পিকচার হাউজ
ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ পিকচার হাউজ স্থাপিত হয় বিশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আরমানিটোলায়। এই একতলা প্রেক্ষাগৃহটি পরে শাবিস্তান নামে পরিচিতি পায়। সম্ভবত এই প্রেক্ষাগৃহের স্থানটি প্রথমে ছিল নবাব ইউসুফ খান এস্টেটের কবরস্থান। পরে লেজার নামে জনৈক ইংরেজ এটি কিনে পাটের গুদাম নির্মাণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লেজার ঢাকা ত্যাগ করলে উদ্দভজী ঠাকুর নামের এক মারোয়াড়ী এর দায়িত্ব নেন। প্রতিষ্ঠার পরে দীর্ঘদিন নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন অব্যাহত থাকার পর কয়েক দশক আগে প্রেক্ষাগৃহটিতে বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম দিকে হারিকেন লণ্ঠন জ্বেলে এখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হত। প্রেক্ষাগৃহটির এককোণে নারীদের জন্য বসার আলাদা ব্যবস্থা ছিল। ১৯১৫ সালে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর কথা চিন্তা করে শুরু হয় পিকচার হাউজের যাত্রা। ১৯২২-২৩ সালের দিকে বিক্রমপুরের এক ব্রাহ্মণ এটির মালিক হন। সেপ্টেম্বর ১৯২৮ সালে পিকচার হাউজে বায়েস্কোপের আয়োজন করা হয়। এতে বেশ কয়েকটি বায়েস্কোপ প্রদর্শিত হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- মাই ড্যাডি, গুলবা সানোয়ার। ১৯৪০ সালে রাজেন্দ্র কুমার গুহ ও মতিলাল বসু নিউ পিকচার হাউজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে প্রেক্ষাগৃহটিতে প্রতিদিন দুটি এবং বরিবার ছুটির দিতে তিনটি শো প্রদর্শীত হত।
সিনেমা প্যালেস
১৯২৪ সালে সদরঘাটের চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউতে স্থাপিত হয় ঢাকার দ্বিতীয় নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহ সিনেমা প্যালেস। জানা যায়, বাংলাবাজারের জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের জমি ইজারা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহটি নির্মাণ করা হয়। প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এর মালিকানা চলে যায় জনৈক মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীর কাছে। সিনেমা প্যালেসের নাম বদল করে রাখা হয় ‘মোতিমহল’। এর কিছুদিন পর প্রেক্ষগৃহটি চলে যায় মুকুল ব্যানার্জীর ‘ঢাকা পিকচার্স প্যালেস কোম্পানী’র হাতে। এসময় আবারো নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘রূপমহল’। প্রেক্ষাগৃহটি টিকে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত এ নামই পরিচিত ছিল। ১৯২৯ সালে চলচ্চিত্র প্রদর্শন নিয়ে স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে রোষের দাবানলে পরে প্রেক্ষাগৃহটি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি পরিচালিত ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা দেখা দেয়। চলচ্চিত্রটির কয়েকটি অংশ নিয়ে উত্তেজিত মুসলমানরা প্রেক্ষাগৃহটি পুরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। চলচ্চিত্রটির দুটি দৃশ্য কেটে বাদ দিয়ে প্রদর্শন করা হলে উত্তেজনা কমে। ১৯২৯ সালে রূপমহলে প্রদর্শিত হয় ডন জুয়ান (জানুয়ারি) ছবিটি। এ প্রেক্ষাগৃহে বিশ শতকের বিশ-ত্রিশের দর্শকে প্রদর্শিত ছবির মধ্যে ছিল- দেবী চৌধুরাণী, বিল্মমঙ্গল, ঋষির প্রেম, দুর্গেশ নন্দিনী, জয়দেব, দি গুড আর্থ, দিদি প্রভৃতি। প্রেক্ষাগৃহটি বর্তমানে আর নেই।
লায়ন সিনেমা
১৯২২-২৩ সালে ঢাকার মির্জা আবদুল কাদের সরদার এ ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটারের কর্তৃত্ব নেন। বিশ শতকের শুরুতে ঢাকায় নাট্যচর্চার গতি রহিত হয়ে তিনি ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার হাউজকে ১৯৩০ সালের (মতান্তরে, ১৯৩১) দিকে রূপান্তরিত করেন প্রেক্ষাগৃহে। সে সময় প্রেক্ষাগৃহটি পরিচিতি পায় লায়ন সিনেমা নামে। ইংরেজি এল অক্ষরের আকৃতির দোতলা প্রেক্ষাগৃহটি ছিল ইসলামপুরের সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের সম্মুখে। ১৯৩১ সালে এ প্রেক্ষাগৃহে সবাক চিত্রের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। মির্জা আবদুল কাদের সর্দারের মালিকানায় নাট্যমঞ্চটি প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত করা হয়। লায়ন সিনেমা হলে ত্রিশের দশকে প্রদর্শিত ছবির মধ্যে ছিল- বোম্বাই কি বিল্লি, আলীবাবা আওর চল্লিশ চোর, কিং সলোমন’স মাইনস, স্যামসন অ্যান্ড ডেলিলা, জুলিয়াস সিজার, লা পরওয়া, প্রাণ প্রেয়সী প্রভৃতি। এই প্রেক্ষাগৃহেই উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ প্রথম মুক্তি পায়। এ প্রেক্ষাগৃহটি আর নেই।
