কারণ মাইকেল প্রখর অনুভব শক্তি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যে নতুন মূল্যমান-সম্পন্ন কাব্য-ভাবনার বিকাশ ঘটাতে যাচ্ছেন বঙ্গদেশে প্রচলিত কাব্যভাষার মাধ্যমে তা আদৌ সম্ভব নয়। এই ভাষারীতি মাইকেলের জীবনানুভূতির মর্মবেগ ধারণ করার উপযোগী নয়। সেই কারণে মাইকেলকে নতুন একটি কাব্যভাষার কথা ভাবতে হয়েছিল। ভেতরের এই আত্যন্তিক সৃষ্টিশীল চাপ তাঁকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল। সেই অপূর্ব ছন্দ-তুরঙ্গম ধারণ করার উপযোগী আনকোরা নতুন কাব্যভাষা তাঁকে নির্মাণ করতে হয়েছিল।
মাইকেল বঙ্গ-সাহিত্যে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তুলনারহিত জঙ্গমতার সৃষ্টি করেছিলেন। একেবারে কথ্যভাষাকে অবলম্বন করে প্রহসন লিখে একটা হুলস্থুল কাণ্ডও ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তথাপি একথা বলা বোধকরি অসঙ্গত হবে না, মধুসূদনের যাবতীয় সাফল্য পরবর্তী বাংলা কাব্য বিকাশে খুব একটা ফলপ্রসূ প্রভাব রাখেনি। তবে তাঁর গদ্য রচনার কথা স্বতন্ত্র। মাইকেল প্রচলিত ভাষারীতিকে দুমড়েমুচড়ে ভিন্নরকম প্রকাশক্ষমতা-সম্পন্ন ভাষা-শরীর যে নির্মাণ করা যায় সেরকম একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এ কৃতিত্ব মাইকেলের একার। বাংলা কবিতার পরবর্তী বিকাশে মাইকেলের প্রভাব রক্তসূত্রের মত ক্রিয়াশীল থেকেছে, একথা বোধ করি বলা চলে না। অনন্য কাব্যসৌধ নির্মাণেই মাইকেলের শক্তি এবং মনোযোগ নিবিষ্ট ছিল। তাঁর অঘটন-ঘটন-পটিয়সী প্রতিভা কাব্যের যে আদর্শ নির্মাণ করল মাইকেল-পরবর্তী কবিকুল কেউ সে আদর্শ আয়ত্ত্ব করতে পারেনি। তাঁর ভাষাশৈলী অনুকরণ-অনুসরণ করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার মধ্যে এনেছিলেন দ্যুতি। তাঁর সাধনায় বাংলা কবিতার ভাষা বিমূর্ত ভাব এবং চিন্তা ধারণ করার মত নির্ভারতা অর্জন করেছিল। তিনি বাংলা কবিতার জমিনে এতদূর নিবিড় কর্ষণ করেছিলেন। তার ফলে ভাষার সীমানায় বিস্তার এবং স¤প্রসারণ ঘটেছে অনেকদূর। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এলেন, যেখানে মুখের ভাষার সঙ্গে লেখার ভাষার, পণ্ডিতজনের ভাষার সঙ্গে প্রাকৃতজনের ভাষার, চিন্তার ভাষার সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে ভাষার একটা সেতুবন্ধন রচনা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে বহুমাত্রিক প্রকাশভঙ্গীর বাহন করার যোগ্য মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠা দান করেন। ভাষার মধ্যে স্বাধীন চিত্তবৃত্তির সাবলীল স্ফূর্তির যে ক্ষেত্র রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন সেই বিষয়টা স্মরণে না রাখলে বাংলা ভাষায় কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব পূর্বাপর সম্পর্করহিত একটা খাপছাড়া ঘটনা মনে হবে। বাংলা কাব্যগগনে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব নানা কারণেই একটা যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলা কবিতার বিকাশধারায় নজরুল একটা চমৎকার ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে বিষয়ে সাহিত্য-সমালোচকদের অনেকেই একমত। তাঁর সাধনার সিদ্ধির ব্যাপারে মতান্তর থাকতে পারে, কিন্তু শক্তি সম্বন্ধে মতদ্বৈধতার অবকাশ অল্পই আছে।

সে যাই হোক, বর্তমান রচনাটি নজরুলের কাব্যের উৎকর্ষ-অপকর্ষ নিরূপণের উদ্দেশ্যে লিখিত নয়। সমস্ত সীমাবদ্ধতা, অসম্পূর্ণতা এবং অসঙ্গতি সত্ত্বেও কবি হিসাবে, মানুষ হিসাবে, যুগনায়ক হিসাবে কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই একজন অনন্য পুরুষ। এই অনন্যতার একটি পরিচয় তিনি কবিতা, গান, এমনকি গদ্য রচনায়ও যে ভাষারীতিটি ব্যবহার করেছেন, তার মধ্যে মূর্ত করে তুলেছেন। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে নজরুলের ব্যবহৃত ভাষারীতিটির একটি ঐতিহাসিক-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে।


ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে শুরু করে আধুনিক যে ভাষাটি গিরিগাত্রের সংকীর্ণা স্রোতস্বিনীর মত বিকশিত হতে হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবধি এসে ভরাযৌবনা প্রমত্তা পদ্মার আকার ধারণ করেছিল, নজরুল ইসলাম সেই ভাষাতেই গান-কবিতা রচনা করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে শুধুমাত্র এটিকেই কাজী নজরুল ইসলামের অনুসৃত ভাষারীতি বলে স্বীকার করে নিলে, আজকের দিনে আমরা নজরুল সাহিত্যের অভিনবত্ব বলতে যে জিনিসটি বুঝি বা বোঝাতে চাই, তার উপর সুবিচার করা হবে না।
সচরাচর সাহিত্য-সমালোচকেরা প্রায় সকলেই একটি অভিধা নজরুলের বেলায় প্রয়োগ করে থাকেন। তিনি এন্তার আরবী-ফার্সী শব্দ বাংলা ভাষায় সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। এসকল বিভাষী শব্দের প্রয়োগ-নৈপুণ্যের ব্যাপারে নজরুলের দক্ষতা তাঁর সময়কার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বা মোহিতলাল মজুমদার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক। এটা নিছকই বাইরের ব্যাপার, তার পরেও কিন্তু অনেক কথা থেকে যায়। নজরুলের আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহারের বেলায় তাঁর একটা গাঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে, কোন কোন সময় সেটা এক ধরনের অনমনীয় জেদ বলেও মনে হয়। মোহিতলাল কিংবা সত্যেন দত্তের কাছে আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহার ছিল এক ধরনের স্বাদ পাল্টানোর মত ব্যাপার। কবিতার প্রকাশভঙ্গীর মধ্যে বৈচিত্র্য এবং ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মোহিতলাল-সত্যেন দত্ত আরবী-ফার্সী শব্দ বাংলা কবিতায় নিয়ে এসেছেন। প্রমথ চৌধুরী মশায় ফিরনির মধ্যে কিসমিসের মতো গদ্যের মধ্যে আচমকা দু-একটি আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহার করে যে ধরনের চমক সৃষ্টির ওস্তাদি দেখাতেন, অনেকটা সেরকম।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:১৭
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×