আমি সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম, ভয়ে আমার হৃদপিন্ড কাঁপছিল, পানি পিপাসা পেয়েছিল। আজ আমি ভয় পাচ্ছি ভিন্ন কারণে।
সন ১৯৭৪/৭৫ হবে, তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি।
আমাদের বাসাটা অনেক বড় ছিল, চারিদিকে দেয়াল ছিল। বাড়ির মূল কাঠামো ঘর যার ভিতরে তিনটা শোবার ঘর ছিল। মূল ঘরের সামনে বড় বড় লাল, সাদা গোলাপ ফুলের গাছ ছিল। মূল ঘরের ডান পাশে হলুদ গাঁদা ফুলের গাছে ভর্তি ছিল, বাম পাশে সীম আর লাউয়ের গাছ হতো, পিছনে বড় কাঁঠাল গাছ ছিল। সেখান থেকে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ফুট দূরে রান্নাঘর, তার পাশে কুয়া আর পানির কল ছিল, তার পাশে ছিল গোসলখানা। রান্নাঘর থেকে আরো ত্রিশ চল্লিশ ফুট দূরে ছিল শৌচাগার। দুই দেয়ালের দূরত্ব সম্ভবত দেড়শ-দুইশো ফুট হবে। রান্নাঘরের পিছনের দেয়ালে একটা দরজা ছিল, সেই দরজা খুললে কিছুদূর ঢাল বেয়ে বড় পুকুর ছিল যা কিনা সারাবছর কচুরিপানায় ঢাকা থাকতো, সেই পুকুরটা এল(L)এর মত বাড়ির দুপাশের সীমানা ঘিরে ছিল। আমাদের বাসায় এক কাজের মহিলা থাকতেন তিনি রাতে শোবার আগে সেই দরজা বন্ধ করে ঘুমাতেন, সেই দিনগুলোতে রাত দশটার মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। এক রাতে ঘুমাবার আয়োজন করছি এমন সময় হৈচৈ আওয়াজ “আম্মা গো মরলাম গো, পানি দেন পানি, দরজার পিছনে ভুত, পানি দেন পানি,” একই কথা বারবার উচ্চারণ। দেখি কাজের মহিলা মূল ঘরের সিঁড়িতে পড়ে আছে, কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছিল, সেই কয়লা লালা মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাঁকে পানি দেয়া হলো এবং আম্মা তাঁর বুকে কিছু সূরা/দোআ পড়ে কয়েকবার ফুঁ দিলেন। সে শান্ত হলো এবং তাঁকে সবাই মিলে শোবার ঘরে দিয়ে আসা হলো।
রাতে ঘুমানোর আগে শৌচাগারে যেতাম এবং স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে ফিরে এসে ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে ফিরার সময় কাপড় টাঙোনোর দড়িতে হাত দিতে দিতে হেঁটে ফিরে আসতাম। এ ঘটনার পর আমারও মনে কিছুটা ভয় ঢুকে গেলএবং এর পর থেকে সেখান থেকে বের হয়ে এক দৌড় দিয়ে ঘরে এসে ঘুমাতাম। সেই দৌড় দিতাম দ্রুতগতিতে এবং কোনদিকে তাকাতাম না। মাঝে মাঝে ঝড়বৃষ্টির দিনে একা যাওয়ার সাহস করতাম না, কোন বোনকে পাহাড়ায় দাঁড়িয়ে সেখানে যেতাম। এক রাতে কিছুটা অন্ধকার হয়ত অমাবস্যার রাত হবে, প্রতিরাতের মত শৌচাগার থেকে বেরিয়ে এক দৌড় দিলাম এবং মনে হলে কে যেন টুঁটি চেপে ধরে টান মারছে, আমি উল্টে পড়লাম এবং ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম, ভয়ে আমার হৃদপিন্ড কাঁপছিল, পানি পিপাসা পেয়েছিল। আম্মা আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে এসে সূরা/দোআ পড়ে ফুঁ দিলেন আর আর আমি আস্তে আস্তে নিশ্চিত নিরাপত্তায় ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে যেয়ে দেখলাম কাপড় টাঙোনোর দড়ি কিছুটা নিচু এবং আমার গলা গতরাতে সেখানে আটকেছিল এবং আমি তা ভুত টেনে ধরেছে মনে করেছিলাম।
আম্মা রোজ ফজরের নামাজের পরে সুর করে কোরান শরীফ পড়তেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, মাঝে মাঝে অবসরে নেয়ামুল কোরআন পড়তেন। মোটামুটি প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পড়তেন। আগে সেই সময়ে অনেক বাসাতেই বেগম পত্রিকা রাখা হতো, এখন সেখানে কি জায়গা নিয়েছে জানা নাই। আমি অনেকদিন আম্মার সাথে ঘুমাতাম সেই সময়ে আম্মা আমাকে নেয়ামুল কোরআন থেকে বিভিন্ন দোয়া শোনাতেন। নবী ইউনুস মাছের পেটে থাকা অবস্থায় কি দোআ পড়তেন তা শিখিয়েছিলেন। আম্মার মুখে রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম “সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”, শেক্সপিয়ারের গল্প বলতেন। আম্মা ছিলেন আধুনিক মনের এবং ধার্মিক। আমাদের কখন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য জোর করেননি, আমাদের ভাইবোনেরা কেউ নামাজ, রোজা করেন কেউ করেন না। কিন্ত যে সূরা/দোয়ার ফুঁতে আমি নিরাপত্তা পেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়েছিলাম তা আমার ধর্মীয় অনুভূতি। মায়ের মুখে যে ধর্মীয় গল্প শুনে নীতি নৈতিকতার ভীত তৈরী হয়েছে সেই ধর্ম আমার সংস্কৃতির অংশ, সেই অর্থে মায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসকে চরম শ্রদ্ধা করি, ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রেখে ও তা পালন করেও আধুনিক হওয়া যায়, সেটা আমার মা করে দেখিয়ে গেছেন। যারা ধর্মের কথা বলে অন্য ধর্মের মানুষের গর্দান কাটা জায়েজ বলে প্রচার করে তাঁদেরকে আমি চরম সাম্প্রদায়িক বলি, তাঁদের বক্তব্যের নিন্দা জানাই। আজকে যারা নামাজ, রোজার বিপক্ষে কথা বলছেন, ধর্মের বিপক্ষে জেহাদে নেমেছেন তাঁরাও আমার দৃষ্টিতে চরম সাম্প্রদায়িক, অসহিষ্ণু। তাঁদের সে সম্প্রদায়ে শুধু ধর্মহীন নাস্তিক (ধর্ম সহিষ্ণু নয়, ধর্ম নিরপেক্ষ নয়) বাংলাদেশী থাকবেন। এই চরম সাম্প্রদায়িক দর্শন দেশকে আরো এক ধাপ রাহাজানির দিকেই ঠেলে দিবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ভোর ৫:৪৬