পড়ার আগে অবশ্যই মিসির আলী আনসল্ভড এর "সোনার মাছি" পড়া থাকতে হবে। নাহয় পুরো ঘটনা মাথার এন্টেনার উপর দিয়ে যাবে।
১
একটা কুঁচকে যাওয়া ফতুয়া আর মলিন প্যান্ট পড়ে হাঁটছেন মিসির আলী। আজ সূর্যের তেজটা অসহ্য লাগছে, কার্ত্তিক মাসের শেষেও শীতের দেখা নেই। ঘামে পিঠ ভিজে গিয়েছে। এর মধ্যে বেরসিক জ্বর আর মাথা ব্যথা যথেষ্ট যন্ত্রনা দিচ্ছে। মিসির আলী কিছুতেই বের হতেন না আজ, কিন্তু বদিটা গতকাল রাত ১২টায় বাসায় যেয়ে উপস্থিত। সে কিছুতেই মিসির আলীকে ছাড়া নুহাশ পল্লীতে যাবে না। বাকের ভাইয়ের কঠিন নির্দেশ আছে। এই নির্দেশ বদি ফেলতে পারেনা, অসম্ভব! দরকার হলে সরকারী এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসবে। এ্যাম্বুলেন্স ওয়ালা আসতে রাজি না হলে, থাবড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবে একেবারে।
বদির একটানা ঘ্যানঘ্যান শোনার চেয়ে নুহাশ পল্লীতে হাজির হয়ে যাওয়াই ভাল। সেখনে যেয়ে বজরার ভেতরে ঢুকে নিরিবিলি একটা ঘুম দেয়া যাবে। বদি শুধু বলেছিল বাকের ভাই আর সাথে দু একজন থাকবে, কিন্তু এখনে পা দিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন মহা আয়োজন চলছে। ঢুকতেই আনিস টুক করে পা ধরে সালাম করে ফেলল। মিসির আলী জানতে চাইলেনঃ কি খবর আনিস, পামিং কেমন চলছে?
আনিস শুন্য থেকে একটা লাল গোলাপ এনে মিসির আলীর হাতে দিয়ে বললঃ ফাইন চলছে, স্যার! বাকের ভাই মুনা আপা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কোথায় যে গেল, এখানেই তো ছিল একটু আগে।
মিসির আলী ভ্রু কুচকে জানতে চাইলেনঃ অন্যরা কোথায়?
‘এসে পড়বে স্যার, টেনশান নট! স্লামালাইকুম’ বাকের হাসিমুখে জবাব দিল পেছন থেকে। সাথে মুনাও আছে।
‘কেমন আছেন স্যার?’
মিসির আলী মাথা নাড়িয়ে বললেনঃ ভালই আছি।
এর মাঝেই আনিস ব্যস্ত হয়ে বললঃ আজ কিন্তু আমাদেরকে একটা গল্প শোনাতেই হবে স্যার! সবাই এসে যাওয়ার আগেই ছোটখাট একটা বলেই ফেলুন না, বহুদিন আপনার গল্প পড়া হয়না।
বাকের ও যেই মাথা নাড়িয়ে সায় দিতে যাচ্ছিল, মুনা ধমকে উঠলঃ আরে তোমরা কি শুরু করলে, স্যার এসেছেন মাত্র, একটু বিশ্রাম নিক।
মিসির আলী মুচকি হেসে বললেনঃ বদি এককাপ চা খাওয়াও তো, চা খেতে খেতেই গল্প করি। মানব সম্প্রদায়ের গল্প শোনার আগ্রহের চাইতে বলার আগ্রহ কিছুতেই কম না, আমিও অনেক দিন চুপচাপ থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি।
বদি চা আনতে দৌড় দেয়ার আগে বললঃ আমি আসার আগে স্টার্ট দিয়েন না গল্প বলা।
বাকের হাসি হাসি মুখে বললঃ চা খাওয়া ভাল, চায়ে ভাইটামিন আছে। ক্লান্তি দূর হবে।
মুনা চোখ পাকিয়ে তাকাল।
২
চায়ে চুমুক দিয়েই মিসির আলী জানতে চাইলেনঃ তোমাদের মনে আছে সেই সোনার মাছির কেইস টার কথা?
