মৌমাছিটি যখন আমার ঘরে আসলো, ঘর আলোকিত হয়ে গেল। চারিদিক থেকে গুনগুন শব্দ ভেসে আসছিল। সারা ঘর গুনগুনানীতে মুখরিত। আমি ঘরের মধ্যে হাঁটাহাটি করছিলাম। ঘুম না আসলে আমাকে হেঁটেহেঁটে ক্লান্ত হতে হয়। তারপর ঘুম আসে। যখন মৌমাছিটি আমার কপালে এসে বসলো এবং কিছুক্ষণ পরে তীক্ষ্ম হুল ফুটিয়ে দিল। কামড়টা কপালের সেই অংশে দিয়েছিল, যেখানে চুল দিয়ে ঢাকা থাকে । আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। হঠাৎ আর মৌমাছিটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে আমার রক্তের মধ্যে একটি শীতলতা অনুভব করছিলাম। সম্ভবত মৌমাছিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। সারা শরীর বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরতে লাগলো। দুই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুপাত হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরপর আমি হাসছিলাম। এই হাসি, এই কান্না। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার ভেতর কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু তা কোথায় হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে- কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মৌমাছিটি মস্তিষ্কে ভেতর ঢুকে আমার সব অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না তো! দুশ্চিান্তাগ্রস্ত হলাম কয়েক সেকেণ্ডর জন্য। দুশ্চিন্তার অপর পিঠে সুখের অনুভতি খেলা করছে। রক্তের ভেতরে তীব্র হাসি পাচ্ছিল। এই বুঝি সেই চরম পুলকের অনুভূতি, যা আমি এতদিন যাবৎ অন্বেষণ করেছি। যেহেতু একটি মুখ খুঁজে বের করার অপেক্ষায় কেটেছে আমার অতীত, সেহেতু এই পরম স্পন্দন অসহনীয় মনে হচ্ছিল।
চেখ বন্ধ করে বা খুলে আমি ইচ্ছামত লাইলীকে দেখতে পাচ্ছি। আমার মস্তিষ্কের ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। লাইলী কি কি চিন্তা করছে তা আমি বুঝতে পারছি। তার অতীত আর ভবিষ্যৎ আমি বুঝতে পারছি। যখনই ওর জীবনের সুখানুভূতিগুলো আমি জানছি, আমি হেসে ফেলছি। যখনই ওর কষ্টগুলো আমি অনুভব করছি, তখন কাঁদছি। যখন বুঝতে পারলাম ওর ভাবনা জুড়ে আমি কখনোই ছিলাম না, তখন নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগলো। লায়লী আসলে ভালবাসে মজনু নামের একজন পুরুষকে। আমি মজনু নই। আমি মিল্টন। আমি কখনো মজনু হতে পারবো না। কান্না পেলেও আমার চেতনা আমাকে হাসতে বলছিল। আমি তখন চেতনার বেদনা অনুভব করলাম।
যেহেতু আমি কালচক্রের ভেতর প্রবেশ করছি, সেহেতু মুহূর্তের মধ্যেই আমি বদলে যাচ্ছি। ইংরেজিতে একেই বুঝি Time Dilution বলা হয়! আমার অনুভূতিগুলো স্তরে স্তরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আমি বিভিন্ন ধরণের সত্ত্বায় পরিণত হচ্ছি।ব্যস্ত রাস্তার সবুজ বাতির মত কখনো মাথা খুলছে কখনো বন্ধ হচ্ছে। আমি ২৩ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছি। হঠাৎ বুকের ভেতর হৃদয়ের অস্তিত্ব অনুভব করছি। কারণ, আমার হৃদয় কাঁসার ঘণ্টার মতো দুলছে। তবে কি এতদিন আমার বুকে নামমাত্র হৃদয় ছিল? খুব আশ্চর্য মনে হলো বেঁচে থাকার এই নতুন অনুভূতিটুকু। পরদিন খুব জ্বর আসলো। জ্বরের ঘোরে আমি লাইলীকে দেখছি আর ভাবছি, এই মেয়েটিকে এত দিন আমি কী উদ্দেশ্যে পূজা করেছি? আমার দীর্ঘ ২৩ বছরের অবাস্তব কল্পনাগুলো ছায়াছবির মতো ভেসে আসছিল। আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি পরম্পরা অনুভব করছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:২৫