দাদী এখনও বলেন "তোর দাদা তোরে কোলের ভিতরে ঢুকাই লুকাই রাখতো যেন তোর আম্মা তোরে মাইত্ত না হারে।"
অথচ দাদার চেহারাটাই আমার মনে নাই। তার কোন ছবিও নাই যে তা দেখে বুঝতে চেষ্টা করবো তিনি কেমন ছিলেন। তবে সবার কাছে থেকেই জানতে পারি দাদা আমাকে ভীষণ আদর করতেন... হয়ত ভীষণ ছিলো বলেই তা আমার জন্য খুবই কম বরাদ্দ করা ছিল, আর তাই আমি কিছু বুঝার আগেই দাদার মৃত্যু হয়। বুঝ হবার অনেক পরে জানতে পেরেছি এইসব কথা। দাদী থেকে নানু দাদার কথা বেশি বলতেন যে দাদা আমাকে অনেক আদর করতেন। আর তাই মাঝে মাঝে মনে হয় দাদাকে যদি কখনও দেখতে পেতাম......
আমার খালামণি। মা'র থেকেও যাকে আপন মনে হত। আদো আদো মনে পড়ে দাদার বাড়ি থেকে খালামণির সাথে চলে এসেছিলাম মা'কে ছেড়েই। আর তার জন্য নানুর কী বকা খালামণীকে। বাবা আর খালু একি সাথে ডিফেন্সে জব করতেন। অবশ্য তখন এটা বুঝতাম না, তবে মাঝে মাঝেই দেখতাম খালু আমাদের বাসায় আসত, থাকত রাত ১০টা ১১টা পর্যন্ত, অন্য মেহমানদের মতন কিছুক্ষণ থেকে চলে যেত নাহ। রাতে বাসার সবাই একসাথে খাওয়া - দাওয়া করার পরে খালু চলে যেত। যাবার আগে আমাকে কোলে নিয়ে চুমু দিত। খুবই বিরক্তি লাগত ব্যাপারটা... ..তখন বুঝতাম যে খালু মনে হয় আমাদের কাছাকাছি কোথাও থাকেন, খালাকে নিয়ে আসলে কত্ত মজা হবে। কিন্তু একদিন দেখলাম খুব সকালে মা বাবা আমি, খালু, ছোট মামা বাড়িতে যাচ্ছি। নানু বাড়ি। আর যেয়ে দেখি কী ভীড়। কিন্তু তার মধ্যে আমার খালামণী নাই। তাকে যখন খুঁজলাম তখন কেউ একজন আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেলো। দেখলাম আমার সুন্দর চেহারার খালামণী কী কালো হয়ে গেছে। নীলচে কালো মুখ। সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। সেই দিনের পর আর খালামণীকে দেখিনি কখনও। সেই প্রথম আমার কোন মৃত মানুষ দেখা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন এখনো ঘুমের ঘোরে সেই মুখ দেখি। রাতে স্বপ্নে দেখলে যেগে উঠি... ... হয়তো সেই ছোট বয়সে দেখা স্মৃতি আজও আমার মাথায় জমে আছে।
আম্মারা তিন বোন। আম্মার বড় যিনি তাকে ডাকতাম বড় খালামণী আর ছোটজনকে শুধু খালামণী। কিন্তু খালামণী মারা যাবার পর থেকে আমার বড় খালামণী হয়ে গেলো আমার বড় আন্টি। আম্মা কতবার বলেছে কেন আমি খালামণী না বলে তাকে বড় আন্টি ডাকি। আমি তার কারণ বলতে পারি নি। আজও বলি নি। আম্মা এই ব্লগ পড়তে পারবেও না। তাই তাঁর জানার উপায়ও নেই জানার। খালামণী আসলে একজনই ছিলো আমার......
