"রমজান" শব্দটি আসলেই "ইফতার" প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় চলে আসে। আর ইফতার মানেই আলুচপ, পেয়াজু, বেগুনি, ছোলা বুট, ঘুঘনি, মুড়ি, হালিম, জিলাপী, নানান রকমের শরবত হয়ে কাবাব, বিরিয়ানি সহ আরও হাজারো পদের নাম চলে আসে। কিন্তু এগুলো কিভাবে ইফতারে যুক্ত হল? কখনো ভেবে দেখেছেন কি? আজকের লেখায় খুঁজে দেখবো এরা কিভাবে এলো আপনার আমার ইফতারের পাতে...
প্রাসঙ্গিক না হলেও একটা কথা না বললেই নয়, রমজান আসলেই ইফতার এর আলোচনা চলে আসে, আর ইফতারের কথা আসলেই অতি অবশ্যই চলে আসে পুরাতন ঢাকার চকবাজারের ইফতার বাজার এর কথা। গতকালকের নিউজ অনুসারে এবার বসছে না চকবাজারের ঐতিহ্যবাহি ইফতার বাজার। না বসাটাই ভালো, কেননা সেই গুণগত মানের ইফতার চকবাজার থেকে দুই যুগ আগেই হাওয়ায় মিলিয়েছে।
তো আসুন শুরু করা যাক আমাদের আজকের ইফতারের ইতিহাসের শেকড়ের সন্ধান। শুরুতে একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের ইফতারীতে যে খাদ্যগুলো থাকে তাদের আমরা পাঁচটি মূল শাখায় ভাগ করে নিতে পারিঃ
(১) পানীয়ঃ নানান শরবত, মাঠা, লাবান, লাচ্ছি, কোমল পানীয়, ফলের জুস ইত্যাদি।
(২) ফলমূলঃ খেজুর, পেঁপে, কলা সহ অন্যান্য দেশীয় মৌসুমী ফল এবং আপেল, মাল্টা, আঙ্গুর, বেদানা জাতীয় বিদেশী ফল।
(৩) ভাঁজাপোড়াঃ আলুচপ, পেয়াজু, বেগুনী, পাকোড়া, সিঙ্গারা, সমুচা সহ আরও অনেক ধরনের তেলে ভাঁজা পদ।
(৪) মিষ্টান্নঃ জিলাপী একচ্ছত্র, এর বাইরে অন্য মিষ্টান্ন খুব কম দেখা যায়, ফালুদা অনেকে ইফতারে পছন্দ করেন, অনেকে পায়েশ, ফিরনি, সেমাই বিশেষ করে লাচ্ছা সেমাই খেতে পছন্দ করেন।
(৫) মূল পদ যা ভারী ধরনের হয়ঃ বেশীরভাগ মুড়ি মাখানো - পুরাতন ঢাকায় যাকে বলা হয় মুড়ি ভর্তা; চিড়া দই, গুড় বা ফলমূল সহযোগে, বিরিয়ানি, ভাত ইত্যাদি।
এই উপরের পাঁচ শাখার যে খাবারগুলো রমজানে ইফতারে বাধ্যতামূলকভাবে খাওয়া হয়, তা কিন্তু সারা বছরের খাদ্যাভাসে থাকে না। কিন্তু কেন জানি রমজান এলেই এগুলোর উপর হামলে পড়ে সবাই। যেমন মিষ্টি খাবার কথা উঠলে সারা বছরে কেউ জিলাপী'র নাম মুখে আনে না, কিন্তু ইফতারে একমাত্র পদ হলেও জিলাপী থাকতেই হবে। ফলের ক্ষেত্রে সুন্নত হিসেবে খেজুর ইফতারের পাতে সবাই চায়, কিন্তু সারা বছর এই অতি পুষ্টিকর ফলটি কয়জনের পছন্দের ফলের তালিকায় থাকে? সারা বছরে মাসে দু'মাসে একদিন মুড়ি মাখা খাওয়া হলেও, রমজানে সারাদিন উপোস থাকার পর এই খাবার না হলে যেন উদরপূর্তি সম্পন্ন হয় না অনেকের। আলুচপ, পেয়াজু ছাড়া ইফতার এর কথা ঢাকাবাসী রমণীকূল ভাবতেই পারেন না। কিন্তু সারা বছর এই দুটি পদের দেখা মেলে না কোন হেঁশেলে বা ডাইনিং টেবিলের ডিশগুলোর মাঝে।
