somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চকবাজারের ইফতার, ঐতিহ্য-বাস্তবতা-অপপ্রচার এবং কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা।

০১ লা জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“বড় বাপের পোলায় খায়
ঠোঙ্গায় ভইরা লিয়া যায়”
এযে ডাহা মিছা হায়
এই জিনিষ মাইনসে খায়?

কি একটু অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রতি বছর রমজান এলেই প্রথম রমজান এবং দ্বিতীয় রমজান এ থাকবে চকবাজারের ইফতার নিয়ে প্রতিটি নিউজ মিডিয়ায় ফ্রন্ট পেইজ কাভার ফটো উইথ নিউজ। আর চকবাজারের ইফতার বলতে গত কয়েক বছর জুড়ে প্রাধান্য পাচ্ছে এই উদ্ভট খাবার ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। কিন্তু আসলে চকবাজারের ইফতার বাজারের ঐতিহ্য কি এবং বর্তমান বাস্তবতা কি?

আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পুরাতন ঢাকার চকবাজার এলাকার পাশের এলাকায়। ফলে ছোট বেলা থেকে চকবাজারের ইফতার বাজার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম। আর মাতুতালয়ের কল্যাণে চকবাজারের দুটো বিখ্যাত খাদ্য বিক্রেতা তথা দোকান ছিল খুবই নিকট আত্মীয়ের, তাই কমবেশী কিছু ব্যাপার জানি এবং নিজ চোখে দেখেছি। আমি যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, প্রায় এক যুগ আগের ঘটনা, তখন রমজানে ফ্রি টাইম থাকায় আমার এক আত্মীয়, যার চকবাজারের ইফতার বাজারে ইফতারি বিক্রির একটা দোকান ছিল, আমাকে বিকেল বেলা তার দোকানে তাকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। আমি সানন্দে রাজী হই এবং নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করি কীভাবে ইতিহাস আর ঐতিহ্য হারিয়ে যায়।

আমার ঐ আত্মীয়ের দোকানটি ছিল তার বাবা’র। স্বাধীনতার পর থেকে ঐ জায়গায় প্রতি বছর তার বাবা ইফতারির দোকান দিতেন রমজান এলে। বাবা মারা গেলে ছেলেরা সেই ধারা অব্যাহত রাখেন। রাস্তার উপরে বসা সেই দোকানের কর্মযজ্ঞ নিজ চোখে না দেখলে বুঝানো যাবে না। তাদের বেশীরভাগ আইটেম এর মূল যোগাড়-যন্ত্র হত নিজ বাসায়, প্রতিদিন শুধু আলু ব্যাবহার হত দুই মন! বিশাল সেই বাজার যতদিন তারা নিজেরা করেছে ততদিন সবঠিক ছিল, যখন থেকে সাব কন্ট্রাক্ট এ বাজার কেনা শুরু করলেন তখন থেকে কোয়ালিটি মেইনটেইন করা হয়ে পরে দুস্কর।

তাদের কোয়ালিটি নিয়ে দুটো কথা বলি। আমি প্রথম রোজায় তাদের দোকানে গেলাম, প্রথম অভিজ্ঞতা, এতো এতো মানুষের ভিড়ে প্রথম দোকানি সেজে দাঁড়ানো। তাই একটু নার্ভাস ছিলাম, আমার হাত লেগে কিছু খাবার আইটেম রাস্তার পিচে পরে যায়, যা ছিল দোকানের ভেতরের দিকে। আমি সেগুলো তুলে দেখি কোন ময়লা তাতে তেমন নেই, দু একটিতে একটু ধুলো লেগেছে। দোকান শুরুতেই ভালো করে রাস্তার যে অংশে দোকান বসে তা পরিস্কার করে নেয়া হয়, ফলে কোন ময়লা দোকানের ভেতরের রাস্তায় থাকে না। কিন্তু আমি ওগুলো তুলে সেখানে রাখতে গেলে উনি আমাকে বাঁধা দিয়ে একটা ঝুড়ি দেখিয়ে দেন, বলেন ওখানে রাখো। আমি অবাক হলাম, কেন? উনি উত্তরে যা বললেন তার সারমর্ম হল তার বাবা তাদের শিখিয়ে গেছেন... তুমি সেই জিনিষই বিক্রি করবে যা তুমি নিজে এবং তোমার পরিবার খেতে পারবে।

