somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঐতিহ্যের খোঁজে মুন্সীগঞ্জ

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইদানীং একটা মজার কাজ শুরু করেছি, হুট করে বুধ বা বৃহস্পতিবার প্ল্যান করি শুক্রবার সারাদিনের জন্য ডে লং ট্রিপের। এতে করে কিছু ভ্রমণবন্ধু মজা পায়, কিছু বিরক্ত হয়। গত মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ এক বৃহস্পতিবার প্ল্যান করলাম মুন্সীগঞ্জ যাবার। নানান কাহিনীর পর শেষে আর যাওয়া হল না। আর তাই এই মাসের ডে-লং ইভেন্ট হিসেবে রাখা হয় “দুর্গ দর্শনে”- মুন্সীগঞ্জ। এপ্রিলের প্রথম শুক্রবার ভ্রমণ বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের দল রওনা হই ঐতিহ্যের খোঁজে মুন্সীগঞ্জ।
আগের দিন ভোররাত থেকে ঢাকায় চলছিল তুমুল বৃষ্টিপাত। আগের রাতে দেরী করে ঘুমুতে গিয়েছিলাম, অ্যালার্মের শব্দে ঘুমে জড়ানো চোখ মেলে দেখি তুমুল বৃষ্টি, মনে মনে একটু খুশীই হলাম! কারন, আরেকটু ঘুমাতে পারব এই বৃষ্টিমুখর প্রভাতে।

কিন্তু বিধিবাম, তাহসিন মামা ফোন করে জানালো ইভেন্ট ক্যান্সেল হচ্ছে না, এক ঘণ্টা পিছিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ রওনা হব আমরা। সবাই শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের গেটে মিলিত হলাম। উত্তরা এবং মিরপুর থেকে কয়েকজন এই বৃষ্টি’র মাঝেই রওনা হয়ে যথাসময়ে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে অবশ্য বৃষ্টিও উধাও। যাই হোক সাড়ে সাতটা’র দিকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। শুরুতে পুরাতন ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের ‘নীরব হোটেল’ এ সকালের নাশতা সেরে নিলাম, মেন্যু লুচি-ভাজি, পরাটা, রুটি, ডিমভাজা, ডাল। সাড়ে আটটার আগেই আমাদের মাইক্রোবাস ‘মেয়র হানিফ উড়াল সেতু’ পার হয়ে ধরলো মুন্সীগঞ্জের পথ। প্রথম গন্তব্য মন্সিগঞ্জ সদর এলাকার নিকটবর্তী “ইদ্রাকপুর দুর্গ”।



ইদ্রাকপুর কেল্লা মুন্সীগঞ্জ জেলার মুন্সীগন্জ শহরে অবস্থিত একটি মোঘল স্থাপত্য। বাংলার সুবাদার ও সেনাপতি মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দে বর্তমানে মুন্সীগন্জ জেলা সদরে তদানীন্তন ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে ইদ্রাকপুর নামক স্থানে এই দুর্গটি নির্মান করেন। সুরঙ্গ পথে ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে এই দুর্গের যোগাযোগ ছিল বলে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দুর্গটি নারায়নগন্জের হবিগন্জে ও সোনাকান্দা দূর্গের চেয়ে আয়তনে কিছুটা ছোট। ৮২ মি.বাই৭২ মি. আয়তাকার নির্মিত ইটের তৈরি এই দূর্গটি তৎকালীন মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজ আক্রমণের হাত থেকে ঢাকা ও নারায়নগন্জ সহ সমগ্র এলাকাকে রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়।



সুউচ্চ প্রাচীর বিশিষ্ট এই দুর্গের প্রত্যেক কোনায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী। দূর্গাভ্যন্তর থেকে শত্রুর প্রতি গোলা নিক্ষেপের জন্য প্রাচীরের মধ্যে অসংখ্য চতুষ্কোনাকার ফোঁকর রয়েছে। একমাত্র খিলানাকার দরজাটির অবস্থান উত্তর দিকে। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ৩৩ মিটার ব্যাসের একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ রয়েছে। দুর থেকে শত্রুর চলাচল পর্যবেক্ষনের জন্য প্রায় প্রতি দূর্গে এই ব্যবস্থা ছিল। এই মঞ্চকে ঘিরে আর একটি অতিরিক্ত প্রাচীর মূল দেয়ালের সাথে মিলিত হয়েছে। দূর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সূদৃঢ় করার জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল।



মোঘল স্থাপত্যের একটি অনন্য কীর্তি হিসেবে ইদ্রাকপুর দূর্গটি ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। বেলা দশটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মুন্সীগঞ্জ সদরের পুরাতন কাচারি এলাকাস্থ ইদ্রাকপুর। দুর্গের পাশে গাড়ি পার্ক করে আমরা ঢুঁকে পড়লাম দুর্গের সীমানার ভেতরে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সেখানে অবস্থান করলাম, চলল আড্ডা, ঘোরাঘুরি আর ফটোসেশন। তবে এই পুরাকীর্তির রক্ষণাবেক্ষণের নামে যে নির্মাণ কাজ চলছে তা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। প্রত্যেকটা পুরাকীর্তির বিকৃতরূপ প্রদান না করে কি এগুলো সংরক্ষণ করা যায় না?