আম্মার জেঠাতো ভাই। হারুন মামা। আমি তখন কী কারনে যেন নানু বাড়িতে। খুব ছোট থাকতে ছোট মামার সাথে গিয়েছিলাম। আসলে মা'এর থেকে নানুকেই খুব পছন্দ করতাম। আর তাই মা'কে ছেড়ে নানুর কাছে থাকতে আপত্তি ছিলো নাহ। কিন্তু এক সন্ধ্যায় খবর আশে ঢাকা থেকে যে আমাদের নানুর বাড়ির কে যেন এ্যাকসিডেন্ট করেছে ঢাকায়। সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। পরে বড় মামা খোঁ নিয়ে যানতে পারেন হারুন মামা মিলে কাজ করত, সেখানে কাজ করতে গিয়ে মিলের কোন একটা বড় যন্ত্রের চাকায় প্রথমে তার মাফলার আর পরে শরীর চলে যায়। বাড়ির সবার মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা কাজ করছে সারাক্ষণ। কখন আসবে লাশ। অনেক রাতের দিকে লাশ আসলো। কোন এক বড় কাজিনের সাথে আমিও দেখতে গেলাম। পরে বড় মামা সেই কাজিনকে বকেছিলো আমাকে কেন নিয়ে গিয়েছিলো? লাশটা যেই ঘরে রেখেছিলো পরে অনেকদিন সেই ঘরের পাশ দিয়ে আমি হাটতে ভয় পেতাম।
আমার নানা। নানার সাথে খুব একটা স্মৃতি মনে আছে তা নয়। তবে নানা ছিলেন গুরুগম্ভীর, কিন্তু ছোটদের আদর করতেন। আমি দেখেছি আমি যখন ক্লাস থ্রী তে পড়ি তখন আমার থেকে দুই এক বছরের দুই কাজিনকে নিয়ে নানা বিকালে তার নানা রকম গাছে পানি দেওয়াতো। নানার ছিলো গাছ লাগানোর শখ। নানা বাড়িতে নানা ফলের গাছ ছিলো, আবার একই ফলের কয়েকজাত ছিলো তার। সারাদিন তিনি এসব নিয়েই মেতা থাকতেন। কাজিনরা আমার নানাকে (তাদের দাদাকে) খুব ভয় পেত। তবে আমাকে কখনও বকাঝকা করেননি তিনি। আমি তখনও সাঁতার শিখিনি। আর আমার সেই দুই কাজিন সাঁতার পারে খুব ভালোই। তো তাদের সাথে একবার পুকুরে নেমে অনেকক্ষন ছিলাম, এর মাঝে একবার আমি ডুবে যেতেও নিয়েছিলাম। তারা আমাকে নিয়ে আসে পাড়ের কাছে। আর তখনই পুকুরের পাশে নানার আগমণ। তার এক ধমকে সবাই আস্তে করে উঠে চলে আসি। আমরা ধারণা করেছিলাম নানা দেখেছে আমি যে ডুবে যেতে নিয়েছি। তিনজনই ভয়ে ভয়ে ছিলাম। পরে তারা নানার সামনে না এসে আমাকে পাঠায় যে নানুকে নানা কী বলে তা শুনার জন্য। নানা নানুকে বলে "আপনি নাতিকে গোসলে পাঠানের সময় এর পর থেকে সাথে থাইকেন।" নানা নানুকে আপনি করে বলতেন। নানুও তাই বলতেন। নানা আমাকে আদর করতেন না তা না, কিন্তু নানুর মতন তার নেওটা হতে পারি নাই।
আমার নানার খুব প্রিয় ছিলো আমার আম্মা, ব্যাপারটা ছিলো ভাইস ভার্সা... ...আম্মা ছিলো নানার নেওটা বলতে যা বুঝায়। আম্মাকে দেখেছি নানার জন্য অনেক কিছু করেতেন। নানাকে খাইয়ে দিত, অসুধ খাওয়াতো, গোসল করাতো, অযু করিয়ে দিত...... আরো নানা কিছু......
