ট্রেনে উঠে পড়লাম। সিট খুজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। ট্রেন ছাড়তে আরো ১০ মিনিট বাকি। আমি সাইড আপার, বেয়াই আপার এবং মেহেদী ভাই মিডেল বার্থ পেয়েছিলেন। কিছুক্ষন পরে একজন এসে আমার সামনের সিটে এসে বসল, কিছুক্ষন পর আরো একজন। মেজাজ তখন আমার চরম খারাপ, বুঝতে পারলাম তারা RAC টিকটি কেটেছিল। তাই তারা নিচের সিটটি ভাগ করে বসবে এবং শুবে, যদিও আমার ঘুমানোর সিটে তারা ভাগ বসাবে না। কিন্তু আমাকে তাদের সাথে দিনের বেলায় নিচে বসতে হবে হয়ত উল্টা হয়ে (দুইজনের সিটে তিনজন বসতে হবে) । একটি জানালার পাশে বসার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটল।
ট্রেন ১৫ মিনিট লেট করে সন্ধ্যা ৭ টা ৫৫ মিনিটে ছাড়ল। আমি অন্য একটা খালি সিটে গিয়ে আপাতত বসে রইলাম। কিছুক্ষন পর একজন ফেরীওয়ালা হাওয়া বালিশ আর শেকল নিয়ে আসল বিক্রি করতে। মেহেদী ভাই বলল "ভাই এখনই একটা বালিশ আর একটা শিকল কিনে নিই, তা না হলে পরে আর না পাওয়ার সম্ভাবনা আছে"। তাই সবাই একটা করে শিকল আর হাওয়া বালিশ কিনে নিলাম। দাম প্রতি সেট ১২৫ রুপি। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে রাতের খাবারের অর্ডার নিল। দুইটা ভেজ আর একটা করে ননভেজ অর্ডার দিলাম। খাবার আসা পর্যন্ত বাকি সময়টা সবাই গল্পগুজব করতে করতে শেষ করলাম। এই ফাকে সবাই কাপড়চোপড় চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
গরম গরম খাবার দিয়ে গেলেন যিনি অর্ডার নিয়েছিলেন। একটা ফয়েল প্যাকে ভাত, আরেকটাতে তরকারি আর অন্যটাতে ডাল, আর পলিথিনে এক্সট্রা ভাত। সবাই সবার কাছ থেকে তরকারি নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। তাতে সবার সবটা টেস্ট করা হয়ে গেল। ডাল ছাড়া আমার ভেজ ননভেজ কোনটাই ভাল লাগে নাই। কি আর করা এত লম্বা সফরে টিকে থাকতে হলে খাাওয়ার কোন বিকল্প নাই। খাওয়া শেষ করার কিছুক্ষণ পর বিল নিতে আসল, বিল ৩ জনের ৩৯০ রুপি। গত ২৪ ঘন্টার ক্লান্তি ছিল, তাই হালকা ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাগ তালা মারলাম আর ট্রেনে কেনা হাওয়া বালিশ ফুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল ৬ টায় আমার ঘুম ভাঙ্গল। শুয়ে শুয়ে দেখলাম সবাই ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে জাগতে না পারা এবং খাবারের সমস্যা থাকাতে কেউ রোজা রাখতে পারি নাই। আমার আর ঘুম আসলো না, খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করে সিট ছেড়ে চলে গেলাম টয়লেটে। ভীড় শুরু হবার আগে সকল কাজ সেরে নিলাম। মেহেদী ভাইদের সামনের সিট খালি ছিল, কারণ ঐ সিটের যাত্রীরা রাতেই কোন স্টেশনে নেমে গিয়েছিল। আপাতত একাই বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ট্রেন বিহারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মরুভূমির মত আশেপাশটা। গাছপালা নেই বললেই চলে। সকাল সকাল অনেকেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে খোলা ময়দানেই বসে পড়েছে। তা দেখার মত দৃশ্য না। তাই আবার গিয়ে শুয়ে রইলাম।
