চারদিক সবে মাত্র ফর্সা হচ্ছে। কালকা স্টেশনটা খুব বেশী বড় না হলেও শিমলাগামী পর্যটকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বিশেষভাবে যারা টয় ট্রেনে শিমলা যেতে চান। যাত্রা শুরু করবে এমন কয়েকটা ট্রেন দাড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। একটা ট্রেনে ভালই ভীড় লক্ষ্য করলাম। এই ট্রেনে যে আগে উঠে সিট দখল করতে পারবে সিট তার এই রকম বগি আছে। সবচেয়ে অবাক হলাম ২ বগির একটি ট্রেন দেখে, নাম রেল মোটর। ট্রেন টিকিটের ব্যবসা নিজে করার সুবাদে বাংলাদেশ থেকেই শিবালিক ডিলাক্সের টিকিট কেটে নিয়ে গিয়েছিলাম। এই ট্রেনের টিকিট আগে না কাটা থাকলে সিট পাওয়া যায়না।
আমরা যে ট্রেনে যাব ঐটার এখনো দরজা খোলে নাই। আমি আর শহিদুল বেয়াই এক বগিতে আর মেহেদী ভাই অন্য বগিতে। কারণ আমরা আলাদা আলাদা সময়ে টিকিট কাটি, আমাদের টিকিট মেহেদী ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ায় আগেই কাটা। আমার আর বেয়াইয়ের সিট সবার পিছনের বগিতে সবার পেছনে। সবার নামসহ চার্ট টানানো আছে ট্রেনের দরজার পাশে। প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে আড্ডা দিয়ে সময় পার করতে লাগলাম। প্লাটফর্মে আমাদের মতোই বিদেশী সাদা চামড়ার অনেক পর্যটক আছে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে প্রথমে বেয়াই আর পরে আমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
সকাল ঠিক পাঁচটায় ট্রেনের দরজা খুলে দিল। ট্রেনের সিট গুলো ২ বাই ১ (মানে একপাশে ২টা আরেক পাশে একটা করে) এবং মুখোমুখি একই বিন্যাস। সবাই ট্রেনে উঠে পরলাম যার যার ব্যাগ নিয়ে। সারাফাত রাজ ভাই বলেছিলেন ডান পাশে বসার জন্য, তাহলে ভিউটা ভালো পাওয়া যাবে। সৌভাগ্যক্রমে আমার সিটও ডান পাশে জানালার ধারে পড়েছে এবং সিঙ্গেল। কিন্তু বিপত্তি বাধল বেয়াইয়ের সিট নিয়ে। তার সিট জানালার পাশে না এবং বাম পাশে। কিছুক্ষণ পর একটা ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি আসল। তারা ৩ জনের পরিবার। ৬ বছরের একটা মেয়ে যার সিট আমার মুখোমুখি, আর বাকি দম্পতি দুজন বাম পাশে জানালার ধারে মুখোমুখি বসল। আমি আর বেয়াই মিলে ভদ্র লোককে অনুরোধ করলাম যাতে তারা বাচ্চার সিটে বেয়াইকে বসতে দেন আর বাচ্চাকে বেয়াইয়ের সিটে। লোকটা সহজেই রাজী হয়ে গেল। দুই বোতল পানি, জুস আর চিপস কিনে ট্রেন ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
ঠিক সময়েই ট্রেন চলতে শুরু করল। যে রেল লাইন দিয়ে যাচ্ছি এটা ব্রিটিশদের তৈরি। তারা গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে কলকাতা থেকে শিমলা যাওয়ার জন্য এই ট্রেন ব্যবহার করত। টয় ট্রেনগুলোকে ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ৯৮ কি. মি. যাত্রার শুরুতে বুঝতে পারি নাই সামনে কি অপেক্ষা করছে। ট্রেন চলতে শুরু করল আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে। পাহাড় সবসময়ই আমার খুবই পছন্দের। প্রথমেই এক বোতল পানি দিয়ে ট্রেনে স্বাগত জানাল ।
