১৬৬৯ সালের এপ্রিলে রাজকীয় আদেশের মাদ্ধমে আওরংজেব তার গভর্নরদের কাফিরদের স্কুল এবং তাদের মন্দির ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন এবং তাদের যে কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান শক্ত হাতে দমনের আদেশ দেন।এসময়ে মুঘল পুলিশবাহিনীর হাতে হিন্দু সন্যাসী উদ্ধভ বৈরাগী আটক হন এবং তাকে জেলে পুরে রাখা হয়।সেপ্টেম্বর ১৬৬৯ সালে ভারতের ঐতিহাসিক নিদর্শন সোমনাথ মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়।বুন্দেলার রাজা বিরসিং দেব কতৃক নির্মিত ভারতের সম্পদ,সমৃদ্ধি ও জাকজমক এর প্রতীক মথুরার কেশব রায় এর মন্দির মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় সেই জায়গায় মসজিদ নির্মান করা হয় এবং এর মুর্তিগুলো আগ্রায় জাহানারার মসজিদ এর সিড়ির নিচে মাটি চাপা দেয়া হয় যেন সেগুলো নামাযিদের পায়ের নিচে পিষ্ঠ হতে পারে।প্রায় একই সময় কাথিয়াওয়াড় অববাহিকায় নতুন(?) সোমনাথ মন্দিরটিও ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং সেই যায়গায় সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়।১৬৭৯-৮০ সালের রাজপুত যুদ্ধের সময় শুধু মেওয়ারেই ১৭৫ টা মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয় যার মদ্ধে রয়েছে হিন্দুধর্মের অন্যতম পবিত্র নিদর্শন সোমেশ্বর মন্দির এবং উদয়পুরের বিখ্যাত বহুতল বিশিষ্ট তিনটি মন্দিরও ভেঙ্গে ফেলা হয়।
২রা এপ্রিল ১৬৭৯ সালে সম্রাট আকবরের জিজিয়া কর রহিত করার প্রায় ১০০ বছর পর আওরংজেব আবার জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করেন।এর প্রতিবাদে তার হিন্দু প্রজারা তার জুম্মার নামাযে যাবার সময় রাস্তায় শুয়ে তার পথ আটকালে তিনি তাদের উয়পর হাতি ঊঠিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন।১৬৯৫ সালে এক সরকারি ফরমানের মাধ্যমে রাজপুত ব্যাতীত সকল হিন্দুদের অস্ত্র বহন,হাতি এবং আরবী ঘোড়ায় চড়া নিষিদ্ধ করেন।একই সময়ে তা কলমের এক খোচায় হিন্দুদের সমস্ত উচ্চপদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং মুসলিম ব্যাবসায়ীদের খাজনা অর্ধেকেরও কমিয়ে দেয়া হয় এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণ করে দেয়া হয়।
সম্রাটের এই বৈষম্যমুলক আচরন অচিরেই সম্রজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহের সুচনা করে।সম্পদশালী জাট কৃষক সম্প্রদায় বিক্ষোভে ফুসে ওঠে,শান্তিপ্রীয় নির্বিবাদী সৎনামী সম্রদায় সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে।শিখ গুরু টেগ বাহাদুর এর শিরোচ্ছেদ করা হয় আওরংজেব এর নির্দেশে(১৬৭৫),প্রতিবাদে শান্তিপ্রিয় শিখ সম্রদায় অস্ত্র তুলে নেয়,পরবর্তী ১০০ বছর ধরে শিখ মুঘল একে অপরের রক্ত ঝড়িয়েছে।
