এখন রাত। অনেক রাত। সময় জানিনা, জানার প্রয়োজনও নেই। সকল আধুনিক পেশা, আধুনিক ক্ষুধা, আধুনিক ঘরবাড়ী, আধুনিক যানবাহনকে বিদেয় করে দিয়েছি। এমনকি আধুনিক কোন বৈদ্যুতিক আলোরও স্থান নেই এখন।
খোলা জায়গা, আধা জঙ্গল আর আধা বনের শেষে একটুকু খোলা জায়গা। খোলা জায়গার একপাশে বন অথবা জঙ্গল আর একপাশে ধীর স্থির একটি বিল। বিলের মাঝে মাঝে ইতস্তত পানিতে নাচছে চাঁদের আলো। চারিপাশে কোন মানব সৃষ্ট আধুনিক শব্দ নেই। নেই কোন মানবসৃষ্ট আধুনিক সময়ের কোন ভাষা। আদিম যুগে কোন এক একাকী মানব যার আধুনিক সভ্যতার কোন ধারণা ছিল না, তার ভাষা, শব্দ কেমন ছিল? সে কেমন অনুভব করত তার সীমিত ভাষাক্ষমতা নিয়ে? সে কেমন অনুভব করত এই আধুনিক সময়ের সৃষ্ট দর্শনশাস্ত্রের কড়া কড়া শব্দের জঞ্জাল থেকে মুক্ত অবস্থায়?
মাঝে মাঝে কিছু ঝি ঝি পোকা দেখা যাচ্ছে। তাদের আলো অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর আগুনের ফুলকির মত জ্বলছে আর নিভছে। মাটির নিচের কিছু পোকা কড় কড় করে ডেকে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। ওদের কড় কড় শব্দ কানকে রক্ষা করছে তালা লেগে যাবার হাত থেকে। নিঃশব্দ নীরবতায়, যখন কোন শব্দ থাকে না, তখন কানে তালা লেগে যায়।
বিলের পানি স্থির। কোন বাতাস নেই। বাতাস থাকলে পানি দুলত। বিলের ঘোলা পানিতে নাচছে চাঁদের আলো। চাঁদটি পূর্ণিমার চাদ নয়, তবে কাস্তে চাঁদও নয়। এবং চাঁদটি যথেষ্ঠ উজ্জ্বল।
আশে পাশে কোন জনমানুষের বসতি নেই। কোন মানবসৃষ্ট আলো নেই, মানব সৃষ্ট মাঝ ধরার মাচা নেই, নেই কোন মানবসৃষ্ট ধানক্ষেত যা বিলের তুলনামূলক শুকনো অংশে পিচ্ছিল এদেল মাটির আইল উচিয়ে বসে থাকে।
আকাশে তারার পরিমান যথেষ্ঠ না হলেও সন্তোষজনক। সকল তারার মাঝে দুরত্বের সুবিধা নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে জাকিয়ে বসেছে চাঁদখানা। অন্য কোন গ্রহ হতে হয়তো এই চাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি, পৃথিবী হতে কোন সাধারণ কোন তারার উপস্থিতির মতই। একই জিনিস বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন অবস্থানে থাকে, বিভিন্ন গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়। মানুষগুলোও এমন। দরিদ্র পিতার কন্যার কাছে তার দরিদ্র পিতাই গুরুত্বপূর্ণ, দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীর কোন গুরুত্ব তার কাছে নেই। কাছাকাছি অবস্থানের খাতিরে পিতা তার দারিদ্রতা সত্তেও কন্যার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ।
দাড়িয়ে আছি। দাড়িয়ে আছি একা একা। চন্দ্রালোক আমার অস্বচ্ছ দেহ ভেদ করতে অক্ষম। তাই আমার ছাড়া পড়েছে খোলা জায়গায়। আমি ও আমার ছায়া। আমি যা করি আমার ছায়াও তাই করে। যতক্ষন চন্দ্রালোক আছে ততক্ষণ আমার ছায়াও আছে। আমি ইচ্ছেমতন আমার ছায়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। মানুষগুলোও এরকম ছায়ার মতন। যতক্ষণ আপনার বিত্ত বৈভব আছে আপনি আপনার ছায়া সৃষ্টি করতে পারবেন, আপনার একদল অনুগামী সৃষ্টি করবেন। সেই অনুগামীরা তাই করবে আপনি যা তাদের দিয়ে করাতে চাইবেন। এমনকি আপনি যদি মারাও যান, তাহলে একদল এসে আপনার মৃতদেহকে দাড়া করিয়ে দিয়ে আবার ছায়াময় অনুগামী সৃষ্টি করবে। তখন তারা তাদের ইচ্ছেমতন আপনাকে ব্যাবহার করবে। মৃত মানুষের ছায়া জীবিত মানুষের চেয়ে অধিক ক্ষমতাধর। যারা আপনার মৃতদেহ ব্যাবহার করবে তারা চাইলে আপনাকে কোমড় ভেঙ্গেও দাঁড়া করিয়ে রাখতে পারে, যা আপনি জীবিত অবস্থান কখনই পারবেন না। পৃথিবীর সকল প্রভাবশালী রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা দার্শনিক ব্যাক্তিত্যের ক্ষেত্রে এটাই ঘটে আসছে। যতক্ষণ না মৃতব্যাক্তিকে সমাহিত করা হচ্ছে ততক্ষণ এটা ঘটবেই।
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ২:৪৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




