মাইজদী ঘুরে এলাম কয়েকদিন আগে। ছিলাম সপ্তাহখানেক। এতো দীর্ঘ সময় মাইজদীতে থাকা হয়নি অনেকদিন। এই সময়টায় দেখলাম ঘুরে ঘুরে মাইজদী শহরকে। পরিবর্তন হয়েছে মাইজদী। অবকাঠামো নগরায়নে শহরটি পরিপক্ক হচ্ছে। সুরম্য অট্টালিকা হচ্ছে। কিন্তু শহরে মৌলিক পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়েনি। নাগরিক সুবিধা ঠিক আগের মতোই রয়েছে।
এখন বর্ষা মৌসুম। প্রায় বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে প্রধান সড়কটির সংস্কার কাজ চলছে। মাইজদী বাজার থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত কোন যানবাহন ঠিক মতো চলতে পারছে না। বৃষ্টিতে কাদায় রাস্তার অবস্থা এবড়ো-থেবড়ো। গাড়ির চাকা আটকে পড়ছে মাঝে মাঝে। তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের জ্যাম। মাঝে মাঝে দেখলাম ছোট-বড় দুর্ঘটনাও হচ্ছে। আর রিকশাওয়ালারা ভাড়া বাড়িয়ে তুলছে অসম্ভবভাবে।
এতোদিনেও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমাধান না হওয়ায় আশ্চর্যই হলাম। মাস্টার পাড়ার আবাসিক মালিকরা আছে বিপাকে। নতুন নতুন বিল্ডিং নির্মাণ হওয়ায় পানি নামানোর কোনো জায়গা আর ব্যবস্থা নেই। রাস্তায় জমে উঠছে পানিতে। সৃষ্ট হচ্ছে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা। দেখলাম আবাসিক মালিকদের মধ্যে চলছে হাহাকার। এক প্রতিবেশীর সঙ্গে আরেক প্রতিবেশীর দ্বন্ধ হচ্ছে এ নিয়ে। এ সমাধান খুব প্রয়োজন তাড়াতাড়ি। সৎ চিন্তা, প্রকৃত উদ্যোগ এবং আন্তরিক অংশগ্রহণ থাকলে কি না সম্ভব!
কয়েক বছর আগে এনআরডিএস’র সহায়তায় নোয়াখালী নাগরিক ফোরামের একটি সভা হয়েছিল এলজিআরডি মিলনায়তনে। তৎকালীন সংসদ সদস্য মোহম্মদ শাহজাহান সহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন সেদিন। জলাবদ্ধতা নিয়ে সবাই বলেছে। আমি ফোর পেয়ে বলেছিলাম, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকলে শহর কখনো উন্নয়ন হবে না। শাহজাহান সাহেব সেদিন আমার এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার বাস্তবায়ন আমরা দেখলাম না। শুধু কথার ঝুলি।
দুই.
বিশাল বিশাল অট্টালিকা। অট্টালিকার উপর শোভা পাচ্ছে স্পেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইটালী, জার্মানীর বড় বড় পতাকা। বিশ্বকাপের পূর্ব মুহূর্ত এখন। চারিদিকে উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা সবার বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে। অট্টালিকার উপরে পতাকাগুলো দেখে ভাবলাম মাঝে মাঝে, আমার দেশের পতাকা কী এইভাবে শোভা পায় এমন আঙ্গিনায়। বাংলাদেশ তো এখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলে। আমাদের সমর্থন ঠিক এইভাবে প্রকাশিত! যখন পাকিস্তান আর বাংলাদেশের খেলা হয় তখন আমাদের কেউ কেউ পাকিস্তান সাপোর্ট করে। আবার যখন ভারতের সাথে বাংলাদেশের তখনও ভারতকে সমর্থন প্রকাশের নিলর্জ্জতায় ডুবে থাকে কেউ কেউ। এ আমার দেশপ্রেম!
তিন.