মুঘল সম্রাজ্যের শক্তির অন্যতম ভিত্তি বিশ্বস্ত রাজপুতদের প্রতিও আওরংজেব এর আচরন ছিলো অত্যন্ত নোংরা,যোধপুরের মহারাজা জসওয়ান্ত সিং মুঘল সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াইরত অবস্থায় পেশোয়ারে মৃত্যু বরন করেন।আওরংজেব প্রায় সাথে সাথেই সৈন্য পাথিয়ে যোধপুরের দখল নেন। ।এমনকি জসওয়ান্ত এর দুই গর্ভবতী স্ত্রীকেও আওরংজেব নিজের দরবারে বন্দী করে আনতে সৈন্য পাঠান,কিন্তু দুর্গের রক্ষক রাঠোর রাজপুত সৈন্যরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে রানীকে মেওয়ার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সমগ্র রাজপুতানা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফুসে ওঠে।বিশেষ করে উদয়পুর এর মহারানা রাজ সিং আরাবল্লীর পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে মহাকাব্যিক এক বিদ্রোহ শুরু করেন,এই বিদ্রোহ দমনে আওরংজেব তার ছেলে শাহজাদা আকবরকে পাঠান যিনি নিজেই রাজপুতানা পৌছে আওরংজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন।রাজপুতরাও তাকে সর্বাত্নক সমর্থন দেয়।তবে চতুর আওরংজেব এই পরিস্থিতি সামাল দেন অত্যন্ত কৌশলে,তিনি রাজপুত নেতাদের একটা চিঠি পৌছে দেন যেখানে তিনি আকবরকে অভিনন্দন জানান রাজপুতদের আরাবল্লী পাহাড় থেকে বের করে খোলা ময়দানে মুঘল কামানের সামনে নিয়ে আসার জন্য।এই চিঠি পাবার পর রাজপুত সেনাবাহিনী রিতিমত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।কর্পদকশুন্য বন্ধু মিত্রহীন আকবর পালিয়ে মারাঠা শিবিরে যেয়ে আশ্রয় নেন।যদিও সেই বছরই(১৬৮১) আওরংজেব এবং রাজসিং নিজেদের মদ্ধে সন্ধি করে নেন তবে মুঘল রাজপুত সম্পর্ক আর কখনোই স্বাভাবিক হয় নই।জয়পুর এবং বুন্দেলা ছাড়া অন্য কোন রাজপুত গোষ্ঠী আর কখনোই মুঘলদের পুর্ন সমর্থন দেয় নি।রাঠোর রাজপুতরা আওরংজেব এর মৃত্যুর আগ পর্্যষন্ত লড়াই চালিয়ে যায়।
তবে রাজপুতদের প্রতি আওরঙ্গজেব এর ঘৃণা শিয়াদের প্রতি তার ঘৃণা কে অতিক্রম করে যেতে পারে নি। শিয়া সম্প্রদায় কে তিনি রাফসি নাম দেন।বিশেষ ধরনের ছোরার নাম দেন ‘রাফসি কুশ’ বা শিয়া হত্যাকারী।শিয়াদের তিনি অভিহিত করতেন ‘গুল ঈ বায়াবানি’ বা শবখেকো শয়তান এবং ‘বাতিল মাশাবান’ বা ভন্ডের অনুসারী নামে,যদিও আওরঙ্গজেব এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি এবং সম্রাজ্যের সবচেয়ে চৌকষ আমলাদের বেশীরভাগই ছিলো সাফাভিদ সম্রাজ্য থেকে আগত শিয়া মুসলিম।মুঘল সম্রাজ্যের শায়খুল হাদীস আওরংজেবের এসব ধর্মান্ধ গোড়ামীপুর্ন বিভ্রান্তিকর আচরনের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং তার দরবার ত্যাগ করেন এবং আওরংজেব এর শত অনুরোধেও তিনি আর কখনোই দরবারে ফেরত আসেন নি।
এই প্রবন্ধটি স্যার যদুনাথ সরকার লিখিত হিস্ট্রি অফ আওরংজেব এর দ্বিতীয় ভলিউম এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, অনুবাদক আমি নিজেই।
প্রথম পর্বের লিংক
এনেকডোটস অফ আওরঙ্গজেব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১২:৫১