মুনা মাথা নেড়ে বললঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই যে প্রফেসর নেসার আলিংটন, তার স্ত্রী অ্যানি আর সেই এম্বারের অমিমাংসিত রহস্য!
'সেটার সমাধান কি হয়েছে?' আনিস মাঝখান থেকে জিজ্ঞেস করল। ‘কত ভেবেছি এর সমাধান নিয়ে, কিন্তু কোন কূলকিনারা পাইনি’।
মিসির আলী উত্তর না দিয়ে বলতে শুরু করলেনঃ গত বছর নিউইয়র্কে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ছিল, আমাকেও আমন্ত্রন করা হয়েছিল। ভাবলাম ঘুরেই আসি, প্রফেসার আলিংটনের সাথেও দেখা হবে। আর সোনার মাছির ব্যাপারে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে,পারলে সেই রহস্যও ভেদ করা যবে, এম্বারটা কি করে হাডসন নদীর তলা থেকে অ্যানির কাছে ফিরে এল! আমি যাওয়ার আগে ওনার বাসার নাম্বারে কল দিলাম, কল গেল না কোন কারনে। ভাবলাম ঝামেলা করে ইউনিভার্সিটিতে কল দিয়ে লাভ নেই, একেবারে গিয়েই দেখা করব, মানুষকে চমকে দেয়ার মজাই আলাদা। কনফারেন্স শুরুর প্রথম দিকেই আমি বের হয়ে গেলাম হল রুম থেকে, একটানা যান্ত্রিক কথাবার্তা আমাকে মোটেই আকর্ষণ করছিল না।
ওনার বাড়িতে গিয়ে আমি বেশ অবাক, সেখানে বড় একটা তালা ঝুলে আছে। প্রতিবেশীদের একজন জানাল উনি একাকীত্ব জনিত মানুষিক অবসাদে ভুগছিলেন অনেক দিন ধরে, একদিন গভীর রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যান, এরপর আর ফিরে আসেন নি।
আমি হতাশ হয়ে যাই, নিউইয়র্কে আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ওনার সাথে দেখা করা। কনফারেন্সে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। এদিকে দেশে ফেরার টিকিটও আরও সপ্তাহ খানেক পরে। প্রথম দুইদিন হোটেলরুমে বসেই কাটালাম, এরপর মনে হল বসেই যখন আছি। সেই সোনালি মাছির ব্যাপারটা নিয়ে আর একটু ভাবনাচিন্তা করা যাক। আমি কিছু বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়ার চিন্তা করলাম, একদিন ঘুরে এলাম অ্যানি যেই হাসপাতালে মারা গিয়েছিল সেটা। তারপর গেলাম অ্যানিকে যেখানে কবর দেয়া হল সেই গোরস্থানে। খুঁজে খুঁজে বের করলাম অ্যানির কবর। প্রতিদিন আমি কবর স্থানের বাইরে পার্কে বসে থাকতাম। একদিন বেশ রাত হয়ে গেল। দশটা কি এগারোটা হবে, ডাউন স্ট্রিটের ওই দিকে এমনিতেই মানুষ জনের আনাগোনা কম। তক্ষুনি আমার মনে হল এই রহস্য সমাধানের একটাই পথ খোলা আছে, আর সেটা হল অ্যানির কবর খোড়া। কবর স্থানে একটু খুজতেই আমি একটা বেলচা পেয়ে গেলাম। আমার মাথা তখন পরিষ্কার ভাবে কাজ করছিল না, কেমন যেন ঘোরের ভেতর ছিলাম। কবর স্থানের মাটিও নরম ছিল।
প্রায় দেড় ঘণ্টার মত সময় লাগল কফিনে পর্যন্ত খুঁড়তে, যখনই আমি কফিনের ঢাকনা খুলতে যাব। তখন মনে হল, আরে এ কি করছি আমি! বুঝতে পারলাম এই ঘটনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই অবসেসড হয়ে গিয়েছি। উঠে আসব কিনা ভাবছিলাম। শেষ পর্যন্ত ভাবলামঃ এত দূর এসে রহস্য না ভেদ করে চলে যাওয়ার কোন মানেই হয়না।
‘কি দেখেছিলেন ভেতরে? অ্যানির শরীর কি জিন্দা পীরের মত তখনও ফ্রেশ ছিল? নাকি পোকা মাকড়ে ইট করে ফেলেছে?’ বাকের উত্তেজনায় চশমা খুলে ফেলল।
মুনা বিরক্ত হয়ে বললঃ আহ! আপনি চুপ থাকুন তো বাকের ভাই!
