somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি বেঁচে ছিলাম হুমায়ূনের সময়ে...

২৩ শে জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(যাঁরা হুমায়ূন আহমেদের “অপন্যাস” পছন্দ করেন না অথবা গত ৩/৪ দিন ধরে তাঁর স্মরনে লেখা অসংখ্য “হাবিজাবি”তে অতিষ্ঠ, তাঁরা বিনা দ্বিধায় এই সামান্য লেখা এড়িয়ে যেতে পারেন। আর যাঁরা পড়ে ফেলবেন, তাঁদের উদ্দেশে বলছি- যে লোকটার হাত ধরে সাহিত্যের ভয়ঙ্কর সুন্দর জগতে আমার প্রবেশ, তাঁর মৃত্যুতে এতটুকু বিরক্ত তো আমি করতেই পারি!)

তখন বেশ ছোট আমি। স্কুলে পড়ি। ক্লাস ফাইভ/সিক্স। বাসায় প্রাইভেট টিউটর ছিলেন মানিক স্যার। দুপুরের দিকে আসতেন। আমার অলস দুপুরগুলো সচকিত হয়ে উঠতো তাঁর সাইকেলের টুং টাং শব্দে।

সেদিন কেন যেনো আসতে দেরি করছিলেন। বিছানায় আধ শোয়া হয়ে পাতা উল্টাচ্ছিলাম একটা বইয়ের। সেদিনই আরিফের কাছ থেকে এনেছি। তেতুল বনে জোছনা। আহামরি কিছু না। সাদামাঠা গল্প।

আমি তখন কাকাবাবু পড়ি। ফেলু মিত্তির আর শঙ্কুর সাথে নিত্য ওঠাবসা। সে তুলনায় এ বই বড়ই পানসে। তারপরও, পাতা উল্টাতে উল্টাতে কখন যে নিজেই ঢুকে গেছি সেই জগতে- খেয়ালই করিনি। অদ্ভুত বই। কেমন যেনো নেশা ধরানো।

বারবার ঘড়ি দেখছি। সাথে মনে মনে প্রার্থনা- স্যার যেনো না আসেন। ঝড়ের মতো কেটে গেলো পরের একটি ঘন্টা। বই শেষ। আমি তখন ঝরঝর করে কাঁদছি।

বইয়ের কাহিনী মিলনাত্মক, কেতাবি ভাষায়- কমেডি। তারপরও কাঁদছি। অসহ্য সুখ হৃদয়ে যে তীব্র হাহাকার সৃষ্টি করে সদ্য কৈশরের এক বালকের কাছে সে তথ্য তখন নতুন।

বাইরে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে শ্রাবণের তুমুল বর্ষণ। আমার একতলার ছোট্ট ঘরটায় বাতাসের দাপাদাপি। জানালার পর্দা উড়ছে। আলো-অন্ধকারে মুগ্ধ হয়ে দেখছি প্রকৃতির সেই অলৌকিক বায়োস্কোপ। আর কাঁদছি। সাহিত্য এতদিন পড়েছি। শুধুই পড়েছি। অনুভব করা হয়ে উঠেনি। হৃদয়ের গভীরতম অন্দরে শুদ্ধতম আবেগের যে সূক্ষ্ম সুতোটা থাকে তাতে প্রবল টান পড়াতে আমি দিশেহারা। হতবুদ্ধি এক কিশোর অনুভবের যে প্রান্তরের সন্ধান সেদিন পেয়েছিলো, তার জন্ম এ পৃথিবীতে নয়। অন্য কোন ভুবনে।

সেই শুরু। এর পর থেকে শাপগ্রস্থের মতো পড়ে গিয়েছি একের পর এক আশ্চর্য সব লেখা। লজিক, এন্টি লজিক আর ফ্যান্টাসি পুরোপুরি এলোমেলো করে দিলো আমার জগৎ। জীবন।