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় হঠাৎ করে বাড়ি যেতে হয়েছে, এবারে আমি জানতাম যে নানার কিছু একটা হয়েছে। আম্মাকে বলা হয়েছে নানার শরীর খারাপ, আম্মাকে দেখতে চেয়েছে। আমিও তাই জানি। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছানোর পর আমরা জানতে পারি নানা আর নেই।
আমার নানু। মানুষটার কথা মনে পড়লে আপনি আমার চোখ ছোট হয়ে আশে, ভিজে যায়। একরকম হাহাকার করে উঠে বুকে। অথচ আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন তিনি মারা যান। মনে আছে তাকে ঢাকায় আনার কথা বললে তিনি রাজি হতেন না। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যাবেন না কোথাও তাই। নানার মৃত্যুর পরে ছোট দুই ছেলের পীড়াপীড়িতে নানুকে ঢাকায় নিয়ে আশা হয়। বড় আন্টি আর আমার আম্মা ঢাকায় থাকেন। নানুকে যেদিন আমাদের বাসায় আনা হয় বড় আন্টির বাসা থেকে সেদিন আমার ছোট বোন বলে বসে "নানু আপু আসবে আজকে আমাদের বাসায়।" আসলে বড় আন্টির দুই মেয়ের সাথে মিলিয়ে সে নানুকেই ভেবে বসে এটাও কোন আপুই হবে যেহেতু আন্টির বাসা থেকে আমাদের বাসায় আসতেছে। একবার নানুর গাছে কয়েকটা লিচু আরএকটা আনারস দেখে এসেছিলাম। পরে আমার জন্য কেনো তা পাঠানো হল না ঢাকায় তার জন্য নানুকে কত বার বলেছিলাম " ব্যাঙ-এর মতন নাতি নাতনী নিয়ে খেয়ে ফেলছে আমার জন্য পাঠায় নাই।" পরে যখন একটু বড় হয়ে বুঝতে শিখেছি নানু সেই কথা বলে আমাকে কত খেপাতো কারণ আসলে লিচু আর আনারস আসলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। আর আমি লজ্জায় পড়ে যেতাম। বাড়িতে গেলে যখন নানুর ভাইরা বা বোনরা আসত দেখা করতে তখন তাদের সামনে নানু এই কথা বলতো "আমি নাকি ব্যাঙ, ব্যাঙ-এর মতন অর লিচু আর আনারস নাতি নাতনী নিয়ে খাই ফেলছি।"
সেই কথা নিয়ে অবশ্য নানু পরে আর খেপায় নি। এখনও মনে আছে নানু বাড়ি থেকে যখন কোন কিছু পাঠাতো তখন আমার নামে আলাদা একটা ব্যাগ থাকত। কতবার কত আম দেখেছি তার গায়ে আমার নাম লেখা থাকত। নানু বাড়ি থেকে আম পাঠালে আলাদা করে আমের গায়ে লেখা থাকতো আমার নাম... ..."বাপ্পীর জন্য।"পরে বাড়ি গেলে নানু জানতে চাইতো আমার নাম লেখা আম কয়টা পেয়েছি। কোনটা কম হয়ে গিয়েছিলো কিনা। তখন বুঝতাম না নানুর এই আদর। আমার প্রিয় ছিলো নাড়ু। স্বাদটা কিছুটা ঝাঁজালো, ঢেঁকিতে ছাটা... নানু ছাড়া আর কেউ তা আমার জন্য বানিয়ে রাখত না... ... নানু মারা যাবার পর সেই নাড়ু খেয়েছি মনে হয় এক কি দুবার হবে হয়তো।
যেই সপ্তাহে নানু মারা গেলেন ঠিক আগের সপ্তাহে নানুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তার বলে দিয়েছিলো বাড়ি নিয়ে যেতে। আমার আব্বা আর আম্মা সেদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। নানু নাকি ইশারাতে আমাকে খুঁজেছিলো। আম্মাকে বলেছিলো "বাপ্পী কই?" আম্মা বলেছিলো "বাপ্পীর পরীক্ষা তাই আজ আনি নাই।" তার পরের দিন তার আবার স্বাস্থ্য কিছুটা ভালো হতে থাকে। ৭দিন পর, আমার তখন পরীক্ষা শেষ। নানুর তখন আবার শেষ অবস্থা। এবার আমি যাবার সুযোগ পাই, আমরা তিন ভাই বোন সহ বাবা -মা যাই। খালার বাসা থেকে নানুর সাথে দেখা করতে যাই হাসপাতালে। শান্তিনগরের একটা হাসপাতালে। আমার সাথে তার দেখা হয়। কিছুক্ষণ পরে আমার সাথে হাসাহাসিও করে। মুখের কাছে কান নিলে কথা বলতে চাইতো। সেদিন আসার আগে আমাকে দোয়াও করে দিয়েছিলো। একবারও বুঝতে পারি নি সেই শেষ দেখা, সেই শেষ দোয়া করে দেওয়া। মা আর ছোট বোনকে রেখে আমরা(বাবা, মেজো বোন আর আমি) বাসায় ফিরে আসি। বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরে বাবার এক বন্ধু এসে বাবাকে বাসার বাইরে নিয়ে কি যেন বললেন। তখন রাত ১২টার কিছু বেশি। বাবা আমাকে আর ছোট বোনকে বাসায় রেখে আবার হাসপাতালে গেলেন কী দরকারের কথা বলে আর বললেন হয়তো আসতে দুই দিন দেরি হবে আমরা যেন ভালো হয়ে থাকি। তখনও ছোট বোনের একটা পরীক্ষা বাকি ছিল। আমি কিছুটা বুঝতে পারি কেনো দু একদিন দেরি হবে। কিন্তু আমার তখন আর বাসায় থাকতে মন চাইছিলো নাহ। দুদিন পরে আম্মা বাসায় ফিরে বাবা সহ। পুরা বিদ্ধস্থ হয়ে। বাসায় ঢুকেই আমাকে জড়িতে ধরে কান্না করতে থাকে। আম্মার সেকি কান্না...... নানা মারা যাবার সময় আমি আম্মার কাছে ছিলাম না। নানু মারা যাবার সময়ও না। কিন্তু আম্মার কান্না দেখে বুঝতে পারি আমি কি হারিয়েছি... ...