আরেকটা ঘটনা বলি, তাদের দোকানের সিঙ্গারা আর সমুচা ছিল খুব বিখ্যাত। সিঙ্গারা মুখে দিলে গলে যেত, এতই সফট এন্ড টেস্টি ছিল যে তা না চাখলে বোঝানো যাবে না। আর সমুচা! মাংস’র দাম বেড়ে যাওয়ায় সমুচা বিক্রি বন্ধ করে দেন, কারণ? কিমার (মাংসের কিমা) সমুচা বলে অন্য কিছু বিক্রি করতে পারবে না তারা। আমি বললাম দাম বাড়ান তাহলে...। উনি হেসে দিলেন, বললেন তুমি নিজে কয়েকদিন থাকলেই বুঝতে পারবে। বুঝতে পেরেছিলাম। ভুঁইফোঁড় সব অতিথি খাদ্য বিক্রেতারা কীভাবে চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সুনাম ধুলোয় মিটিয়ে দিচ্ছিল তা নিজ চোখে দেখেছি। ঢাকা শহরের পাড়া গলির খাবার হোটেলের আলুচপ, পেয়াজু, বেগুনীও সেগুলোর থেকে অনেক ভালো। আমার ঐ আত্মীয় চকবাজারের ইফতারর বাজারে শেষ তার দোকান দিয়েছেন প্রায় দশ বছরে আগে।

এখন আসি মূল কথায়। আপনি যদি চকবাজারে যান ইফতারি কিনতে তো কি করবেন? আপনি অবশ্যই বোম্বে কনফেকশনারি, আনন্দ কনফেকশনারি, আমানিয়া হোটেল ইত্যাদির মত ঐতিহ্যবাহী দোকান থেকে ইফতার কিনবেন। কোন রাস্তার উপর বসা দোকান থেকে নয়। না হলে আপনি ঠকবেন। আর ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ যদি কেউ খেতে চান, খেয়ে দেখেন, একবার খেলে আর দ্বিতীয়বার খাবেন না। এই খাবারের কথা ইতিহাসে কোথাও পাবেন না। হাকিম হাবিবুর রহমান বা এরকম কোন ইতিহাসবেত্তার লিখনিতো বাদ দিলাম, পুরাতন ঢাকার অরিজিনাল আদি বাসিন্দা যারা চকবাজারের ইফতার সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, তারা কেউ এই খাবারের কথা বলবে না আপনাকে। এই খাবারের ইতিহাস হল, একজন মুড়ি ভর্তা (পুরাতন ঢাকায় মুড়ি মাখানোকে মুড়ি ভর্তা বলে) বিক্রেতার উর্বর মস্তিস্কের ফসল এই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ খাবারটি।

আপনি চক বাজার গেলে কাবাব কিনবেন, নামেই সেগুলো কাবাব। রেশমি কাবাব, সুতি কাবাব, জালী কাবাবা, বটি কাবাব ইত্যাদি নামের কাবাবগুলো আসলে কোন কাবাবের কোয়ালিটিতে পরে না। আপনি একান্তই যদি কিনতে চান, তবে আনন্দ বেকারি যা চকবাজার মসজিদের নীচে অবস্থিত সেখানে ঢুকে পড়েন। চকবাজারে জিলাপি কিনবেন বোম্বে কনফেকশনারি থেকে, আর না হয় চকবাজার শাহী মসজিদের পেছনে ‘চুড়িহাট্টা’ নামের যে গলি আছে সেখানকার ‘নিয়াজের জিলাপি’ থেকে। ভুলেও রাস্তার উপরের ‘দই বড়া’ কিনবেন না, না হলে বাসায় গিয়ে নিজেকে গালি দিবেন, আর গালি দিবেন পুরাতন ঢাকার খাবার দাবার’কে।

