
৭ অক্টোবর, ২০২৫—মহাকাশবিজ্ঞানে এক ঐতিহাসিক তারিখ। মহাকাশে এক রহস্যময় ধূমকেতুর আগমন।
অন্ধকারে যেন অস্পষ্ট এক ঝাপসা দাগ, তবু এর অস্তিত্ব ভীষণ ভাবে সত্য এবং অনস্বীকার্য। বস্তুর ম্লানতা ছিল বিস্ময়কর — মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য যে ক্যামেরাটি দিয়ে ধারণ করার জন্য তৈরি, তার তুলনায় এটি ১০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ গুণ পর্যন্ত ম্লান। তবু তথ্য সমূহ যথেষ্ট ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু বৈশিষ্ট্যে অস্বাভাবিক।
গোলকটির আভা শুধু ম্লানই নয়, অপটিক্যাল দিক থেকেও অদ্ভুত। এর থেকে আলোক তরঙ্গ এমন এক বিন্যাসে বেরোচ্ছে, যা ধূমকেতুর ধূলিকণার প্রচলিত সব মডেলকেই নাকচ করে দিচ্ছে। তাহলে কি ধূমকেতু নয়?
এর নাম দেয়া হয়েছে 3iAtlas.
এর অর্থ কী?
3rd interstellar object যা Asteroid Terrestrial-impact Last Alert System (ATLAS) survey telescope দ্বারা সনাক্ত করা হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে এটি এমন এক ধূমকেতু জাতীয় মহাজাগতীয় বস্তু যা অন্য কোনো নক্ষত্রমণ্ডল থেকে আমাদের মহাজাগতিক পাড়ায় এসে পৌঁছেছে।
মঙ্গল-পরিক্রমাকারী (Mars Orbiter) ক্যামেরায় তোলা আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতু 3i Atlas-এর ছবিগুলো গভীর মহাকাশ দেখার জন্য তোলা হয়নি। ছবিতে যা ধরা পড়েছে, তা হলো একটি ঝাপসা, আলোকিত গোলক, যা সাধারণ লক্ষ্যবস্তুর তুলনায় ১০,০০০ গুণ ম্লান।
কিন্তু প্রতি রাতে আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। ১৯ - ২০শে ডিসেম্বর খুব উজ্জ্বল রূপে এটি প্রতীয়মান হবে কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে এসে পড়বে। ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ -এ ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) এমন কিছু ছবি প্রকাশ করেছে যার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছাড়া বিজ্ঞানিদের এর গতি নেই।
গত মাসে এটি নিরাপদেই মঙ্গলের পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে গেছে। ১৮.৬ মিলিয়ন মাইল দূরত্বে ছুঁয়ে যাওয়ার পর কিছু ছবি তোলা হলে ০৭ অক্টোবর, ২০২৫—মহাকাশবিজ্ঞানে এক ঐতিহাসিক তারিখ হয়ে ওঠে। কারণ নথিভুক্ত ইতিহাসে মাত্র তৃতীয়বার, সৌরজগতের বাইরে উৎস থাকা একটি বস্তুকে নিশ্চিত করা হলো।
কিছু বুঝতে না পেরে অনেকে বলছেন এটি ভিনগ্রহের প্রযুক্তি।
ESA নিশ্চিত করে জানায়, আলো যেভাবে বস্তুটির পৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে তার ফলেই ‘নেগেটিভ পোলারাইজেশন’-এর মান পাওয়া গেছে, যা গড়ে প্রায় ২.৭৭%। এই সংখ্যাটি সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়ে নেয়। কারণ এর আগে কোনো ধূমকেতু, গ্রহাণু বা আন্তঃনাক্ষত্রিক অতিথির ক্ষেত্রে এমন চরম মান কখনও দেখা যায়নি। অর্থাৎ এর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যা মৌলিকভাবেই আলাদা।
Colour and Stereo Surface Imaging System - CaSSIS
ক্যাসিস (CaSSIS) ক্যামেরার নকশা মূলত মঙ্গলের সূর্যালোকিত গিরিখাত ও গর্তগুলোর তীক্ষ্ণ ছবি তোলার জন্য। সৌরজগতের বাইর থেকে আসা ক্ষীণ ও দূরবর্তী কোনো অতিথিকে ধাওয়া করার জন্য নয়। তবু প্রধান প্রকৌশলী নিক থমাসের নেতৃত্বে তার গবেষণা দলটি একটি হিসেবি ঝুঁকি নেয়। তারা ক্যামেরাটিকে তার প্রযুক্তিগত সীমার একেবারে শেষ প্রান্তে পাঠিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি, মহাজাগতিক সংকেত বের করে আনার চেষ্টা করেন।
