somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ী টু হুমায়ূন আহমেদের জমিদার বাড়ী

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




মন তোরে পারলাম না বুঝাইতেরে...
হায়রে, তুই সে আমার মন..

টানা দশ সপ্তাহ পর গত সপ্তাহ দুয়েক আগে ছুটির দিন প্রকৃতই সারাদিন বাসায় থেকে ছুটি উপভোগ করি। কিন্তু পাগল মন কেন জানি ঘরে টিকতে চায় না। তাইতো গত সপ্তাহে পানাম নগর ঘুরে এসে মনটা আকুপাকু করছিল। বুধবার ডিসিশন নিলাম এইবার যাব গাজীপুরের জমিদার বাড়ীগুলো দর্শনে। খুঁজে পেতে দেখা গেল বিখ্যাত কয়েকটি জমিদারবাড়ী রয়েছে গাজীপুরে। অফিসে বসে বসেই কয়েকবার গুগল ম্যাপে রুট প্ল্যান করে শেষে ঠিক করলাম ভাওয়াল জমিদার বাড়ী দিয়ে শুরু করে পথে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান হয়ে যাব লেখক হুমায়ূনের জমিদার বাড়ী দেখতে। পাঠক অবাক হবেন না, হুমায়ূন আহমেদের “নুহাশ পল্লী” ঘুরে আসলে আপনিও মানতে বাধ্য এটা আধুনিক কালের বাংলার জমিদার বাড়ী বলা যায়।

গত সপ্তাহের পানাম নগর গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ একাকী। একা একা ঘুরতে আলাদা মজা থাকলেও আমি দলবদ্ধ হয়ে ঘুরতেই পছন্দ করি। বন্ধু মনা এবার আমার সঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও ব্যাস্ততার কারনে তাকে এবার পেলাম না। শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে টিনেজ পার করা দুই খালাতো ভাইকে এবার সঙ্গী করলাম। এদের একজন আবার মহা হুমায়ূন ভক্ত। আগের দিনই পুরো ভ্রমণের খসড়া করে শিডিউল আকারে প্রিন্ট করে নিলাম। পরের দিন সকাল সাতটায় যাত্রা হবে শুরু।

দুই খালাত ভাইকে নিয়ে সকাল সাতটায় যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে নাশতা সেরে নিয়ে শাহবাগ হতে গাজীপুর শিববাড়ীগামী ঢাকা পরিবহণের গাড়ীতে করে রওনা দিলাম। ঢাকার যে কোন প্রান্ত হতে গাজীপুরগামী বাসে করে যে কেউ চলে আসেতে পারেন গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা। সেখান থেকে বামে চলে গেছে শিববাড়ীর রাস্তা। শিববাড়ী বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যায় ঢাকা পরিবহন, বিআরটিসির গাড়ীগুলো। ভাড়া ৪০-৬০ টাকার মধ্যে। আমরা নামলাম শিববাড়ী বাসস্ট্যান্ডে, সেখান থেকে চার্জিত ব্যাটারিচালিত রিকশা করে ২০ টাকার ভাড়ায় গেলাম ভাওয়াল রাজবাড়ী যা এখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হিসেবে ব্যাবহার হচ্ছে।


ভাওয়ালের রাজবাড়ী ছিল ভাওয়াল এস্টেটের মূল পরিচালনা কেন্দ্র। ভাওয়াল এস্টেট পরিধি এবং আয়ের দিক থেকে পূর্ব বাংলায় নওয়াব এস্টেটের পরেই ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি। ভাওয়াল জমিদার বংশের পূর্বপুরুষগণ মুন্সিগঞ্জের অন্তর্গত বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বলে জানা যায়। এই বংশের জনৈক বলরাম সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভাওয়াল পরগনার জমিদার দৌলত গাজীর দীউয়ান হিসেবে কাজ করতেন। বলরাম এবং তার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ তৎকালীন বাংলার দীউয়ান মুর্শিদকুলী খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন এবং কৌশলে গাজীদের বঞ্চিত করে জমিদারি হস্তগত করেন।


রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মুর্শিদকুলী খান বহু মুসলমান জমিদারকে বিতাড়িত করে তদ্‌স্থলে হিন্দু জমিদার নিযুক্ত করেন। ভাওয়ালের গাজীগণ মুর্শিদকুলী খানের এই নীতির কারণে জমিদারি স্বত্ব হারান। ১৭০৪ সালে শ্রীকৃষ্ণকে ভাওয়ালের জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকে এই পরিবারটি ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে এই জমিদারির অধিকারী ছিলেন। ১৮৫১ সালে পরিবারটি নীলকর জেমস ওয়াইজ এর জমিদারি ক্রয় করে। এই ক্রয়ের মাধ্যমে পরিবারটি সম্পূর্ণ ভাওয়াল পরগনার মালিক হয়ে যায়। ১৮৭৮ সালে এই পরিবারের জমিদার কালীনারায়ণ রায়চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বংশানুক্রমিক ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। কালীনারায়ণের পুত্র রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী এই জমিদারির আরও বিস্তৃতি ঘটান। এই সময়ই ভাওয়াল জমিদারি ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিবর্তিত হয়।


ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারি ব্যবস্থাপনা ছিল সবিশেষ দক্ষতাপূর্ণ। দেশের বেশির ভাগ জমিদার বিভিন্ন শহরে অনুপস্থিত জমিদার হিসেবে বাস করলেও ভাওয়ালের রাজা কিন্তু জমিদারির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত জয়দেবপুর গ্রামে বাস করতেন। রাজা নিজেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। সনাতনীভাবে বেশির ভাগ বড় জমিদার তাদের জমিদারি ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের নায়েব গোমস্তাদের ওপর নির্ভর করতেন। কিন্তু ভাওয়াল রাজা এই ব্যবস্থাপনা স্বহস্তেই করতেন এবং প্রতিদিন ও নির্ধারিত সময়ে কাচারিতে বসতেন। সম্পূর্ণ জমিদারিটি কয়েকটি সার্কেলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি সার্কেল একজন মফস্বল নায়েবের ওপর ন্যস্ত ছিল, যাকে একদল তহসিলদার, মুহুরি, জমাদার, পিয়ন, ঝাড়ূদার এবং কুলি সাহায্য করত। এছাড়াও তার অধীনে থাকত একদল লাঠিয়াল, যাদেরকে প্রয়োজনে অবাধ্য রায়তদেরকে অনুগত করার কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি গ্রামে একজন করে মণ্ডল নামে জমিদারির কর্মকর্তা থাকত, যার মাধ্যমে সেই গ্রামের খাজনা আদায় করা হতো। জমির খাজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে প্রতিটি গ্রাম জরিপ করা হতো। বাংলার অন্যান্য জমিদারের মতো ভাওয়াল রাজা কিন্তু সাধারণভাবে কোন মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করেন নি। জমিদারির প্রধান কাচারি জয়দেবপুরেই অবস্থিত ছিল। এই কাচারিতে রাজার জন্য একটি গদি বা বিশেষ আসন ছিল। জমিদারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দীউয়ান বলা হতো, যার অধীনে ছিল একজন উপ-দীউয়ান, কয়েকজন নায়েব ও গোমস্তা। জমিদারির বিভিন্ন এলাকার জন্য দীউয়ান খানায় আলাদা আলাদা ডেস্ক ছিল এবং প্রতিটি ডেস্কের জন্য বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল।