দোষ কি আসলে পুরাতন ঢাকার খাবারের? আপনি নান্না আর হাজীর বিরিয়ানি নাম শুনলেই ঢুকে পড়ছেন লোভনীয় কোন খাবারের আশায়। নান্না বিরিয়ানি নামে এখন যে বিরিয়ানি বিক্রি হয় তার যাত্রা ২০০০ সালের দিকে লালবাগ চৌরাস্তায়, অরিজিনাল নান্না মিয়া’র আত্মীয়র দ্বারা। তখনো বেচারাম দেউড়ীর অরিজিনাল নান্না’র মোরগ পোলাও টিকে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নান্না মিয়ার ছেলেদের কোন্দল এবং আর্থিক ঋণের কারণে তাদের ব্যাবসা গুটিয়ে নেয় এবং এই নতুন নান্না তা কিনে নেয়। যদিও এই নতুন নান্না মিয়ার বিরিয়ানি’র মানও খুব ভালো। কিন্তু তা সব শাখায় পাওয়া যায় না, আসল স্বাদ পেতে হলে আপানাকে লালবাগ চৌরাস্তার নান্না বিরিয়ানি’র মূল দোকানে আসতে হবে।

আচ্ছা আপনি কি ‘পালোয়ানের পোলাও’ এর নাম শুনেছেন? অথবা চকবাজারের ‘শাহ্‌ সাহেব এর খাসির বিরিয়ানি’র নাম? আপনি অধুনা প্রতিষ্ঠিত রয়েল, আফতাব, মামুন, শমসের এদের খাবার খেয়ে পুরাতন ঢাকার সেই ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ খুঁজতে যাবেন না যেন। পুরাতন ঢাকায় দোকান দিলেই তা পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার হয়ে যায় না। এই সব কয়টি দোকান আমার চোখের সামনে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েল সবচেয়ে নাম করেছে, বিশেষ করে রয়েলের বাদামের শরবত। কিন্তু ১৯৯৮ এর দিকে যখন এরা যাত্রা শুরু করে সে সময়কার বাদামের শরবতের কাছে এখনকারটা নস্যি।

তাই শেষ কথা যেটা বলতে চাই, পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার নামে যে সব অখাদ্য এবং কুখাদ্য এখন চকবাজারে বিক্রি হচ্ছে তা নিয়ে হাইলাইট করে ইতিহাসকে নষ্ট করবেন না। পুরাতন ঢাকার খাবার সম্পর্কে জানতে হাকিম হাবিবুর রহমান সহ অনেক ইতিহাসবেত্তার বই পড়ে দেখেন, কিন জৌলুশ আর জাঁকজমকপূর্ণ ছিল সেই খাবারের আয়োজনগুলো। ঢাকার রমজান ও ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল খাবার। রোজায় ঘরে অনেক রকম ইফতারি থাকলেও সবাই একবার চকে ছুটে যেতেন। চক সেই মুঘল আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য, খাবার-দাবার আড্ডার কেন্দ্র। চকের ইফতারির কিছু বিবরণ রেখে গেছেন আবু যোহা নূর আহমেদ। খাবারগুলো ছিল_শিরমলি, বাকেরখানি চাপাতি, নান রুটি, কাকচা, কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হান্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামী ও টিকা কাবাব, পরাটা, বোগদাদী রুটি, শবরাতি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবত ও নানারকম ফল।

একদিন চকবাজার গিয়ে খুঁজে দেখতে পারেন এই হারিয়ে যাওয়া খাবারের ইতিহাসকে, কোথাও খুঁজে পেলে জানাবেন প্লিজ। নামে পেলে চলবে না কিন্তু, স্বাদেও পেতে হবে।
৪৯টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×