ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। একই পাড়ার ভেতর। এক সাথে খেলেছি। পড়ালেখা করেছি। এক সাথে হেসেছি। আর কেঁদেছি আড়ালে। সে পড়তো অন্য স্কুলে, আমি পড়তাম আরেকটি স্কুলে। কখনোই একই স্কুলে ছিলাম না আমরা। তারপরও সকাল-বিকাল দেখা হতো। মাঝে কিছু সময় কিছুটা যোগাযোগ বিছিন্ন ছিল, তখন আমরা চট্টগ্রাম ছিলাম ব’লে।
তাদের পরিবারের সাথে আমাদের পারিবারিক একটি বন্ধন ছিল, কী সামাজিক, কী আত্মীয়তায়। যখন ইচ্ছে ছুটে যেতাম তাদের বাসায়। পড়ালেখার জন্য হোক, আর অন্য যে কোন কারণেই হোক। এ আসা-যাওয়ায় কোন সীমাবদ্ধতা ছিল না। কোন বাধা ছিল না। তার মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
কথা কম বলতো। আর যখন কথা বলতো, কথাগুলো হতো নরম আর মসৃণ। একটা সরলরৈখিক ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলতো সে। দেখতো নিষ্পাপ, ঠিক পুতুলের মতো সুন্দর।
যার কথা বলছি তার নাম সুমী। মা-বাবার খুব আদুরে ছোট মেয়ে সে।
সুমীর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর কয়েকবারই তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। দেথে মনে হতো বেশ সুখে আছে। তার একটি ছেলেও হল। ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে-আসছে। দেখা হতো, কথা হতো।
দুপুর বেলা সেদিন, আমি স্বভাবগতভাবেই আমি হাঁটছি মাস্টার পাড়ায়। প্রাইমের একটি অ্যাম্বুলেন্স মাস্টার পাড়া থেকে দ্রুতগতিতে বের হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর দেখলাম সুমীদের বাসার কিছু মানুষ আছে। কিছু বুঝে উঠতে পারি নি। সুমীর বোনের স্বামী প্রাইমের প্রকল্প প্রকৌশলী। হয়তো অ্যাম্বুলেন্সে করে তারা কোথাও যাচ্ছে। আর অনেকদিন ধরে শুনছিলাম সুমীর মা অসুস্থ। এইরকম ভাবনার মধ্যে ছিল আমার সেদিন।
পরের দিন সকালে নাজমুল (হুদা) পাপ্পু ভাই ফোন করেছে। সুমীর ফুফাতো ভাই তিনি। জিগ্যেস করলেন, তুমি কিছু জানো নাকি! আমি বললাম, কই কিছু জানি না। তারপর তিনি জানালেন খবরটা।
দুইদিন আগে খুব বিষ্টি হয়েছে। রোদের কোন ঝলক ছিল না। বাচ্চার বয়স তখন দেড়মাস কী দু’মাস। বাচ্চার অনেক কাপড়। শুকানো জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে কাপড় শুকাতে দেওয়া হলো। সেখান থেকে শুকনা কাপড় আনতে গিয়ে সুমীর গায়ে আগুন লেগে যায়। এ আগুন তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সে চিৎকার করে, কিন্তু প্রথমে কারোর কানে ঠিক পৌঁছে নি। সুমী তেলাপোকা-কে ভয় করতো। সবাই ভেবেছিল হয়তো তেলাপোকা দেখে ভয় পাচ্ছে। ক্রমাগত আর উচ্চস্বরে চিৎকারে তার মা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সুমী অগ্নিদ্বগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। তারপর তাকে প্রাইম হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে রাজধানীর সিটি হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।
এ খবরটি শুনে তো আমি বাকরুদ্ধ। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। হাত-পা সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গা-টা ছমছম করে উঠল। নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না কোনভাবেই।
পাপ্পু ভাই জানালেন, ডাক্তার ৭২ ঘণ্টার সময় দিয়েছে। এর মধ্যে ১২ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন। এবি পজিটিভ। খুব জরুরি।
রক্তের জন্য ছুটোছুটি। আমি আর পাপ্পু ভাই সব জায়গায় খোঁজ লাগালাম। রেডিও-তে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। পত্রিকায় জানানো হলো। ব্লগে লিখতাম তখন। সেখানেও জানানো হল। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। সাড়া পাওয়া গেল না খুব একটা। রক্তের অভাব সেই সময় টের পেলাম। যদিও কিছু জায়গা জায়গা অপ্রতুলভাবে পাওয়া গেল।
৭২ ঘণ্টা পার হয়। আবার নতুন করে সময় বেঁধে দেওয়া। টান টান উত্তেজনা। আস্তে আস্তে সুমীর বেঁচে ওঠার আশা কিছুটা জ্বলে উঠে। তার মধ্যে বেঁচে উঠার সাহস ফিরে আসে। দেড় মাসের মাথায় ২০০৮ সালের ১৪ জুলাই ভোরবেলায় সুমী চলে যায়, না ফেরার দেশে। সব আশা-সব প্রচেষ্টা নিভে যায়।
আমরা সুমী-কে বাঁচিয়ে রাখতে পারি নি।
সুমী সিটি হসপিটালে আইসিইউ-তে ছিল। আম্মু দেখতে গিয়েছিল। বন্ধুরা গিয়েছিল। অনেকেই গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু কেউই দেখতে পারে নি তাকে। আর আমি তো যাইনি একবারও। কেনো যাইনি এ প্রসঙ্গ যতোটা না কুঁকড়ে খায় আজ, তার চেয়ে বড় কষ্ট হয়, হাহাকার হয়, ব্যথিত হই, তার পাশে থাকা হলো না ভেবে।
খুব মনে পড়ে সুমী-কে। ভীষণভাবে ধরা দেয় সে প্রতি মুহূর্ত।
নদীর পাড়ের নির্জনতায় পশ্চিম আকাশে ডুবে থাকা চাঁদের ভেতর এখনো তাকে খুঁজি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১১ রাত ৯:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