কিন্তু আমার কথা হলো এগুলো এলো কিভাবে আমাদের দেশের ইফতারের পাতে। তার আগে বলে রাখি ইদানীং এসব বিষয় নিয়ে সবাই যা মন চায় লিখে দিচ্ছে। গতকাল একটা লেখা চোখে পড়লো, ইফতারে এসব ভাঁজা পোড়া খাবারেরে ইতিহাস নাকি মাত্র ত্রিশ বছরের... আমি চ্যালেঞ্জ করে শত বছরের ধারা এটা প্রমাণ সহ দিতে পারি। তাই যে কোন কিছু লেখা বা বলার আগে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত হাতে থাকাটা জরুরী। আসলে পুরাতন ঢাকার ইফতারের ইতিহাস কম করে হলেও পাঁচশত বছরের, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আট বছর আগে সামু ব্লগেই লিখেছিলাম একটা লেখাঃ পুরাতন ঢাকার ইফতারের ইতিবৃত্ত; পড়ে দেখতে পারেন।
আমাদের উপমহাদেশীয় অনেক আচার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে জীবনযাত্রা মুঘলদের দ্বারা প্রভাবিত; তার মধ্যে খাদ্যাভ্যাস সবচাইতে বেশী। পনেরো শতকের শুরু হতে মোঘল শাসন এই উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করার সাথে সাথে মোঘলদের হেঁশেল হতে নানান খানাখাদ্যের রেসিপি চলে আসে বিদ্যমান সমাজের সাধারণ মানুষের ঘরেও। মোঘলদের বিলাসী জীবন যাপনের জন্য সাথে করে বয়ে আনা কর্মচারী-খানসামা-বাবুর্চি একসময় যথেষ্ট হয়ে উঠে না, ফলে আশেপাশের লোকালয় হতে বহু লোকের চাকুরী জোটে মোঘল পরিবারসমূহে। অন্যান্য পদের মত হেঁসেলেও স্থান হয় কতিপয় রন্ধন কারিগরের। আর তাদের হাত ধরেই মোঘল খাবার প্রাসাদের বাইরে বিস্তৃতি পায় এবং একসময় দিল্লী, লখনউ হয়ে বাংলায় এসেছিলো অনেক খাবার। যেমন চকবাজারের আলাউদ্দিন হালুয়াই খাবারের দোকান খুলেছিলেন লক্ষ্ণৌ থেকে এসে, সাথে নিয়ে এসেছিলেন নিমক পারা, সমুচা এবং লক্ষ্ণৌ শিরমাল নামক খাদ্য। যার মধ্যে প্রথম দুটি এখনও পুরাতন ঢাকার ইফতারে অন্যতম পদ বলে বিবেচিত হয়।
একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন ইফতারের মূল পদগুলো নানান দেশ বা অঞ্চল এর খাবার যা আমাদের খাবারে একান্ত নিজস্ব পদ হিসেবে মিশে গেছে। খেজুর মধ্যপ্রাচ্যের ফল, সুন্নত হিসেবে তা মুসলিম আচার রমজানের ইফতারে চলে এসেছে। ছোলা মূলত আফগানদের প্রিয় খাবার, আফগানদের হাত ধরেই এর প্রবেশ হয়েছে উপমহাদেশে। ইফতারে নানান সুগন্ধীযুক্ত এবং স্বাদের শরবতের আগমন মধ্যপ্রাচ্য হতেই বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। এই বাংলায় ইতিহাস ঘাটলে জলপান এর কথা শোনা যায়, যেখানে পানির সাথে নাড়ু, মন্ডা, কদমা, মোয়া ইত্যাদী দেয়া হতো, কিন্তু শরবতের কথা বাঙ্গালী ইতিহাসে কোথাও পাওয়া যায় না। উত্তর ভারত থেকে এসেছে আলুচপ, বেগুনি, পেঁয়াজু এগুলোর চল। মাস ছয়েক আগে লম্বা একটা ভ্রমণ করে এলাম রাজাস্থান, সেখানে সকালের নাস্তায় ডুবা তেলে ভাঁজা পাকোরা, চপ এগুলো খাওয়া হয়। সেখানে এগুলো এলো কিভাবে? ধারণা করা হয়, মোঘলদের হেঁশেলের রেসিপি বাইরে এসে বিবর্তিত হয়েছে সামাজিক এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতায়; যেমন কাবাবের বিকল্পে চপ, মাংসের জায়গায় আলু, বেগুন, কুমড়া, পেঁপে, পেয়াজ এর মত সহজ এবং সস্তা সব্জী দিয়ে একই রেসিপির খাবার তৈরী হয়েছে।