কিছুক্ষন পরে মেহেদী ভাইয়ের ঘুম ভাঙ্গল। ওনি ফ্রেশ হয়ে আসলেন। ইতিমধ্যে ওনার সামনের সিটে আবার একটা ফ্যামিলি চলে এসেছে। আমার নিচের যারা ছিলেন তারাও ঘুমন্ত। তাই আর বসার জায়গা পাচ্ছিলাম না। কি আর করা, মেহেদী ভাইয়ের সাথে গিয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে সকালের নাস্তার অর্ডার নিল। আলুর পরোটা অর্ডার করলাম, প্রতি পিছ ৫০ রুপি। আধা ঘন্টা পর আলু পরোটা নিয়ে আসল। আমি আর মেহেদী ভাই গরম গরম পরোটা খেয়ে নিলাম, যেহেতু বেয়াই ঘুমাচ্ছিল তাই তারটা রেখে দিলাম। প্রায় সাড়ে ন'টার দিকে শহিদুল বেয়াইয়ের ঘুম ভাঙ্গল। উনি ফ্রেশ হয়ে আসার পর নাস্তা খেতে বললাম। কিন্তু সে নাকি নাস্তা করবেন না। তাই মেহেদী ভাই বলল "রেখে দেন পরে দুইজনে খেয়ে নিব"।
আমার নিচের সিটে যারা ছিলেন তাদের মধ্য হতে একজন রাতে অন্য জায়গায় গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। বাকি একজনের ঘুম ভেঙ্গেছে। কিন্তু সে ফ্রেশ হয়ে এসে বলল সে নাকি আরো ঘুমাবে। মেজাজ তখন খুব খারাপ আমার, কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারছিলাম না। যাই হোক মহাশয় প্রায় আরও ১ ঘন্টার মত ঘুমালেন। অবশেষে ১০ টা ৩০ মিনিটের দিকে আমি সিটে বসার সুযোগ পেলাম। ভদ্র লোকের সাথে পরিচয় হল। ওনার নাম হেমন্ত, ছোট বেলা থেকেই কলকাতা থাকেন। কিন্তু সে বাংলা বলতে পারেন না, এ যেন মিষ্টির মধ্যে ডুবে আছেন কিন্তু মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করেন নি। ওনি কানপুরে ওনার বোনের বাড়ি যাচ্ছেন। তার সাথে আমার জঘন্য হিন্দি দিয়ে কথা বলা খুব কষ্ট হয়ে পড়ল, তাই বললাম "আমি বাংলায় বলি যেহেতু আপনি বাংলা বুঝতে পারেন আর আপনি হিন্দি বলুন আমি বুঝতে পারব" ইতিমধ্যে বেয়াই আর মেহেদী ভাইও যোগ দিলেন আড্ডায়। আমাদের সাথে খুব আন্তরিক হয়ে উঠলেন। উনি দুষ্টুমি করে আমাকে বলতে শুরু করেন "তুমি তো এখনও বাচ্চা।" বাকি সবাইকে বলছিলেন আমার খেয়াল রাখতে।
আড্ডার ফাঁকে কিছু ছবি তোলা হয়ে গেল, আর মেহেদী ভাই তার ক্যামেরা চালানোর প্রশিক্ষণ দিলেন আমাদের। বেয়াইয়ের জন্য রাখা আলু পরোটা মেহেদী ভাই আর আমি মিলে শেষ করে দিলাম। বাইরে প্রচন্ড গরম। জানালার বাইরে হাত রাখলে মনে হচ্ছিল একটা ওভেনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছি।
আমি হেমন্ত কে বললাম বাইরে খুব গরম হাত রাখা যাচ্ছে না। সে বলল "ঠিক আছে তাহলে তুমি আমার সিটে বস, আর আমি তোমার টাতে বসি"। ওনার সিটে বসার পর মনে হল একটা চুলার সমস্ত তাপ আমার শরীরে লাগছে। ওনি বললেন "কি কেমন লাগছে?" বললাম "আমার জায়গাই ভাল"। উনি বললেন "তাহলে কিছুক্ষণ আমার জায়গায় বস, আমি একটু আরাম করি"। ওনার আরামের চক্করে আমার বেরাম চলছিল।
ওদিকে সোহেল ভাই ফেসবুকে আমার খবর নিচ্ছিলেন, কোথায় আছি, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না, ট্রেন লেট কি না ইত্যাদি। তাকে জানালাম আমরা কিছুক্ষন আগেই মোঘলসরাই স্টেশন পাড় হলাম আর সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সোহেল ভাই একজন ট্রাভেলার এবং ডাক্তার। ওনার সম্বন্ধে আরেকদিন বলব। আমাদের ট্রেন প্রায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিট লেটে চলছিল। এর ফাঁকে তিনজন মিলে একটা ভেজ বিরিয়ানি নিলাম। প্যাকেট খুলে দেখি ভিতরে আন্ডা বিরিয়ানি। লোকটা মনে হয় ভুলে দিয়ে দিয়েছে। বিরিয়ানি খুব একটা যুতের ছিল না। হেমন্তের সাথের লোকটা এলাহাবাদ নেমে গেল। সে আরো একা হয়ে গেল। আর আমাদের সাথে আড্ডার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান আর ভারতের দর্শনীয় স্থান নিয়েই চলল বেশী আলোচনা। তার হাতে সময় থাকলে আমাদের সাথে যেতেন বলেও ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