প্রতিটি ফ্রেমেই সেন্সর নয়েজ, কসমিক রে-এর আঘাত এবং মহাকাশযানের সামান্য কাঁপুনির ঝুঁকি ছিল। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে কারণ অরবিটারটিকে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে থাকতে হয়েছিল। সামান্যতম ভুলেই ধূমকেতুটি ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যেতে পারত। কিন্তু প্রচেষ্টা সেখানেই থামেনি। সংগৃহীত ডাটা পৃথিবীতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই, বিশ্বজুড়ে নেটওয়ার্ক যিক্ত সকল বিজ্ঞানী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে তারা প্রতিটি ফ্রেম দ্বারা, নক্ষত্রগুলোকে দিকনির্দেশক হিসেবে, সঠিকভাবে সারিবদ্ধ করেন। তারপর ডজনের পর ডজন এক্সপোজার স্তরে স্তরে সাজিয়ে সেই রহস্যময় গোলকের সংকেতকে আরও স্পষ্ট করে ছবিতে সনাক্ত করতে চেষ্টা করেন। আরো কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে কসমিক রে, যন্ত্রগত ত্রুটি ও মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে আসা আলোর প্রভাব বাদ দিয়ে ধূমকেতুর উপস্থিতি নির্দেশ করা সেই ক্ষীণ বৃত্তাকার আভাটি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠাতে সক্ষম হন।
গঠনঃ
ডাটা অ্যানালাইসিসে দেখা যায় 3iAtlas এর পরিসংখ্যান বিস্ময়কর। আন্তঃনাক্ষত্রিক মানদণ্ডেও এর ভরের হিসাব দাঁড়াচ্ছে ৩৩ বিলিয়ন টনেরও বেশি, যা হ্যালির মতো একটি সাধারণ ধূমকেতুর ভরের তুলনায় প্রায় এক হাজার গুণ বেশি। এই বস্তুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস অর্থাৎ কঠিন মূল অংশটির প্রস্থ আনুমানিক ৩ থেকে ৫ মাইল। তুলনার জন্য বলা যায়, এটি যেন পুরো ম্যানহাটন দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব। ম্যানহাটকে একটি ঘূর্ণায়মান প্রাচীরের ভেতর এঁটে দিয়ে এক খন্ড পদার্থে পরিণত হয়েছে। তবে আসল চমকটি লুকিয়ে আছে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকা গ্যাস ও ধুলোর আবরণে, যাকে বলা হয় কোমা (coma)।
ক্যাসিস ক্যামেরার তথ্য অনুযায়ী, এই কোমাটি প্রায় ৬৮০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত এক উজ্জ্বল বলয় তৈরি করেছে। অথচ আরও আগে, অনেক দূর থেকে তোলা হাবল টেলিস্কোপের ছবিতে দেখা গিয়েছিল প্রায় ৪,০০০ মাইল চওড়া একটি কোমা। এই নাটকীয় পার্থক্য কেবল দূরত্ব বা আলো ম্লান হওয়ার ফল নয়; বরং এটি এমন এক কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়, যা কোমা-কে একই সঙ্গে আরও সঙ্কুচিত এবং আরও ঘনিভূত করেছে বলে নির্দিষ্ট হয়। এরকম আচরণ কোনো ধূমকেতুর কোমায় আগে দেখা যায়নি। ভেতরের কোমাটি যেন অসম্ভব শক্তভাবে আবদ্ধ। সূর্যের আলো পড়লেও তা ছড়িয়ে পড়তে চাইছে না।
পৃষ্ঠের উজ্জ্বলতার (surface brightness) পরিমাপ এই বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সূর্যালোক যেভাবে এর ধুলো ও গ্যাস থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা কোনো পূর্ব পরিচিত ধূমকেতুর প্রোফাইলের সঙ্গে মিলছে না। যেখানে সাধারণ ধূমকেতুগুলো আলো ছড়ায় চেনা নিয়মে, পরিচিত প্যাটার্নে লেজ ও বলয় তৈরি করে, সেখানে 3iAtlas আলো প্রতিফলন ও নেগেটিভ মেরুকরণ করছে এমন এক পদ্ধতিতে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি, নথিভুক্তও হয়নি।
ইতিমধ্যেই অস্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত সেই নেগেটিভ পোলারাইজেশন মান ইঙ্গিত দিচ্ছে, ধূলিকণাগুলোর আকার বা গঠন এমন কিছু হতে পারে, যা আমাদের সৌরজগতে দেখা যায় না। কিছু গবেষকের ধারণা, এই কণাগুলো হতে পারে অজানা খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি, যা পৃথিবীতে স্বাভাবিকভাবে অস্তিত্বই রাখে না। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বিপুল ভর ও কাঠামোগত দৃঢ়তার ধরণ অনুসারে পরিচিত ধূমকেতু বা গ্রহাণু -এসবের কোনো শ্রেণিতেই এই বস্তুটি পড়ে না। এর ভৌত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি এক গভীর রহস্য।