ভাওয়াল এস্টেটের সর্বশেষ ক্ষমতাবান জমিদার ছিলেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন তাঁর দীউয়ান। উল্লেখ্য যে, কালীপ্রসন্ন ঘোষ ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান লেখক ছিলেন। রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর ছিল তিন পুত্রসন্তান। তাঁরা হলেন রণেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, রমেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। ১৯০১ সালে রাজেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়। এই সময় তাঁর তিনপুত্র সন্তানই ছিলেন নাবালক। সে কারণে জমিদারিটি একবার ১৯০১ সালে এবং আর একবার ১৯০৪ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে চলে যায়। রাজেন্দ্রনারায়ণের তিন পুত্র সন্তানকেই একজন ইউরোপীয় গৃহ-শিক্ষক লেখাপড়া শেখাতেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিন পুত্রই ছিলেন অজ্ঞ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ, লেখাপড়া ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত অমনোযোগী। একবার দ্বিতীয় পুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ চিকিৎসার জন্য দার্জিলিং গমন করেন। সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় এবং যথারীতি দাহ করা হয় বলেও দাবী করা হয়। অপর দুই পুত্রও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন এবং পরিবারটি পুত্র সন্তানবিহীন অবস্থায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় পুত্র সন্তানটি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি বহুদিন যাবৎ সন্ন্যাসী হিসেবে জীবন যাপন করেন। পরিশেষে ১৯২০ সালের শেষের দিকে তিনি নাটকীয়ভাবে দারুণ সাড়া জাগিয়ে প্রায় ১২ বছর পর ঢাকায় এসে উপস্থিত হন এবং তার জমিদারি দাবি করেন। এভাবেই ১৯৩৫ সালে শুরু হয় বিখ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা, যা সমগ্র বাংলায়, এমনকি বাংলার বাইরেও প্রায় এক যুগ ধরে খবরের কাগজে সংবাদ এবং নানা ধরনের গল্প গুজবের প্রধান উপাদান হয়ে থাকে। এমনকি ঘটনাটি সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য, নাটক এবং সিনেমারও বিষয়বস্তু হয়। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার পরে জমিদারির উত্তরাধিকারের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে এবং ফলে এর ব্যবস্থাপনা ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনেই থেকে যায়। যেহেতু উত্তরাধিকারী নিয়ে বহু জটিলতা ছিল এবং জমিদারি সংক্রান্ত বহু মামলাও অমীমাংসিত ছিল, সে কারণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পরেও এর বিষয়-সম্পত্তি বা দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে বণ্টন করা সম্ভব হয় নি। ফলে পাকিস্তান আমলেও জমিদারিটি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনেই থাকে। বর্তমানে ভাওয়াল এস্টেটের কর্মকাণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ড পরিচালনা করে।


গাজীপুর জেলা শহরের প্রাণকেন্দ কালের সাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ী। সাধারণ কোন রাজবাড়ী বলতে আমরা যা বুঝি এটি কিন্তু তা নয় । আসলে বিশাল এক রাজপ্রাসাদ এটি। আয়তন এবং কক্ষের হিসাবে এত বড় বিশাল রাজপ্রাসাদ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। দ্বিতল এ রাজপ্রাসাদটিতে সর্বমোট কক্ষ রয়েছে ৩৬৫টি। প্রায় ৫ একর জায়গার উপর রাজপ্রাসাদটি নির্মিত হয়েছে। এটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর পশ্চিম পার্শ্বেই রয়েছে বিশাল একটি দীঘি এবং সামনে রয়েছে বিশাল সমতল একটি মাঠ। এতবড় মাঠও সমগ্র বাংলাদেশে আর নেই। রাজবাড়িটির পুরো এলাকাই সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।

এর মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকে একেবারে পিছনে যেতে হলে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, পেরুতে হবে অনেক অলিন্দ আর বারান্দা। বিশাল এ রাজপ্রাসাদটির বিশালত্ব দেখে যে কেউ অভিভূত হবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অনেকেই রাজবাড়ীতে ঢুকে গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যাবেন - এর অলিন্দ গলি উপগলি দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে পুনরায় সেগুলো খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়বে। রাজবাড়ীর প্রতিটি স্থানে প্রতিটি কক্ষে যেতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে ঢুকতে হবে এতে।

কিছুটা সময় ভাওয়ালের রাজবাড়ীতে কাটিয়ে রওনা দিলাম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে। ভাওয়াল রাজবাড়ী থেকে রিকশাযোগে কালিবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে লোকাল বাসে করে ৫ টাকা ভাড়ায় গেলাম গাজীপুর চৌরাস্তায়। সেখান থেকে হিউম্যান হলারে করে গেলাম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। ভাড়া নিল ১৫ টাকা। ভাওয়াল বনের তিন নাম্বার গেট বললে হলার চালক আপনাকে নামিয়ে দিবে। ঢুকতেই চোখে পরবে সুন্দর নকশা করা একটি প্রবেশদ্বার, বিশেষ করে হাতির নকশাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। প্রায় দেড়যুগ পরে এলাম ন্যাশনাল পার্কে, আগে যা অতি বিখ্যাত ছিল পিকনিক স্পট হিসেবে।


ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানটি রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর জেলার গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর উপজেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন (১৯৭৪) অনুযায়ী ৫,০২২ হেক্টর জায়গা জুড়ে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের আদলে অভয়ারণ্যের ছাঁচে ভাওয়াল শালবনে এই উদ্যান গড়ে তোলে। ১৯৮২ সালের আগে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষিত।


ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে একসময় বাঘ, কালোচিতা, চিতাবাঘ, মেঘাবাঘ, হাতি, ময়ূর, মায়া হরিণ ও সম্বরহরিণ দেখা যেত। ১৯৮৫ সালে এ বনে খেঁকশিয়াল, বাগদাস, বেজী, কাঠবিড়ালী, গুঁইসাপ আর কয়েক প্রজাতির সাপ দেখা গেছে। একটি হিসাব অনুযায়ী, ভাওয়াল গড়ে ৬৪ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে যার মধ্যে ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১০ প্রজাতির উভচর ও ৩৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বনবিভাগ এ বনে অজগর, ময়ূর, হরিণ ও মেছোবাঘ ছেড়েছে। এছাড়া ২০১২ সালে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ১৬টি তক্ষক ছাড়া হয়।


ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান মূলত ক্রান্তীয় পতনশীল পত্রযুক্ত বৃক্ষের বনভূমি। এ বনে ২২১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে যার মধ্যে ২৪ প্রজাতির লতা, ২৭ প্রজাতির তৃণ, ৩ প্রজাতির পামজাতীয় বৃক্ষ, ১০৫ প্রজাতির ঔষধি, ১৯ প্রজাতির গুল্ম, ৪৩ প্রজাতির বৃক্ষ। শাল (Shorea robusta) এ উদ্যানের প্রধান বৃক্ষ। অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে কাঁঠাল, আজুলি, কুম্ভী, গান্ধী গজারি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এ বনে কৃত্রিমভাবে ইউক্যালিপটাস আর রাবারের বনায়ন করা হয়েছে। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের আকর্ষণীয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট রয়েছে। স্পটগুলোর হলো: আনন্দ, কাঞ্চন, সোনালু, অবকাশ, অবসর, বিনোদন। এখানকার কটেজগুলো হলো: বকুল, মালঞ্চ, মাধবি, চামেলী, বেলী, জুঁই ইত্যাদি। এখানে ১৩টি কটেজ ও ৬টি রেস্টহাউজ রয়েছে। রাত্রি যাপনের জন্য এখানে অনুমতি দেওয়া হয় না। পিকনিক স্পট কিংবা রেস্ট হাউস ব্যবহার করতে হলে বন বিভাগের মহাখালী কার্যালয় থেকে আগাম বুকিং দিতে হয়। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ ফি ১০ টাকা।


এখানে রয়েছে চারিদিকে শালবন ইচ্ছে হলে হারিয়ে যেতে পারেন শালবনে। তবে সাবধান, এখানে প্রায়ই ছিনতাই, ডাকাতি হয়ে থাকে; এই ব্যাপারে কয়েক জায়গায় সতর্কতা সম্বলিত নোটিশবোর্ড রয়েছে। “বিপদজনক এলাকা, প্রবেশ নিষেধ” সাইনবোর্ড দেখে ভাবলাম বন্যপ্রাণীর কারণে এই সাবধান বানী। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম এটা সেই ছিনতাই, ডাকাতি’র হাত থেকে পর্যটকদের বাঁচাতে দেয়া। মনে পড়ল দেড় যুগ আগে আসা পিকনিকের ঘটনা। বনে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ঘণ্টাখানেক লেগেছিল দলের সবাইকে খুঁজে পেতে। যাই হোক, এখানে আপনি দেখতে পাবেন শালবনের সারি, প্রজাপতি পার্ক, মিনি জাদুঘর, অবজারভেশন টাওয়ার (২ টাকার টিকেট কাটতে হবে)। আমরা ঘণ্টা দেড়েক কাটিয়ে বের হয়ে এলাম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান থেকে। এবারের গন্তব্য নুহাশ পল্লী। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের গেট হতে বের হয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে একটি হিউম্যান হলারে উঠলাম হোতাপাড়ার উদ্দেশে। তবে সরাসরি মনিপুর অথবা পিরুজালিগামী হিউম্যান হলারও পেতে পারেন, সেক্ষেত্রে নেমে পরবেন পিরুজালী সরকার বাড়ী চৌরাস্তায়, হিউম্যান হলারের ড্রাইভারকে বলবেন নুহাশ যাওয়ার রাস্তায় নামাতে।

