
রাত নিঝুম। নিঃশব্দ। গ্রামের শেষ প্রান্তে ভাঙাচোরা একটি বাড়ি। নিরবে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই এক প্রাচীন বটগাছ। হাজার বছরের পুরনো। গাছের শাখাগুলো ঝরে পড়া শতাব্দীর সাক্ষী। অদ্ভুত এক শক্তি নীরবে বয়ে যাচ্ছে গাছের পাতায়।
নীলা গ্রামের মেয়ে। হৃদয় ভেঙে গেছে তার। আজ সে আত্মহত্যা করবে—ফাঁসিতে ঝুলবে। জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা শেষ করবে। বটগাছটাই তাকে ডেকে এনেছে! নীলার কাঁপছে হাত। চোখে জমে আছে অশ্রু।
হঠাৎ, বাতাসে ভেসে এলো ফিসফিস:
“অতৃপ্ত আত্মা কোন শাসন-বারণ মানে না।”
নীলার পা জমে গেল। শব্দটি আসছিল বাড়ির ভেতর থেকে। ভেতরে অন্ধকার। কোথা থেকে যেন আলোর দ্যুতি উড়ে আসে। আবার কোথায় মিলিয়ে যায়। সে ভীত হয়ে এগিয়ে গেল।
চাঁদের আলোয় আবছা দেখা যায় সবকিছু। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ল দেয়ালে আঁচড়—“খোঁজে শত্রুর চোখে লোনা জলের বন্যা।”
মেঝে কেঁপে উঠল। নীলা স্থির হয়ে কান পেতে শোনে। ঘরের প্রতিটি কোণ যেন কাঁপছে।
“আক্রোশে বুকে জাগে বিশাল হতাশার তরু।”
তার মানে, এই বটগাছটাই কি অতৃপ্ত আত্মা? হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি ভেসে এলো। চোখে অগ্নিশিখা। বুকের ঢিবঢিব শব্দ শোনা যায়। নীলার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হলো। ঘাড়ে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। ছায়ামূর্তি কথা বলে চলে।
“বিষাক্ত পতঙ্গ হলো তার হৃদয়ের বুভুক্ষু মরু!”
হাত নয়। একটি বিষাক্ত পতঙ্গ তার শরীর বেয়ে চলতে থাকে। নীলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় পোকাটাকে। চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকারে শুনতে পায় নানান চিৎকার। নীলা কেঁপে উঠে।
“চিৎকার-হৈচৈ করে তার মগজের জাহাজ।”
আত্মাটা ঘুরছে। আক্রমণাত্মক। তীব্র বেদনার্ত আত্মা। যার প্রতিটি শব্দ যেন মস্তিষ্কের আর্তনাদ।
“আত্মহত্যার মহত্ব প্রচার করাই তার কাজ।”
ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে প্রতিধ্বনি আসে। নীলা বুঝতে পারে , এটা কোনো সাধারণ আত্মা নয়—এটি অভিশাপ্ত।
“অসমাপ্ত স্বপ্নেরা জ্বলে শিরা উপ-শিরায়।”
অসমাপ্ত জীবন, অসমাপ্ত কাজ—এগুলোই তাকে বেপরোয়া করেছে, তাই না? নীলা ভাবতে থাকে।
“তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের ছায়া কোথায় ঘুরে বেড়ায়?”
নীলার মনে হলো, আত্মাটা খুব কষ্টে আছে। খুঁজছে তার শান্তি; জীবিত হৃদয়ে তা বোঝা যায় না।
“কত অর্ধসমাপ্ত ঘুম তার সাথে করেছে পরিহাস।”
রাত্রির নিঃশব্দতা মিলে যায় নীলার নিঃশ্বাসের সঙ্গে। বোঝা গেল আত্মাটার প্রতিটি ঘুম অসম্পূর্ণ। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন অস্ফুট আতঙ্ক।
“প্রতিটি দেয়ালে লেখা সে অমচনীয় ইতিহাস।”
মেঝে ও দেয়ালে অতীতের ক্ষত। অতীতের শোক। একটু খুঁজলে বোঝা যায়।
“নিজের পিঠকে সে দিবে চিরকাল অভিশাপ।”
নীলা বুঝতে পারে, আত্মার ব্যথা। যা নিয়ে সে ঘুরছে ছায়ামূর্তি রূপে—নীলার বেঁচে থাকা যেন ধ্বংস করছে তার শান্তিকে। নীলা চিৎকার করে ওঠে।
“কখনো সে হয় কুকুর, কখনোবা সাপ!”
হঠাৎ তার সামনে একটা সাপ এলো, মুহূর্তে উধাও। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটি কুকুর। চোখে অদ্ভুত নীল আভা, লোমে যেন অতৃপ্ত আত্মার তীব্রতা।
নীলা কুকুরটিকে দেখে শান্তি অনুভব করল। বুঝতে পারল—এই আত্মা অভিশাপ ও শোক বহন করছে। কিন্তু কুকুরের বেশে সে নীলাকে সতর্ক করছে। বলছে, আত্মহত্যা করলে তারও একই অবস্থা হবে। বাঁচার প্রেরণা পায় নীলা। সে কুকুরটিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। রাতের শেষ প্রহরে। সেই রাতে নীলা আর আত্মহত্যা করল না। হয়তো আর কখনো আত্মহত্যা করবে না সে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