গতিপথের তথ্য
3iAtlas সূর্যের দিকে ধেয়ে আসছে ঘণ্টায় প্রায় ১,৩৪,০০০ মাইল বেগে। এ এমন এক গতি যা অধিকাংশ ধূমকেতুর থেকে অনেক বেশী। কিন্তু এত দ্রুতগতি প্রাপ্তি এবং প্রবল গ্যাস নিঃসরণ সত্ত্বেও, এই বস্তুটি তার হিসাব করা পথ থেকে কখনই বিচ্যুত হচ্ছে না। 3iAtlas সূর্যের সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছে ৩০ অক্টোবর, ২০২৫-এ, সূর্য থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন মাইল দূরত্বে, যা শুক্র গ্রহের কক্ষপথেরও ভেতরে। আর আজ ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটে সে অবস্থান গ্রহন করবে। যদি এর পথ অপরিবর্তিত থাকে, তবে এটি সূর্যকে পাশ কাটিয়ে সৌরজগত ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। পেছনে রেখে যাবে বিপুল তথ্যভাণ্ডার আর অসংখ্য অমীমাংসিত প্রশ্ন।

রাসায়নিক গঠন
3iAtlas এর রাসায়নিক বিশ্লেষণ রহস্যকে আরও গভীর করেছে। পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুযায়ী, এই বস্তুর নিউক্লিয়াস থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড (CO₂) - এর জেট ছুটে বেরোচ্ছে ২,১৬,০০০ মাইলেরও বেশি দূরত্ব পর্যন্ত, যা পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার দূরত্বের প্রায় সমান। কিন্তু এই নিঃসরণগুলো কোনো পরিচিত ধূমকেতুর মতো মসৃণ নয়, বা সমান সমান আকারের বলয় তৈরি করছে না। বরং CO₂ বেরোচ্ছে তীক্ষ্ণভাবে। স্পেকট্রাল ডেটা আরও একটি বিভ্রান্তিকর দিক সামনে এনেছে, যা হলো নিকেলের উপস্থিতি। এখানে শক্তিশালী নিকেল নির্গমনরেখা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার সঙ্গে যে লোহা (iron) সাধারণত থাকার কথা তা প্রায় অনুপস্থিত। আমাদের সৌরজগতে নিকেল ও লোহা প্রায় অবিচ্ছেদ্য। নক্ষত্রের মৃত্যুকালে তারা একসঙ্গেই গঠিত হয়। অথচ এখানে নিকেল প্রাধান্য পাচ্ছে, আর লোহা শনাক্ত হচ্ছে না। এ কারণে কিছু গবেষক নীরবে প্রশ্ন তুলছেন, এই মহাজাগতিক বস্তুটি কি কি কোনোভাবে বাছাই করে বা প্রক্রিয়াজাত করে কেউ নির্মান করে দিয়েছে সৌরজগতে প্রবেশের আগেই?
তারা কারা?
ভিন গ্রহের অতি উন্নত প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন প্রানী নয়তো?
উপসংহার
৭ অক্টোবর, ২০২৫–এ, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ExoMars Trace Gas Orbiter থেকে তোলা ছবি থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, 3iAtlas, একটি ৩৩ বিলিয়ন টন ওজনের আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু, যা মঙ্গল গ্রহ থেকে মাত্র ১৮.৬ মিলিয়ন মাইল দূরে তখন অবস্থান করছিল। মঙ্গলের জন্য তৈরি ক্যাসিস (CaSSIS) ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক ক্ষীণ, নেগেটিভ পোলারাইজড গোলক,যার বৈশিষ্ট্য কোনো পরিচিত ধূমকেতুর সঙ্গে মেলে না। স্পেকট্রাল বিশ্লেষণে দেখা যায় ২ লক্ষ মাইলেরও বেশি দীর্ঘ CO₂ জেট এবং নিকেলের উপস্থিতি আছে কিন্তু লোহা প্রায় অনুপস্থিতি। একই সঙ্গে, বস্তুর গতিপথ পৃথিবীর কক্ষপথের সমতলের মাত্র ৫° ভেতরে
দিয়ে। এই সমতল একটি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করিডর, যেখানে সব প্রধান গ্রহ চলাচল করে। এলোমেলোভাবে কোনো আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তুর এমন পথে এসে পড়ার সম্ভাবনা ১%-এরও কম। কিন্তু 3iAtlas -কে এই সমতলেই অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে।
3iAtlas যদি নিছক একটি প্রাকৃতিক ব্যতিক্রমও হয়, তবু তার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি ইতিমধ্যেই বদলে দিয়েছে আমাদের চিন্তার জগৎ এবং ধারণার বিস্তৃতি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



