টানা পনেরোদিন অচেতন ছিল সজল। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল। ওর ফিরে আসাটা ছিল মিরাকল। অন্তত ডাক্তাররা তাই বলেছিল, কিন্তু......
‘ঐ সজল, কই যাস?’ পেছন থেকে খোকনের ডাক শুনে থামতে বাধ্য হলো সজল। এভাবে আচমকা ডাক দেয় ছেলেটা, কিন্তু মেজাজ খারাপ করার উপায় নেই। হাসি খুশি খোকনের স্বভাবটাই এরকম।
‘কই আর যাবো, বাসায় যাই,’ বলল সজল। বাইক ঘুরিয়ে খোকনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এখনই খোকন সিগারেটের পয়সা চাইবে, ভাবছিল সজল।
‘দোস্ত, আমিও তোর সাথে যাই,’ খোকন উঠে বসবে সজলের পেছনের সীটে। আপত্তি করেও লাভ নেই, তাই স্টার্ট দিল সজল।
এই দুপুরে ঢাকার রাস্তা প্রায় ফাঁকা। গতি বাড়াচ্ছে সজল। হাওয়ায় উড়ছে তার চুল।
‘দুপুরে খাস নি?’ পেছনে সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে সজল।
উত্তর নেই।
‘আজ পোলাও রান্না হয়েছে বাসায়,’ সজল বলল।
উত্তর নেই।
পেছন ফিরে তাকাল সজল। খোকন নেই। এতোক্ষন একা একাই কথা বলছিল সে। খোকন ছিল না তার সাথে। খোকন নেইও। থাকবে কি করে, চারবছর আগে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে মরেছিল খোকন।
ইউনিভার্সিটি এলাকা পার হয়ে শাহবাগ মোড়ে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সজল। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিল। এতো বড়ো এই শহর, হাজার হাজার ব্যস্ত মানুষ, এরমধ্যে একমাত্ও তারই কোন ব্যস্ততা নেই। এখন শুধু বাসায় যাওয়া যায়, আর কোথাও কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
বাসায় ফিরে কিছুক্ষন ঝিম ধরে বসে থাকল সজল। তার রুমটা একেবারে কোনার দিকে। ছোট একটা খাট, একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার, মিউজিক সিস্টেম আর পুরানো গীটার। এই তার আসবাবপত্র। দেয়ালে বিল্টইন আলমারিটা আছে, সেখানে বইখাতা, কাপড়চোপড় রাখে।
কাজের মেয়েটা একটু আগে রুমে খাবারের প্লেট রেখে গেছে, পোলাও আর গরুর মাংস। তার পছন্দের খাবার। খেতে ইচ্ছে করছে না। খোকনের কথা মনে পড়ছে। ওর ট্রেনে কাঁটা ছিন্নভিন্ন লাশটা চোখের উপর ভেসে উঠছে। কোথায় মাথা আর কোথায় হাত-পা? ভাবতেই শরীর শিউরে উঠে। সেই খোকন আজ জলজ্ব্যান্ত চোখের সামনে, তারপরই আবার হাওয়া।
কাপড়-চোপড় না পাল্টেই বিছানায় শুয়ে পড়ল সজল। খুব ঘুম আসছে তার। ঘুম।
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুম ভাঙল সজলের। শরীরটা ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল জ্বর আসবে যেকোন সময়। ঘুম ঘুম চোখে রুমের জানালাটা খুলে দিল। জানালা দিয়ে বিপরীত দিকের জানালাটার দিকে তাকাল। ঐ জানালাটা একসময় তার খুব প্রিয় ছিল। এখন ঐ জানালাটা বন্ধ থাকে। কেন বন্ধ থাকে? ঐ বাড়িতে কি কেউ থাকে না? তার কি জানালা খোলার প্রয়োজন নেই? আগে যে মেয়েটা থাকতো সে কোথায়? তার সাথে মেয়েটার প্রেম ছিল? মনে পড়ে না কিছুই।
টেবিলের উপর খাবারের প্লেটটা নেই, তারমানে কাজের মেয়ে এসে নিয়ে গেছে। কখন নিয়ে গেলো? সে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো অথচ মা একবারও ডাকলো না। জোর করে খাইয়ে দিতে চাইলো না। আজব।
জুতোজোড়া পড়ে নিয়ে বাইরে চলে এলো সজল। বাসাটা নিঝুম পুরীর মতো খালি। সম্ভবত সবাই বাইরে গেছে। একটু দূরে খালার বাসা। মা যখন তখন সেখানে চলে যান। বাবা রাত দশটার আগে বাসায় ফেরেন না। কাজের মেয়েটা সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। বের হতে হতে এটুকুই মনে হলো সজলের।
বাইকটায় স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো সজল। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরলো ঢাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। পরিচিত কারো সাথে দেখা হলো না। এক কোটি অপরিচিত মানুষে গিজগিজ করছে শহরটা। কিন্তু কিছু মানুষ তো পরিচিত ছিল!