আমরা হোতাপাড়া এসে আরেকটি হিউম্যান হলারে করে পিরুজালী চৌরাস্তায় নেমে পরলাম। এখানে নেমে সরকার বাড়ী চৌরাস্তার জামে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে পালা এখন দুপুরের খাবারের। হোতাপাড়া বা পিরুজালী চৌরাস্তায় কোন খাবারের হোটেল নাই। কিছু রিকশাচালক পরামর্শ দিলে পিরুজালি থেকে ভেতরে কয়েক কিলোমিটার দুরের কোন এক বাজারে যেয়ে খেয়ে আসতে, সেখানে নাকি অনেকগুলো খাবার হোটেল রয়েছে। আবার আরেক জায়গায় যাওয়ার ঝক্কি বাদ দিয়ে শুকনো খাবার দিয়ে কাজ সারার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু বিধিবাম, আশেপাশের প্রতিটি ড্রাইফুড দেখলাম এক্সপায়ার ডেট পার করেছে, পাউরুটি জাতীয় কিছু খাবারে দেখলাম ছত্রাক আক্রমন করেছে কিন্তু তবুও তা দোকানের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। শেষে এক কিশোর রিকশাচালক জানালো নুহাশপল্লীর গেটে তেহারি বিক্রি করে, সেখানে গিয়ে খেতে। পিরুজালী হতে ত্রিশটাকা ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় রওনা হলাম নুহাশপল্লীর উদ্দেশে। মিনিট দশেকের এই জার্নি খুবই উপভোগ করলাম। রিকশাগুলো ব্যাতিক্রম। প্লাস্টিক বডির চওড়া সিটগুলোর হুড একেবারে পরে গিয়ে বডির পেছনে ঝুলে থাকে, ফলে সিটের চারিদিকে পুরোটাই খোলা। সাধারণ রিকশার তুলনায় একটু বেশী গতিতে ছুটে চলা সরু পথে, শরীর ছুয়ে যায় মৃদু বাতাস।


নুহাশের গেটে পৌঁছে তেহারি পেলাম না, তবে সাদা ভাত, ছোট মাছের চচ্চরি, আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে জম্পেশ খেলাম। দুইশত টাকা টিকেট কেটে ঢুকতে হয় নুহাশ পল্লীর ভেতর, যা আমার কাছে একটু বেশীই ভনে হয়েছে। যাই হোক টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকতেই হাতের ডানদিকে রয়েছে একটি মা ও বাচ্চার মূর্তি, তার পাশে একটি ছাউনি। সেখানে দেখলাম “অন্যপ্রকাশ” এর স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম পরিবার নিয়ে বসে আছে, হুমায়ূন ভক্ত আমার খালাত ভাই হুমায়ূন পুত্র নিনিদকেও দেখেছে।



ছাউনির পাশেই রয়েছে একটি কঙ্কালের মূর্তি যার নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে গেছে, আর সেই দাঁতের আকারে মূর্তির নীচে রয়েছে একটি সুইমিংপুল। কঙ্কালের মুখ হতে সুইমিংপুলে পানি পড়ছে, সুইমিংপুলের সেই পানি কৃত্রিমউপায়ে নীলাভ করা হয়েছে।



সুইমিংপুলের পাশেই রয়েছে ছোট একটা কটেজ টাইপের রুম, হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে এসে এখানেই থাকতেন। কটেজের অপর পাশেই রয়েছে দুটি নকশাদার টেবিল-চেয়ার পাতা, যার প্রথমটির পাশে রয়েছে একটি কৃষ্ণকায় নগ্নবক্ষা নারীমূর্তি।