বাকের গম্ভীর হয়ে আবার চোখে চশমা দিল, মুনার বকা শুনতে বড়ই ভাল লাগে।
‘কফিনের ভেতর এম্বার বা ওই জাতীয় কিছুই ছিল না, আমি অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেছি’।
‘তাহলে?’ আনিসের চোখে অবিশ্বাস!
‘উত্তরটা বুঝতে পারলাম আমি হোটেলে ফিরে আসার পর। ক্লান্ত ছিলাম খুব, একটু তন্দ্রামত এসেছিল, তখনই সেই দিনের ঘটনাগুলো আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। প্রফেসারের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল উনি তার স্ত্রী অ্যানিকে অতিরিক্ত ভালবাসেন। তার স্ত্রী যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন শেষ অনুরোধ ছিলঃ “কিছুক্ষণের জন্য আমার সোনার মাছিটাকে কি আমার কাছে দেবে?”
যেহেতু আমি কফিনে কিছুই পাইনি তার মানে প্রফেসার আলিংটন অ্যানিকে সেটা দেননি, এবং মৃত্যুর আগে অ্যানির শেষ ইচ্ছেও পুরন হয়নি।
আর হবারও নয়! যেহেতু, এম্বারটা আলিংটন হাডসন নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। তাহলে নিশ্চিত প্রফেসর আমাকে ভুল তথ্য দিয়েছেন এবং তিনি ইচ্ছে করে সেটা দেননি।'
'তাহলে হয়েছিলটা কি?' আনিস অবাক!
'প্রফেসর শুরুতেই এম্বারটাকে পছন্দ করেননি। এবং একরাতে প্রফেসারের “I love you”র জবাবে যখন অ্যানি “I love my golden fly” বলল তখন তিনি উঠেপড়ে লাগলেন এম্বারটাকে কিভাবে সরিয়ে ফেলা যায়, এবং সেটা তিনি করলেনও। কারন অ্যানির যেমন এম্বারটার প্রতি অবসেশান ছিল, তেমনই অ্যানিকে নর্থ আমেরিকার সবথেকে সুন্দরী বলার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, প্রফেসারের নিজ স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা অবসেশানের কাছাকাছি পর্যায়ের ছিল। তাই যখন তিনি তার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছে পুরন করতে বার্থ হলেন, তখন তীব্র মানুষিক যন্ত্রনা থেকে তাকে রেহাই দিতে গিয়ে তার মস্তিস্ক একটা কাল্পনিক ঘটনা তৈরি করল, যেটা আসলে কখনোই ঘটেনি।
এম্বারটা এখনো হাডসনের তলাতেই আছে!
এমনকি আমার এটাও মনে হয়না, হাসপাতাল থেকে যখন জরুরী কল এল, “অ্যানির অবস্থা ভাল না, তুমি চলে এস” অ্যানি তখন জীবিত ছিল।
বদির চোখ গোলগোল আর মুখ হা হয়ে গেল। আনিস আর মুনা নিশ্চুপ।
শুধু বাকের বলে উঠলঃ 'পাগলের ডাক্তার নিজেই পাগল হয়ে গেল, বিষয়টা ভেরী স্যাড! বড়ই দুঃখজনক!'
মুনা ভাবল মিসির আলী বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি স্বভাব বিরুদ্ধ, হো হো করে হেসে উঠলেন।
ওইদিকে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে, আর কেউ কি এসেছে?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:৪৯