যেমন মিলির বাসার সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াল তখন মিলি বের হচ্ছিল। সম্ভবত তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। সজলকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল মিলি। ইচ্ছে হচ্ছিল মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। ওর নতুন বয়ফ্রেন্ডের সামনে মেয়েটার মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো কি দরকার! মেয়েটা বোরিং! তারচেয়ে আগামাসি লেনে গিয়ে ঝন্টুর বাসায় আড্ডা দেয়া যায়।
কিন্তু হাজার রাস্তার এই শহরে আগামাসি লেন কোনমতেই খুঁজে পেলো না সজল। সব রাস্তাকেই মনে হচ্ছিল আগামাসি লেন। কিন্তু কোনভাবেই ঝন্টুর বাসাটা খুঁজে পাওয়া গেল না। ঝন্টুর বাসা যেন বিশাল বড় মৌমাছির চাকের ছোট একটা খোপ। খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মোবাইল ফোন নেই তার সাথে। অনেক দিন ধরেই ব্যবহার করা হয় না। আসলে ফোন করার মতো মানুষই নেই। মোবাইল ফোন রেখেই বা কি লাভ? মিলির সাথে যখন প্রেম ছিল তখন মোবাইল ফোন সারাক্ষন হাতে থাকতো। এখন আর তার দরকার নেই।
আরো অনেক রাত হলে বাসায় ফিরে এলো সজল। রাত দুটোর কম হবে না। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো কেউ। সম্ভবত কাজের মেয়েটা। অনেক রাত হয়েছে। বাবা-মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। সজলের কোন দাম নেই তাদের কাছে। বেকার ছেলের কিইবা মূল্য থাকতে পারে।
ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে এলো সজল। টেবিলে খাবার দিয়ে গেছে মেয়েটা আগেই। ভাত থেকে গরম ধোয়া উঠছে। যেন জানতো এই সময় বাসায় ফিরবে সজল। খিদে না থাকলেও খেতে ইচ্ছে করছিল সজলের। রুই মাছের ঝোল আছে আরেকটা বাটিতে। দারুন ঘ্রান আসছিল। কিন্তু আগে চেঞ্জ করা দরকার।
অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে নিলো সজল। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসল। খাবারের প্লেট নেই। কাজের মেয়েটা এসে নিয়ে গেছে। হয়তো ভেবেছে খাবে না, খাবার নষ্ট করার চেয়ে হয়তো নিজেই খেয়ে নিয়েছে। রাগ হচ্ছিল সজলের। মা এই কাজের মেয়েটাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। কালই বিচার দিতে হবে। ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি গিয়ে চুলের মুঠি ধরে ঢাই ঢাই কিল বসাতে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো বোরিং একটা কাজ। এরচেয়ে ঘুমানো অনেক ভালো।
বিছানায় শুয়ে অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করছিল সজল। কিন্তু ঘুম আসছে, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে অচিরেই।
ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে হাই আসছিল সেলিম সাহেবের। একটু আগে দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে উঠে গিয়েছিলেন। দরজা খুলে দেখেন কেউ নেই। ভয় পেলেও মনোয়ারার সামনে তা কখনো প্রকাশ করেন না তিনি, তাতে বেচারি আরো ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু মনোয়ারা যা শুরু করেছে তাকে একপ্রকার পাগলামী ছাড়া আর কিছু বলা যাচ্ছে না।
বার্সেলোনার ম্যাচ একা একা দেখাটা অনেক কষ্টের। পপকর্ন খেতে খেতে ছেলের সাথে বার্সা আর রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচগুলো দেখা ছিল অনেক মজার। নিজে বার্সার সাপোর্টার হলেও রিয়ালের সাথে খেলার দিন তিনি রিয়ালের সমর্থক হয়ে যেতেন। তাতেই জমতো খুব। রিয়াল হেরে গেলেও খারাপ লাগতো না তার। ছেলের দল জিতেছে সেটাই আসল কথা। মনোয়ারা মাঝে মাঝে এসে বাপ-ছেলেকে শাসন করে যেতো। কিন্তু এখন সবই অতীত।
ম্লান মুখে মনোয়ারা বসে আছে পাশের সোফায়। হাতে ধোঁয়া উঠা ভাতের প্লেট, রুই মাছের ঝোল।
----- কিন্তু---- ফিরে সে আসে নি। মিরাকল কিছু ঘটে নি।
সজল সজলের মতো একা জীবন কাটাতে থাকল। প্রতিদিনকার মতো প্রিয় বাইকে করে পুরো ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ায় পরিচিত লোকের খোঁজে। নিঃস্তব্দ বাসায় তার রুমে বাড়া থাকে গরম ভাত আর প্রিয় তরকারি। যদিও কোন কারনে খাওয়া হয় না। বাবা আর মা’কে দেয়ার মতো অভিযোগ জমতেই থাকে তার ঝুড়িতে।
সেলিম আর মনোয়ারা নিয়ম করে হাসপাতালে যান। প্রিয় ছেলেকে দেখে আসেন হাসপাতালের বেডে, সারা শরীরে অজস্র পাইপ আর সুই নিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায়। এমন ঘুম একমাত্র মিরাকল ছাড়া তা ভাঙবে না। বাসায় ফিরে দুজনেই অপেক্ষা করেন কলিং বেলের শব্দের অপেক্ষায়। মনোয়ারা নিয়ম করে দু’বেলা রান্না করেন ছেলের প্রিয় খাবার। কোনদিন তা খেতে আসে না কেউ।
ফেসবুক