ছোট্ট এ জীবনে যখনই হিসেব মেলানো কষ্ট হয়ে যেতো ছুটে যেতাম হিমু নয়তো মিসির আলির কাছে। ছায়ার মতো পাশে থাকতো শুভ্র নামের অসম্ভব মেধাবী সেই ছেলেটা। বলার মত কোন অর্জন নেই এ জীবনে। তারপরও, যখন আমার ছেলে প্রশ্ন করবে-"বাবা, তোমার জীবনের সার্থকতা কি?", ভেবে রেখেছিলাম, বিশ্বাস করুন হুমায়ূন, বড় মুখ করে আমি বলবো- "আমি বেঁচে ছিলাম হুমায়ূনের সময়ে। এক জীবনে এর থেকে বেশি কিছু লাগে না।"

হুমায়ূন, জীবনের চরম দুঃসময়ে আপনার বই জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছি। আজ আপনি চলে যাওয়ায় আমার জড়িয়ে ধরে কাঁদার মতো কেউ রইলো না। আপনিইতো বলেছিলেন-“যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো- এক বরষায়”। হুমায়ূন, হৃদয়ের দু’কূল উপচানো বর্ষায় আমাদের যখন মন কাঁদবে, আমরা কোথায় যাবো?

আপনাকে ছাড়া বড় পানসে লাগবে অনাগত প্রতিটি পূর্ণিমা। বইমেলার সেই ধুলোময় ফুটপাথ, প্রতিটি ১৩ নভেম্বর, অসহ্য সুন্দর বর্ষার প্রতিটি কাকভেজা কদম- সবকিছুই কি অর্থহীন হয়ে যাবে না?

আমার এখনো মনে পড়ে আপনার সেই কথা-
“আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সিলেটের মীরাবাজারের বাসায় এক গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো, দেখি মশারির ভেতর ঠিক আমার চোখের সামনে আলোর একটা ফুল ফুটে আছে। বিস্ময়, ভয় ও আনন্দে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম- এটা কি, এটা কি?

বাবা জেগে উঠলেন, মা জাগলেন, ভাইবোনেরা জাগল। বাবা আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, জোছনার আলো ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে মশারির গায়ে পড়েছে। ভেন্টিলেটরটা ফুলের মত নকশা কাটা। কাজেই তোমার কাছে মনে হচ্ছে মশারির ভেতর আলোর ফুল। ভয়ের কিছুই নেই, হাত বাড়িয়ে ফুলটা ধর।

আমি হাত বাড়াতেই সেই আলোর ফুল আমার হাতে উঠে এল কিন্তু ধরা পড়ল না। বাকি রাতটা আমার নির্ঘুম কাটল। কতবার সেই ফুল ধরতে চেষ্টা করলাম- পারলাম না। সৌন্দর্যকে ধরতে না-পারার বেদনায় কাটল আমার শৈশব, কৈশর ও যৌবন। আমি জানি সম্ভব না, তবু এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি যদি একবার জোছনার ফুল ধরতে পারি- মাত্র একবার। এই পৃথিবীর কাছে আমার এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবার নেই।”

হুমায়ূন, চির অদেখার যে দেশে আপনি চলে গিয়েছেন সেখানেও কি আলোর ফুল ফোটে? ফিনিক ফোটা জোছনায় হাহাকারের মত ভেসে আসে কি অপার্থিব কোনো সুর? অধরা সৌন্দর্যের তৃষ্ণায় এখনও কি কাটে উন্নিদ্র রজনী?

হুমায়ূন, সারা জীবন আপনি চলে যেতে চেয়েছেন চাঁদনি পসর রাতে। বড় ভুল দিনে যাত্রা করলেন আপনি। অমাবস্যায়। কেন বেছে বেছে সেই দিনই আপনার দরজায় এসে দাঁড়ালো দয়াময় কারিগরের আশ্চর্য সেই পালকি? আর মাত্র দু’টো সপ্তাহ আপনি অপেক্ষা করতে পারলেন না? মাত্র কয়েকটা দিন? সারা জীবন এক নিঁখুত স্রষ্টার মতো সবাইকে মাতিয়ে কেন শেষকালে এত বড় ভুল করলেন আপনি?

বড্ড আনাড়ির মতো!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×