ওদিকে সূর্য মামা পূর্ব আকাশে বেশ লাল হয়ে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা দিল। বড় বড় পাহাড়ের মাঝে একটু পরপর কেথায় যেন মামা হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। এযেন সূর্য মামার লুকোচুরি খেলা। মোবাইলের ক্যামেরাতে যতটুকু সম্ভব স্মৃতি করে রাখার চেষ্টা করছি । এর আগে অনেক শুনেছি যে এই ৯৮ কি.মি. ট্রেন লাইনে অনেক টানেল আছে, প্রায় ১০২ টা। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রথম টানেলে প্রবেশ করলাম। টানেলটা খুব বেশি লম্বা না হলেও আমার হৃদয় ছুয়ে গেছে। জীবনে প্রথম কোন টানেলের মধ্য দিয়ে যাওয়া এ এক অন্যরকম অনুভূতি। কেউ নিজে না গেলে সেই অনুভূতির কথা কাউকে বলে বুঝানো যাবে না।
ট্রেন মাঝে মাঝে ছোট শহর বা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু কাউকেই আমি বিহার বা ভারতের অন্য কোন অঞ্চলের মত সকালে রেল লাইনরে পাশে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দেখিনি। ছোট শহরগুলো দেখে আমার গত বছর দার্জিলিং ভ্রমনের কথা মনে পড়ে গেল, বিশষে করে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দৃষ্টিনন্দন বাড়িগেুলো। আমরা ট্রেনের একদম পিছনের বগিতে হওয়াতে যখন ট্রেন কোন বাঁক নিচ্ছিল তখন ট্রেনের আপাদমস্তক পুরোটাই দেখা যাচ্ছিল। সামনের বগি গুলো থেকে অনেকেই হাত নেড়ে আনন্দ উৎযাপন করছিল। প্রকৃতি যেন সবাইকে তার এত সৌন্দর্যে স্বাগত জানাচ্ছিল আর সবাই তাতে সাড়া দিচ্ছিল।
যখন ছোট ছোট স্টেশন পার হচ্ছিল আমাদের ট্রেন স্টেশন থেকে সবুজ পতাকা দেখিয়ে লাইনে কোন সমস্যা নেই তা জানিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের বগিতে থাকা রেলের এক কর্মকর্তা সিগনাল দেখানো লোক গুলোর সাথে চলতি অবস্থায়ই কথা কুশল বিনিময় করছিলেন। তাদের সাথে ভাবও অন্যরকম বুঝলাম কারণ দিনে কমপক্ষে দুইবার এই লাইনে তাদের দেখা হয় (সকালে কালকা-শিমলা, বিকেলে শিমলা-কালকা)
শিভালিক ডিলাক্স ট্রেনটা আসলেই অনেক সুন্দর। ট্রেনের ছাদ থেকে শুরু করে আমাদের হাত রাখার জায়গা পর্যন্ত পুরোটাই কাঁচের জানালা তাই প্রকৃতির কোন অংশই আমার নজর এড়াচ্ছিল না। সিটগুলো খুব আরামদায়ক। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখলাম এই ট্রেনেরে সকল যাত্রীর মধ্যেই একটা ট্যুরিষ্ট ট্যুরিষ্ট ভাব আছে, সবাই অন্যরকম একটা স্ট্যান্ডার্ড বহন করে, সবার মধ্যে একটা শিক্ষিত শিক্ষিত ভাব আছে (আমি ভুলও হতে পারি)। পাশের ইন্ডিয়ান ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হলাম, তারা চন্ডিগড়ের। কথাবার্তা ইংলিশে বলার চেষ্টা করলাম। জানতে পারলাম তারা প্রায় ১৪ বছর পর শিমলা যাচ্ছেন ছুটি কাটাতে, যদিও চন্ডিগড় আর শিমলা অনকে বেশি দূর না।