তাই একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যায়, ভারতবর্ষে আরব, পার্সিয়ান, আফগান ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির শাসকদের কারণে স্থানীয় খাবারের সাথে তাদের খাবারের রীতি মিশে যায়; যা একটা দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ঘটেছে। যেমন ইফতারে হালিম, বিরিয়ানি, কাবাব এগুলো পার্সিয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যের খাবার। মোঘলদের সাথে সাথে পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব দেশগুলো হতে বহু মানুষের পদধূলি পড়েছিল এই উপমহাদেশে, সাথে এসেছিলো তাদের নানান খাবারের রেসিপিও। যেমন মধ্যপ্রাচ্যে ইফতারির সময় কাবাব সহযোগে বিরিয়ানি বা পোলাও খাওয়ার চল রয়েছে। সেটার অনুকরণেই আমাদের এখানে মুড়ির সাথে ছোলা, চপ, পেঁয়াজু, বেগুনী খাবার রীতি শুরু হয়েছে বলে বেশীরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন। এই অঞ্চলে মুড়ি এবং মুড়িজাত নানান পদ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত খাবার ছিলো বাঙ্গালীর ইতিহাসে। সেই মুড়ি আর উত্তর ভারতীয় ভাঁজাপোড়া মিলেমিশে একাকার হয়েছে আমাদের আজকের ইফতার এর মাঝে, 'মুড়ি মাখানো' বা 'মুড়ি ভর্তা' নামে।
আমাদের দেশে সুগন্ধিযুক্ত হার্বস তেমন না থাকায় লেবু, পুদিনাপাতা আর ধনেপাতার উপস্থিতি সবসময় রমজানে দেখতে পাবেন। লেখক ও গবেষক হাকিম হাবিবুর রহমান তার বইয়ে লিখেছিলেন, "যে মৌসুমেই রমজান হোক না কেন, ঢাকায় পুদিনাপাতা, ক্ষিরা আর ধনেপাতা পাওয়া যাবেই। আর পাওয়া যেত আখ। গোলাপ বা কেওড়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে সুবাসিত করা হতো এগুলো।" কারণ কি? কারণ পার্সিয় আর মধ্যপ্রাচ্যে সুগন্ধিযুক্ত নানান স্বাদের পানীয় ইফতারে দেখা যায়, যেখানে নানান সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই বাঙ্গাল দেশে সেটার ঘাটতি পুদিনা পাতা, লেবু আর গোলাপজলে হয়ে গিয়েছিলো।
তাই সব একত্রিত করলে যা দ্বারায় এই উপমহাদেশে শাসন করতে বা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসা মোঘল, পার্সিয়ান, আরব্য জাতীগোষ্ঠীর মুসলিম মানুষদের থেকে তাদের ইফতারের নানান অনুষঙ্গ ঢুকেছে আমাদের ইফতারে। লক্ষণীয় পর্তুগীজ, ব্রিটিশ, ডাচ, ওলন্দাজ সহ অন্যান্য অমুসলিম জনপদের লোকেরা বহু বছর উপমহাদেশে শাসন করলেও তাদের খাবারের পদ ইফতারে জায়গা করে নেয় নাই, এর পেছনে ধর্মীয় কারনটাই মূখ্য। তাই মুসলমান ভিনদেশীদের কাছ থেকে কিছু পদ সরাসরি ইফতারের পাতে যুক্ত হয়েছে, মূলত সেই সকল পদ যা আমাদের এখানে ছিলো সহজলভ্য, আর কিছু পদ আংশিক বা বহুলাংশে বিবর্তিত হয়ে ঠাই পেয়েছে ইফতারীর খাবারের তালিকায়। আর কিছু পদ নতুন যুক্ত হয়েছে মূল পদের ছায়া অনুসরণ এবং অনুকরণ করে।
রমযান এবং ইফতার নিয়ে আমার সকল লেখাঃ
পুরাতন ঢাকার ইফতারের ইতিবৃত্ত
চকবাজারের ইফতার, ঐতিহ্য-বাস্তবতা-অপপ্রচার এবং কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা।
'পঞ্চ ইন্দ্রিয়’র সংযমে ‘ষড়রিপু’র দমন – মাহে রমজানের শিক্ষা এবং বাস্তবতা
আমাদের আজকের ইফতারের ইতিহাসের শেকড়ের সন্ধান
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৩ রাত ২:০০