ইদ্রাকপুর থেকে গেলাম ‘অতীশ দীপঙ্কর ভিটা’ দেখতে। মুন্সীগঞ্জ জেলার তথা বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে একটি মাত্র ভিটা রয়েছে যা ‘পণ্ডিতের ভিটা’ নামে সবার কাছে সুপরিচিত। এই পণ্ডিতের ভিটায় গেলে শ্রীজ্ঞান অতিশ দীপঙ্করের স্মৃতিস্তম্ভ চোখে পড়বে। এ স্তম্ভের দিকে তাকালে গর্বে বুক ভরে যায়। ২০০৪ সালে চীনের আর্থিক সহযোগিতায় তিব্বতীয় মডেল অনুকরণে এ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছে। অতীশ দীপঙ্কর ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার তথা বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্মৃতিকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য বজ্রযোগিনী গ্রামে স্থাপিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।



দীপঙ্করের বাবা ছিলেন তৎকালীন রাজা কল্যাণশ্রী ও তার মায়ের নাম ছিল প্রভাবতী। দীপঙ্কর প্রায় ১২ বছর তিব্বতে বাস করে তিব্বতের বিভিন্ন প্রদেশ পরিদর্শন করে বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতা ও প্রকৃতি ধর্মতত্ত্ব জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে দীপঙ্কর সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একজন পণ্ডিত হন। বিদ্যা শিক্ষার জন্য দীপঙ্কর সুবর্ণদ্বীপ পর্যন্ত যান। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি বিক্রমশীলা বিহারের অধ্যক্ষ হন। দীপঙ্কর বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন এবং তিনি ১০০টি ধর্ম সম্পর্কিত উপদেশ দিয়েছেন। তার লিখিত কয়েকটি পুস্তকের নাম হচ্ছে বোধিপথ-প্রদীপ, চর্যা সংগ্রহণ প্রদীপ, মধ্যমোপদেশ, সংগ্রহ গর্ভ, বর্ণ বিভঙ্গ, পুরুক্রিয়ক্রম ইত্যাদি। দীপঙ্কর উপদেশপূর্ণ যে পত্র লেখেন তা বিমল রত্ন নামে পরিচিত।




এখানে গিয়ে দেখলাম একটি কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, তেমন বিশেষ কিছু পেলাম না। পথিমধ্যে আমরা দেখতে গেলাম অধুনা আবিষ্কৃত বিক্রমপুর বিহার। এখানেও একই অবস্থা। নির্মাণ কাজ চলছে, অদক্ষ কারিগর, নতুন সিরামিক ইট আর অপরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ। এগুলো দেখার কেউ নেই?



দুপুর হয়ে যাওয়ায় আমরা বজ্রযোগিনী গ্রামের মসজিদে জুম্মা নামাজ আদায় করে রওনা হলাম মুন্সিগঞ্জের অপর প্রান্ত শ্রীনগরের দিকে। পথে কোর্ট এলাকায় নব্য চালু হওয়া ‘সবুজ ছায়া’ নামক রেস্টুরেন্টে। খুবই সুস্বাদু এবং মজাদার রান্না। বিশেষ করে টাটকা কালাবাউশ মাছের স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে। মুন্সীগঞ্জ গেলে পরে আপনি এই রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেখতে পারেন, আশাহত হবেন না। যাই হোক লাঞ্চ শেষে আমরা গেলাম ‘স্যার জেসি বোস কমপ্লেক্স’ পরিদর্শনে।



বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের রাঢ়ীখাল গ্রামে। আচার্য বসুর পৈতৃক বাড়ির নৈসর্গিক পরিবেশে প্রায় পাঁচ একক জমির ওপর গড়ে উঠেছে স্যার জেসি বোস কমপ্লেক্স। এখানে আছে বিজ্ঞানীর ছবি সংবলিত সুদৃশ্য গেট, কাঁটাতারের বেষ্টনী, সুদৃশ্য কাঠের ঘর, রান্নাঘর, কাঠের ব্রিজ, ছাতা, দোলনা, বসার বেঞ্চ, দুটি বিশাল পুকুরে শান বাঁধানো বড় বড় ঘাট, প্যাডেলচালিত নৌকা, বিশ্রাম কক্ষ ইত্যাদি। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈতৃক বাড়ির ছয় কক্ষবিশিষ্ট এক তলা ভবনের একটি কক্ষ সংস্কার করে মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি কক্ষই অকেজো হয়ে গেছে। এখানে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ২০ টাকা মূল্যের টিকেট কাটতে হবে আপনাকে। এখানে চমৎকার কিছু সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম ভাগ্যকুলের উদ্দেশ্যে।



ভাগ্যকুল পৌঁছতে পৌঁছতে শেষ বিকেল হয়ে গেল। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বিবেচনায় রেখে ভাগ্যকুলের ঐতিহাসিক ‘জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ি’ পরিদর্শনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সবাই চলে গেলাম নদী’র পাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে আমরা রওনা হলাম ঢাকার ফিরতি পথে। আসছে শরতে আবার যাবো কাশফুলের মাঝে ডুব দিতে আর সাথে দেখতে উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ শ্যামসিদ্ধির মঠ, বাবা আদম (স.)-এর মসজিদ, ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি প্রভৃতি দেখতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১:৪৫
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×