মোটামুটি ভালোই বড় একটা টানলে পাড় হবার পরপরই ট্রেন থেমে গেল একটা ছোট স্টেশনে, নাম বারোগ। ১০ মিনিটের যাত্রা বিরতি। এই ফাঁকে টানলেরে মুখে চলে গেলাম আমি আর বেয়াই কিছু ছবি তোলার জন্য। পোজ দিয়ে ভাব নেয়ার চেষ্টা করলাম দুইজনই। কিন্তু আমার ভাবে কি আর ছবি সুন্দর হয়!!! ট্রেনেরে হুইসেল বাাঁজা মাত্রই ট্রেনে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষন পর সকালের নাস্তা দিল। একটা ভেজ আর একটা ননভোজ খাবার টিকিট কাটার সময়ই নির্ধারন করা ছিল। ব্রেড আমার পছন্দের খাবার না। ভেজ-ননভেজ দু'টোতই ব্রেড ছিল। সাথে ছিল জুস, ছোট বাটারের প্যাকেট, সস, ভেজ খাবারের জন্য সবজি, আর ননভেজের জন্য ডিম অমলেট।
নাস্তা খেতে প্রকৃতির সৈন্দর্য উপভোগ করছিলাম। কিন্তু নাস্তা মুখ দিয়ে ঢুকছিল না, কারণ গতকালের স্টেশনের খোলা খাবারগুলো খাওয়ার কারণে বদহজমে ভুগছিলাম। পেটের ভিতর থেকে পঁচা এক ধরনের গন্ধ আসছিল। কিন্তু কাউকে বলিনি। মাথায় শুধু একটা ব্যাপারই ঘুরছিল এই বদহজমের কারনে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করলে আরো বড় ধরনরে অসুস্থ হতে পারি। তখন বাকি সবার জন্য আমাকে নিয়ে ট্যুর দেয়া কষ্ট হয়ে যাবে। তাই সবটা শেষ করে নিজের সাথে আনা ঔষধ খেয়ে নিলাম।
সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছি, কখনো কখনো মনে হচ্ছিল একজায়গা দিয়েই যাচ্ছি। কখনো কখনো সমতল দিয়ে যাচ্ছিল ট্রেন। এত পুরোনো একটা রেল লাইন অথচ কত পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা। তখন কি তারা ভেবেছিল তাদের শৌখিন সময় কাটানোর জন্য তৈরি এই রেল লাইন এত জনপ্রিয় হবে!!
পাহাড়ের গায়ে নাম না জানা নানা ধরনের ফুল ফুঠে আছে। সবুজের মাঝে ফুলগুলো যেন অলংকার। মাঝে মাঝে আপেলের দু-একটা গাছ দেখা যাচ্ছিল, ছোট কাচা আপেল ধরেছিল গাছগুলোতে। নিচের ছোট ছোট শহরগুলো দেখে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল। ছবি তুলতে তুলতে মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ করে ফেললাম। তা জলদি করে ব্যাগ থেকে জলদি করে পাওয়ার ব্যাংকটা বের করে নিলাম যাতে বাকি অংশটার বিশেষ কিছু মিস না হয়ে যায়। এই ছোট শহরগুলোই যদি এত সুন্দর লাগে তবে শিমলা শহরটা না জানি কত সুন্দর হবে!! যত উপরে উঠছিলাম আস্তে আস্তে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওভেন থেকে ফ্রিজে ঢুকতে চলছি (ডিপ ফ্রিজে না কিন্তু)।
ছোট ছোট ব্রীজ, ছোট বড় টানেল আর নয়ানভিরাম পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে কিভাবে যে ৪ ঘন্টা ৪০ মিনিট কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ট্রেন শিমলা স্টেশনের আউটারে দাড়িয়ে আছে। মনে হল এই মাত্র উঠলাম, এখনি কেন নামতে হবে!!!! এ যেন শেষ হইয়াও হইলোা না শেষ.....।