মুকুল হল/আজাদ সিনেমা হল/এমপায়ার থিয়েটার
জনসন রোডে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের আজাদ প্রেক্ষাগৃহটি প্রথমে পরিচিত ছিল ‘মুকুল হল’ নামে। ঢাকা পিকচার্স প্যালেসের প্রতিষ্ঠাতা মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জী প্রেক্ষাগৃহটি প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র দি লাস্ট কিস চলচ্চিত্রটি এ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ১৯২৯ সালে এ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত ছবির মধ্যে ছিল- দি প্রিন্স স্টুডেন্ট (সেপ্টেম্বর), ছাওয়াবির (সেপ্টেম্বর), গ্যাটবুত এ্যান্ড জরিন (অক্টোবর) প্রভৃতি। ত্রিশের দশকে এ প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত অন্যান্য ছবির মধ্যে ছিল- চণ্ডীদাশ, সীতা, কপাল কুণ্ডলা, সোনার সংসার, প্রহলাদ, গোরা, সাইন অব দ্যা লায়ন, এ্যান্ড্রোকলস এ্যান্ড দ্যা লায়ন, লরেল হার্ডি, চার্লি চ্যাপলিন প্রভৃতি। এছাড়া দেশ ভাগের আগে বিভিন্ন সময় প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল- মণি কাঞ্চন, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, পাতালপুরী, বিদ্যাসুন্দুর, ডাকু মনসুর, এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস প্রভৃতি।
মানসী সিনেমা
বালিয়াদী জমিদার পরিবারের সদস্যরা মিলে বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ঢাকার বংশালে প্রতিষ্ঠা করেন মানুসী সিনেমা হল। প্রায় বর্গাকার দোতলা এ প্রেক্ষাগৃহটির আয়তন খুব বড় না। বর্তমানে কোনো মতে প্রেক্ষাগৃহটি টিকে আছে।
মায়া সিনেমা
স্টার সিনেমা হলটি প্রতিষ্ঠাকালে পরিচিত ছিল মায়া সিনেমা নামে। প্রেক্ষাগৃহটি সম্ভবত বিশ শতকের চল্লিশের দশকে ওয়াইজঘাটে স্থাপন করা হয়। এ প্রেক্ষাগৃহটি এখন শুধুই অতীত।
তাজমহল
বিশ শতকের চল্লিশের দশকে ঢাকার মোখলেসুর রহমান ও আরিফুর রহমান দুই ভাই মিলে মৌলভীবাজারের কাছে চকবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন তাজমহল সিনেমা হলটি। এ প্রেক্ষাগৃহটিও এখন আর টিকে নেই।
নাগর মহল
গত শতকের চল্লিশের দশকে ঢাকার নাগর বাবু ইংলিশ রোডে একটি প্রেক্ষাগৃহ স্থাপন করেন। প্রেক্ষাগৃহটি পরিচিতি পায় নাগর মহল নামে। পরে এ প্রেক্ষাগৃহটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় চিত্রমহল নামে। দোতলা এ প্রেক্ষাগৃহটি কোনোমতে এখনো টিকে আছে।
ব্রিটানিয়া
পল্টন ময়দানে স্টেডিয়ামের স্থলে ছিল ব্রিটানিয়া নামের প্রেক্ষাগৃহটি। প্রেক্ষাগৃহটিতে শুধু ইংরেজি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হত। হলের প্রবেশমুখের উপরে ইংরেজি ‘ব্রিটানিয়া’ নামের নিচে লেখা ছিল ঐড়সব ড়ভ ঊহমষরংয চরপঃঁৎবং. প্রেক্ষাগৃহটি বহু আগেই ইতিহাস হয়ে গেছে। পল্টনের খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা এ প্রেক্ষাগৃহটি অনেকটা লম্বাটে। ছাদ ছিল টিনের। এ প্রেক্ষাগৃহে শুধু সন্ধ্যা ছয়টা আর রাত নয়টার শো প্রদর্শিত হত।
নিউ প্যারাডাইস
ঢাকায় নিউ প্যারাডাইস নামে আরেকটি প্রেক্ষাগৃহের নাম জানা যায়। এ প্রেক্ষাগৃহটিতেও প্রদর্শিত হত ইংরেজি চলচ্চিত্র। সম্ভবত এ প্রেক্ষাগৃহটি ছিল সাতরোজা মহল্লায়। প্রেক্ষাগৃহটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
চিত্রালয়
বিশ শতকের ত্রিশের দশকে চিত্রালয় নামে সদরঘাটে একটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেলেও এর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না।
Info Courtesy:
bn.wikipedia.org/wiki/উইকিপিডিয়া
http://www.dhakashohor.com
বাংলাদেশের প্রথম ও প্রাচীন গ্রন্থ - খন্দকার মাহমুদুল হাসান
অতীত দিনের স্মৃতি - আবুল কালাম সামসুদ্দীন
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৫৯