আগের পর্বগুলো উপরে
এর আগেও কয়েকবার কলকাতা আসা হয়েছে এমনকী হাওড়াতেও একবার এসেছিলাম কিন্তু কখনও হাওড়া স্টেশনে ঢুকি নি, শুধু হাওড়া ব্রিজ দেখে চলে গেছি। আমি আর শহিদুল বেয়াই স্টেশনের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম যে বাহির থেকে মনে হয় ছোট একটা স্টেশন কিন্তু ভিতরটা সত্যিই বিশাল। যেহেতু আমাদের ট্রেনের সব টিকিট বাংলাদেশ থেকেই কেটে নিয়েছিলাম তাই টিকিট কাটার জন্য অযথা সময় নষ্ট করতে হয় নি। দুই বেয়াই মিলে বাকি সময়টা ওয়েটিং রুমে বসে কাটিয়ে দিব এই সিদ্ধান্ত হল। দুইজন মিলে ওয়েটিং রুম খুঁজতে শুরু করলাম।
আমরা যেহেতু স্লিপার ক্লাসের যাত্রী তাই সেই ক্লাসের ওয়েটিং রুমেই অপেক্ষা করতে হবে। দুইজনের ব্যাগই অনেক ভারি ছিল, আর ক্লান্তি তো ছিলই। অনেক খুজলাম কিন্তু ওয়েটিং রুম পাচ্ছিলাম না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সবাই শুধু ভুলভাল দেখিয়ে দেয়। কলকাতায় এই ব্যাপারটা বাজে। কেউ সঠিক জায়গা দেখিয়ে দিতে চায় না, একজন তো আমাদের বলল পাশের বিল্ডিংয়ে নাকি ওয়েটিং রুম। গিয়ে দেখি শুধু অফিস। মেজাজ তখন খারাপের চরমে।
শেষ পর্যন্ত চেখে পড়ল শয়ন শ্রেণীর অপেক্ষাগার লেখা একটি সাইনবোর্ড, যা নির্দেশ করে ওয়েটিং রুম দোতলায়। দুই জোড়া চোখ কিভাবে যে এইটা মিস করল বুঝতে পারছিলাম না। যাই হোক, ওয়েটিং রুমে যাওয়ার আগে ব্যাগ যাতে পাহাড়া দিয়ে না রাখতে হয় সেজন্য ক্লোয়াক রুমে গেলাম ব্যাগ রাখতে। কয়েকজনের পিছনে লাইনে দাড়ালাম। আমার সময় আসল, ক্লোয়াক রুমের দায়িত্বে থাকা লোকটা ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে যেতে বললেন। আমাদের ট্রেনের টিকিট দেখে যেই লোকটা স্লিপ লিখতে শুরু করবেন তখন জিজ্ঞেস করলেন "ব্যাগে তালা মারা আছে কি না?" আমি বললাম, "না"। লোকটা বলল, "তালা মারা না থাকলে ব্যাগ রাখা যাবে না।" কি আর করা, রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। বেয়াইকে বললাম দুইটা তালা নিয়ে আসতে। বেয়াই চলে গেলেন তালা আনতে, মালামাল পাহাড়ায় আমি। দশ মিনিট পরে বেয়াই আসলেন তালা নিয়ে। প্রতি তালার দাম ৪০ রুপি। ব্যাগে তালা মেরে আমি আবার লাইনে, সামনে পাঁচ জন। আমার শরীর আর চলছিল না। একে তো রোজা আবার গরম। মালামাল ক্লোয়াক রুমে রেখে স্লিপটা নিয়ে নিশ্চন্তে বেরিয়ে এলাম।