আরেকটু এগিয়ে গেলে পাবেন “বৃষ্টি বিলাস” নামক কটেজটি। এটির ছাদ টিনের তৈরি যেন বৃষ্টির সময় বৃষ্টির শব্দ উপভোগ করা যায়। সুন্দর নকশা, ফলস সিলিং দেয়া কটেজটির আউটলুক সুন্দর। একটু ভেতরে আরেকটি কটেজ রয়েছে যার নাম “ভূত বিলাস”। দুই রুমের আধুনিক এই কটেজটির পেছনে ছোট পুকুর রয়েছে যার চারিদিক সুন্দর ঘাসে মোড়া ঢাল দিয়ে ঘেরা, এই ঢালের চারিদিকে রয়েছে গাছ-গাছালী।



“ভূত বিলাস”এর পাশ দিয়ে একটি নড়বড়ে কাঠের সাকো রয়েছে পুকুরের মাঝখানের ছোট্ট একটুকরো দ্বীপাকারের ভূখণ্ডে যাওয়ার। সেখানে পুকুরের মাঝখানে একটি গাছের তলায় দুটি কাঠের বেঞ্ছি রয়েছে। আমরা তিনজন সেখানে গান শুনলাম কিছুক্ষন বসে বসে। চমৎকার অনুভুতি।



ভূত বিলাসকে একপাশে রেখে অন্য পাশে রয়েছে দুটি দোলনা, স্লিপার; বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্য। বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্য আরও রয়েছে কিছু ডাইনোসর, মানব ভূত, মারমেইড সহ বিভিন্ন ভাস্কর্য। এর পাশে পুকুরের কিনারে আরেকটি মাটির ঘর রয়েছে।



তার পাশেই রয়েছে বৃক্ষপ্রেমী হুমায়ূন আহমেদের সেই বিখ্যাত বাগান যেখানে তিনি জড়ো করেছিলেন নানান ধরনের বৃক্ষসমূহ। এপাশ দিয়ে প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে গেলে পাবেন হুমায়ূনের সলিল সমাধি। মূল ফটকের বাইরে দিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য পৃথক পথ রয়েছে। এছাড়া নুহাশ পল্লীর সবুজ ঘাসে মোড়া চত্বরের মাঝখানে রয়েছে একটি ছোট্ট বটগাছ সদৃশ গাছ যার কাণ্ডর চারিদিকে বাঁধানো চত্বর। আরেকটু সামনে একটি গাছের উপর দুটি ছোট্ট বাঁশের বেড়ার তৈরি ঘর, যা শৌখিন হুমায়ূনকে রেপ্রেজেণ্ট করে। সামনে রয়েছে আরেকটি ছাউনির নীচে বিশাল কাঠামোর দাবার কোর্ট যার ফুট দুয়েক উঁচু উঁচু ঘুটি। জমিদারী কারবার কাকে বলে।



পুরো নুহাশ পল্লী ঘুরে দেখার পর আপনি বলতে বাধ্য হবেন, নুহাশ পল্লী আসলেই একটি আধুনিক জমিদার বাড়ী। আর তাইতো লেখার
শিরোনামে বলেছি “হুমায়ূন আহমেদের জমিদার বাড়ী”।

বিকাল চারটা নাগাদ বের হয়ে এলাম নুহাশ পল্লী হতে। রিকশাযোগে পিরুজালী এসে একটি হিউম্যান হলারে সরাসরি চলে এলাম গাজীপুর চৌরাস্তায়। এখান হতে ঢাকাগামী বাসে করে নিজ ডেরায়। সাথে নিয়ে এলাম আনন্দময় একগুচ্ছ স্মৃতি। মন এখনও নেচে চলেছে আগামী সপ্তাহে কোথায় যাবো এই আনন্দে। হায়রে মন! “মন তোরে পারলাম না বুঝাইতেরে...”।মন তোরে পারলাম না বুঝাইতেরে... হায়রে, তুই সে আমার মন...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৪ রাত ৯:২৯
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×