আমার ফুপা। ছোট বেলায় খুব নানার বাড়ির পাগল ছিলাম। দাদা বাড়ি আসতে চাইতাম না। তার অবশ্য প্রধান কারন ছিলো দাদা বাড়িতে কারেন্ট ছিলো নাহ। কিন্তু যখন কিছুটা বুঝিতে শিখি তখন দেখি আরে ফুফুর বাড়িতে কারেন্ট আছে। তার বাড়িতে থাকা যায়। কারেন্ট তো কারেন্ট সাথে দেখি টিভিও আছে। আসলে তারা থাকতেন পৌরসভাতে তাই আর কী। সেখানে তাঁর দোকান ছিলো। ফুফা আমাকে খুব পছন্দ করতেন, জানিনা কেন। তবে ফুফু, ফুপাতো বোন এখনো বলে আমাকে তিনি নাকি অনেক পছন্দ করতেন। আসলে তিনি ছিলেন খুব মিশুক প্রকৃতির। সবার সাথেই মিশতে পারতেন। আমার আম্মার নাম আর আমার ফুপির নাম এক। তাই নিয়ে তাদের মধ্যে অন্যরকম ভাব। আর ফুফার সাথেও তাই। এটা নিয়ে ফুফা মজা করতেও ছাড়তেন না। আমাদের বাসায় আসলে বলতেন "আমার বউ-এর বান্ধবী কই?" এটা দেখে আমার মজাই লাগত। মজা করার মানুষ ছিলেন। কলেজে পড়ার সময় আমি একা একা প্রথম বাড়িতে যাই। সবার বাড়িতে যাই সবার সাথে দেখা করতে। তখন ফুপার বাড়িতে গেলে থাকি কয়েকদিন। সেবার তার দুইটা ছবি তুলেছিলাম। নতুন মোবাইল কিনেছিলাম তাই যা ইচ্ছা ছবি তুলতাম। তার ছোট মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন এমন একটা ছবি... ... আবার গ্রামে আরেক ফুপুর বাড়িতে আমরা যেয়ে দেখি একটা গাভীর ছানা তৈরি করা হয়েছে খড় দিয়ে, কারণ সেই গাভীর বাছুরটা মারা গেছে। খড়ের ছানা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। ফুপা তখন বললেন এটার কয়েকটা ছব তুলে নিয়ে আসতে। সেখান থেকে ঢাকা আসার ৭দিনের মাথায় শুনি তিনি আর নেই। হঠাৎ করে বুকে ব্যাথার পরে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে ততক্ষণে সব শেষ। হার্ট এ্যাটাক।
এরপর থেকে আমার মনে কেমন যেন একটা বিশ্বাস আসতে থাকে কেউ মারা যাবার সময় মনে হয় আমি সামনে থাকতে পারবো নাহ। এখন পর্যন্ত থাকতে হয়নি... ... আমি চাইও না... ... ... মাঝে মাঝে মনে হয় সব আপনজনদের ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই... যেখানে আমি কাউকে চিনবো না...... কেউ আমাকে চিনবে না... ... ...
{{{{লেখাটা অনেকদিন ড্রফটে ছিলো। আর লেখার শুরুটা অন্য একটা লেখার সাথে হয়ে গিয়েছিলো। পরে মনে হলো এইটা নিয়ে আলাদা লেখা হতে পারে, আর তখন এমনভাবে কান্না আসছিলো যে দুইটা লেখা এক করে ফেলতে ইচ্ছা হয় নি}}}}
বানান ভুল দেখার জন্য লেখাটা পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে নাহ। ভু্ল থাকলে কষ্ট করেন একটু।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:২১