দোতলায় ওয়েটিং রুমে গিয়ে আগে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বেয়াই আর আমি ওয়েটিং রুমের বারান্দায় গিয়ে গল্প করতে থাকি। পাশাপাশি হাওড়া ব্রিজ পিছনে নিয়ে কিছু ফটোগ্রাফী। মেহেদী ভাইয়ের এখনো কোন খবর নেই। সে কোথায় আছে জানার কোন উপায় নাই। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হল, পরে তা ভারী বর্ষনে রুপন্তরীত হয়। এত গরমে বৃষ্টি সবার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। বেয়াই ইতিমধ্যে ওয়েটিং রুমের চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমি একা একা বাইরের বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকি। বেয়াইকে ঘুম থেকে ডাকলাম কয়েকটা ছবি তুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি এতটাই ঘুমে ছিলেন যে মনে হল একটা জড় পদার্থকে ডাকছি। এত ঘুমের কারণ হচ্ছে উনি গত রাতে গাড়িতে একটুও ঘুমাতে পারেন নি। কি আর করা, নিজেই নিজের কয়েকটা ছবি তুললাম, যাকে আমরা সেলফি বলি।
মেহেদী ভাইয়ের একটি পোস্ট দেখতে পেলাম ফেসবুকে, বুঝলাম সে কলকাতায় চলে আসছে। সাথে সাথে ফেসবুকে নাম্বারটা দিয়ে দিলাম আর কল করতে বললাম। সাথে সাথে উনি আমাকে কল দিলেন, আর জিজ্ঞেস করলেন "ভাই আপনারা কোথায়?" বললাম "হাওড়া স্টেশনে"। এটা শুনে মনে হল উনি একটু রাগ করেছেন, আর বললেন "আমাদের না মারকু্ইস স্ট্রীটে দেখা করার কথা ছিল?" আমি বললাম "আসলে খুবই ক্লান্ত ছিলাম তাই রেস্ট নেওয়ার জন্য চলে আসছি, আপনি চলে আসেন"। উনি বললেন " আপনারা থাকেন আমার আরো দেড়ী হবে, কিছু কাজ আছে, একসাথে ইফতার করব"। ফোন রেখে দিলেন।
শরীর খুব খারাপ লাগছিল। তাই তাড়াতাড়ি ১০ রুপি দিয়ে গোসলখানায় ঢুকে গোসল সেরে নিলাম। গোসল শেষ মনে হল সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বেয়াই তখনও ঘুমাচ্ছে। তাকে কোন কিছু না বলে নিচে চলে গেলাম স্টেশনটা একটু ঘুরে দেখতে। হাওড়া নামটি এসেছে বাংলা "হাওড়" কথাটি থেকে। হাওড় শব্দের অর্থ জলাভূমি। হাওড়া স্টেশন ১৮৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি নির্মাণ করে। ১৬৩ বছরে হয়ে গেছে স্টেশনটার। বিল্ডংয়ে একটু বয়সের ছাপ চলে এসেছে।
স্টেশনটা এত ব্যস্ত যে দুইটা প্লাটফর্ম ছাড়া বাকি সবগুলোতে ট্রেন দাড়িয়ে আছে। হাজার হাজার মানুষ স্টেশনের ভিতরে আসছে আবার বের হচ্ছে। এ যেন একটা যন্ত্র, সুইচে চাপ দেয়া আছে আর সব সয়ংক্রিয়ভাবে হচ্ছে। স্টেশনের মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি একটি রোড চলে গেছে। স্টেশনের ভিতর দিয়ে রোড দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। সবাই খুব ব্যস্ত, ডিজিটাল নোটিশ বোর্ডে কোন ট্রেনের তথ্য ভেসে উঠলেই সবাই ঐ প্লাটফর্মের দিকে দৌড়। সে দৌড়ে সবার মধ্যে এক অন্যরকম প্রতিযোগিতা। যতটুকু মনে পড়ছে, ৪ টা ২০ বা ৩০ মিনিটে হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস ৮ নম্বর প্লাটফর্মে আসতে শুরু করে। ভাবলাম পুরো ট্রেনটা একটু দেখে আসি।