আদৃতা। আমার ভাগনি। তিন বছরে সে পরেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত সিসিমপুরের কল্যাণে আদৃতা এখন কাগজের নানা ব্যবহার জানছে। তার কাছে গেলে এক টুকরো কাগজ নিয়ে বায়না ধরে, ‘মামা একটা নৌকা বানাও তো। প্লেন বানাও তো।’ আমি হাসি এইসব বায়নায়। স্মৃতি রোমন্থন খুব স্পর্শ করে, পিছন ফিরে যাই ছোটবেলায়। আমরা শিখেছি কাগজে নৌকা বানানো, প্লেন বানানো, ফুল বানানো, আরো কত কিছু। অনেক মজা আর আনন্দ ছিলো এসব বানানোর মধ্যে। খেলতাম এসব নিয়ে। উড়াতাম কাগজের প্লেন। কারটা কত উপরে প্লেন উড়তে পারে তার প্রতিযোগিতা ছিলো।
ছোটবেলায় ঘুড়ি উড়াতাম। রঙিণ কাগজ কিনে বিভিন্ন রকম ঘুড়ি বানাতাম। মেলা বা বাজার থেকে নাটাই, সুতো কিনে আমরা উড়াতাম। বাল্ব, কাঁচ ভাঙা, আঠা দিয়ে মাইঞ্জা বানিয়ে সুতোতে লাগিয়ে ঘুড়ি কাটাকাটি করতাম। ঘুড়ি বেশি উড়াতাম বলে আব্বু একবার নাটাই ভেঙে ফেলে। পরে আম্মু নাটাই কিনে দেয়।
ছোটবেলা থেকে আমি আর আমার ছোট ভাই বাবু (আশিক) স্ট্যাম্প জমাতাম। আমাদের দাদু (নানা) বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক, প্রধান পরীক থাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে খাতা আসতো। চিঠি আসতো। আমরা খাতার প্যাকেট থেকে ডাকটিকেটগুলো খুলে জমাতাম। সঙ্গীতা নামে জিলা স্কুল সন্নিকটে একটি দোকান ছিলো তখন। সেখানে বিদেশী স্ট্যাম্প বিক্রি হতো। পয়সা জমিয়ে স্ট্যাম্প কিনতাম। দুটো কি তিনটে স্ট্যাম্পবুক হয়েছিল আমাদের স্ট্যাম্পগুলো। প্রায় শ খানেক দেশের ডাকটিকেট সংগ্রহে ছিলো আমাদের। জাতীয় পর্যায়ে ডাকটিকেট জমানো প্রতিযোগিতা হতো তখন। ইচ্ছা ছিলো আমরাও তাতে অংশ নিবো। স্ট্যাম্প জমানোর নেশা দেখে আব্বু একদিন আমাদের চোখের সামনে স্ট্যাম্পবুক পানিতে চুবিয়ে ছিড়ে ফেলে। আমাদের ইচ্ছা ও আগ্রহের সমাধি হয়। পরে মেজ ফুফু ঢাকায় গেলে স্ট্যাম্পবুক কিনে দেয়। কিন্তু আর স্ট্যাম্প জমানোর আগ্রহটা আর হয়নি।
আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে হয় যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আহারে আদৃতার মতো শিশুরা এখন বঞ্চিত। ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আমার এই ভাবনাটা মিলে যায় মেঘেদের কাছে। আকাশে প্রায় কালো মেঘেদের আনাগোনা। বৃষ্টি হবে, ঝড় হবে-এমন আবেদন আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে।
চার.
বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ো বাতাস হচ্ছে। তার ভেতর দিয়ে আকাশে বিদ্যুত খেলছে। অনেক সুন্দর আর মাতাল বৃষ্টি। এরকম বৃষ্টি ঢাকা শহরে দেখা যায় না। অনেকদিন আমার দেখা হয় না। আমার চিলে কৌঠাটি টিনের চালে তৈরি। সেখানে বৃষ্টির টিপ-টাপ শব্দ অপূর্ব লাগছিলো। অনেকদিন শোনা হয় না মাদল ছড়ানো বৃষ্টির শব্দ। প্রাণভরে শুনছিলাম আমি। ছাদের উপর বৃষ্টির পানি জমে গিয়েছিলো অনেক। পানিতে পা ছোঁয়াতেই অদ্ভুত অন্যরকম ভালো লাগছিলো। মুহূর্তগুলো যেন হারায় ছেলেবেলায়। বৃষ্টি হলেই কাঁথা মুড়িয়ে থাকতাম। নইলে পাড়া দাপিয়ে বেড়াতাম। স্কুল পালানো তো ছিলই। মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষা তেল দিয়ে মুড়ি মাখানো আর ভুনা খিঁচুড়ি-সেতো ভোলাই যায় না। ঠিক এই মুহূর্তও আমার খিঁচুড়ির লোভ পাচ্ছে। সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীত।
আমার জীবনে বৃষ্টি একটি অন্যরকম কাকতালীয় ব্যাপার। যেদিন প্রথম আমার লেখা সংবাদ ছাপা হয় সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল। আমার কবিতা জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল সেদিনও বৃষ্টি। যেদিন আমার সম্পাদনায় লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয় সেদিনও বৃষ্টি। যেদিন সুমী মারা যাওয়ার খবর পাই সেদিনও বৃষ্টি। আমার ভালো কিংবা খারাপ সংবাদে বৃষ্টি কাকতালীয়। চোখের পানিগুলো আজ অঝোর ...
টেবিলের উপর পড়ে ছিলো এক টুকরো কাগজ। কাগজটির চোখ যেতেই আদৃতার কথা মনে পড়লো। নিজের মধ্যে আদৃতার ছায়া পেলাম। কাগজ নিয়ে তৈরি করলাম দুটো নৌকো। নৌকো দুটো ছেড়ে দিলাম ছাদে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে।
বৃষ্টির জল হাসছে, নৌকো ভাসছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