দুপুরের খাবারের পর সামান্য কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা চলল, কিন্তু আমরা উপরের সিটে অতিরিক্ত গরমের কারনে নিচে নেমে এলাম। যখন কোন স্টেশনে ট্রেন থামছিল তখন টুকটাক কিছু না কিছু কিনে খাওয়া চলছিল। কখনো কখনো স্টেশনের প্লাটফর্মে ছবি তোলা। হেমন্ত দা কানপুরে নামলেন নির্ধারিত সময় থেকে ২ ঘন্টা পরে। যাওয়ার আগে হাতে সময় থাকলে তার সাথে তার বোনের বাড়িতে বেড়িয়ে যেতে বললেন, আর আমাকে উদ্দেশ্য করে সবাইকে বললেন"ও তো একটা বাচ্চা ছেলে, ওর খেয়াল রেখো"। একজন বিদেশী মানুষের কাছে কথাগুলো শুনতে এক অন্যরকম ভাললাগা কাজ করছিল।
বাকি সময়টাতে কখনো স্টেশনের প্লাটফর্মে থাকা ঠাণ্ডা পানির কাউন্টার থেকে ২ লিটার পানি ৮ টাকায় কিনে খাওয়া অথবা স্টেশনের প্লাটফর্মে হকারের কাছ থেকে সিঙ্গারা, গুলগুলা কিনে খাওয়া। কয়েক স্টেশন পর তিন জনের একটা ফ্যামিলি উঠল। একজন প্রায় বয়স্কা মহিলা আমার সামনের সিটে আর বাকি সদস্যরা একটু দূরের সিটে। কিছুক্ষণ পর তারা আসলো ঐ মহিলার সাথে গল্প করতে। আমাকে রিকোয়েস্ট করল আপাতত পাশের সিটে বসতে।
সেই যে আমি পাশের সিটে বসলাম তো বসলাম-ই। তাদের আর গল্প শেষ হয় না। মনে হয় দুইটা সিটই তাদের। আমি বসতে চাইলে বলে "আমাদের মাঝখানে এসে বস। মুরুব্বি মানুষ কি আর বলব।
দেখতে দেখতে রাত দশটার দিকে পুরাতন দিল্লি স্টেশনে পৌছালাম। আমাকে রেখে বেয়াই আর মেহেদী ভাই মিলে রাতের খাবারের জন্য স্টেশনের বাইরে গেলেন। আমার সিট কিছু সময়ের জন্য খালি হয়েছে। ভদ্র মহিলাকে বললাম "আন্টি একটু বসলাম"। মহিলা বলল "শুধু এখনকার জন্য বসতে পার কিন্তু রাতে ঘুমানোর জন্য কিন্তু অন্য জায়গায় যেতে হবে। বুঝলাম আন্টি অন্য দুনিয়ায় আছেন। আমি বললাম "উপরের সিটটা আমার, আর এখন যেখানে বসে আছি এটাও আমার সিট"। মহিলা ভুল বুঝতে পারলেন। মহিলাকে আমাদের ব্যাগ পাহাড়ায় রেখে আমি স্টেশনে নামলাম কিছু সময়ের জন্য।
ট্রেন ছেড়ে দিবে এক্ষুনি, আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম। বাকীরাও চলে আসল। খাবারের জন্য বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি, ট্রেন ছেড়ে দিবে বলে। ট্রেন এখন ৪৫ মিনিট লেট। রাতের খাবার হিসেবে বিস্কুট আর কলা নিয়ে আসা হয়েছে, সাথে লিমকা। মেহেদি ভাই মনে করিয়ে দিলেন"ভাই খেয়াল করেছেন! কালকের পরে কিন্তু আর কোন বালিশওয়ালা ট্রেনে উঠে নাই। তার মানে তখন যদি না কিনতাম তাহলে কি হত বুঝতে পারছেন?" ভেবে দেখলাম তখন না কিনলে ঘুমের ১২ টা বাজত। খেয়ে দেয়ে দিলাম ঘুম। সাড়ে তিনটার দিকে লোকজনের কথাবার্তাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি চন্ডীগড় রেল স্টেশনে ট্রেন দাড়িয়ে আছে। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর ট্রেন আবার চলতে শুরু করল তার শেষ স্টেশনের দিকে। মাঝে চান্দি মন্দির স্টেশনে দাড়ালো মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময় ভোর ৪ টা ৩০ বাজার ২ মিনিট আগেই কালকা গিয়ে পৌছায় আমাদের ট্রেন।
এতদিন শুধু শুনে এসেছি কালকা মেইল অনেক লেট করে কিন্তু আমরা তো ২ মিনিট আগেই শেষ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৩৯