ট্রেনটা এত বড় ছিল যে, হাটতে হাটতে প্লাটফর্মের একেবারে প্রায় শেষ মাথায় চলে আসলাম। রেলের লোকেরা যে বগিতে ড্রাইভার বসেন সেইটা মূল ট্রেনের সাথে লাগাচ্ছেন, আমি দাড়িয়ে তা দেখছিলাম। এমন সময় মেহেদী ভাইয়ের কল আসলে। ওনি বললেন "আমি চলে আসছি, আপনারা কোথায়?" আমি বললাম "প্লাটফর্মে যে রাজধানী এক্সপ্রেস দাড়িয়ে আছে তার একদম শেষ মাথায়, আপনি দাড়ান আমি আসছি।" মেহেদী ভাইকে খুঁজে বের করলাম। তার সাথে এটাই আমার প্রথম দেখা। শহিদুল বেয়াইয়ের কথা জিগ্গেস করলেন "ওনি কোথায়?" আমি বললাম "ওনি ঘুমাচ্ছে"। তারপর মেহেদী ভাইকে নিয়ে চলে গেলাম ওয়েটিং রুমে।
বৃষ্টিতে মেহেদী ভাইকে ভালই ভুগিয়েছে। ওনার প্যান্ট আধা ভেজা, জুতার অবস্থা আর না ই বললাম। ভাগ্যিস একটা ছাতা ওনি বাংলাদেশ থেকেই নিয়ে এসেছিলেন। উনি ব্যাগ আমাদের কাছে দিয়ে গোসল সেরে নিলেন, তারপর বেয়াইও। সবাই মিলে আড্ডা দিতে লাগলাম ওয়েটিং রুমের ফ্লোরে বসেই। মেহেদী ভাই এই ফাঁকে মোবাইলে একটু চার্জ করে নিচ্ছেন। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। বেয়াই আর আমি ইফতার আনতে চলে গেলাম। ইফতারের জন্য ভেজ চাওমিন, ঠাণ্ডা পানি আর জুস নিয়ে নিলাম। পানি যাতে ট্রেনেও ব্যবহার করতে পারি সেজন্য বাড়িয়ে নিলাম। খরচ ২১০ রুপি তিন জন।
ইফতার মেহেদী ভাইয়ের কাছে রেখে ক্লোয়াক রুমে রাখা আমাদের ব্যাগ আনতে চলে গেলাম। ব্যাগ রাখা বাবদ দুইজনের খরচ ৩৬ রুপি। ব্যাগ নিয়ে চলে এলাম ওয়েটিং রুমে।
মাগরিবের আজান হয়ে গেল। ইফতার করে নিলাম। চাওমিন আমার ভাল লাগে নাই তাই পুরোটা শেষ করতে পারি নাই। মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। সাতটা বিশ বাজলে আমরা চলে যাই প্লাটফর্মে। কিছুক্ষণ পর ডিজিটাল বোর্ডে ভেসে উঠল কালকা মেইল ৯ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে। আমাদের বগি ছিল S-11। প্লাটফর্মে লাগানো (ছোট ছোট) ডিজিটাল সাইনে ভেসে উঠল কত নাম্বার বগি কোথায় থামবে।সেটা দেখে আমরা S-11 যেখানে আসবে সেখানে দাড়িয়ে গেলাম। আমরা যেখানে দাড়ালাম সেখানে কিছু মানুষের একটা লাইন ছিল। রেলওয়ে পুলিশের একজন বলল "আপনাদের কি টিকিট আছে?" আমরা বললাম "জ্বি আছে"। লোকটা বলল"তাহলে আপনারা একটু সাইডে দাড়ান, এই লোকগুলো অসংরক্ষিত বগিতে ওঠবে। অনেক ভীড় হবে, ওনারা ওঠে গেলে আপনারা আরামে উঠতে পারবেন। বাকি কয়েক মিনিট লেইস এর একটা চিপস নিয়ে সময় কাটিয়ে দিলাম। ট্রেন ৭ টা ৩৫ মিনিটে আমাদের সামনে হাজির। অরক্ষিত কামড়ার লোকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সবাই উঠার পর আমরা একটু আস্তে ধীরেই ট্রেনে আমাদের কামড়ায় উঠলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৫২