(৯)
জেকবের সাথে দেখা হওয়ার দিন আসছেঃআগামীকাল বিকেল তিনটায় জেনেভা কলোনীর গলফ ক্লাবে।শহরের একটা রেস্তোরা হলে ভাল হতো,তবে গলফ ক্লাবটাই জেকবের পচ্ছন্দ।
বিকেলের ঐ সময় চারপাশটা বেশ ফাঁকা থাকে,আর গোপনীয়তা বলতে যা বোঝায় তা রক্ষা করতে জেকবের বেশ সুবিধাই হবে।সম্পাদকের কাছে কোন একটা অজুহাত দিয়ে বেরোতে হবে,খুব একটা অসুবিধা হবে না,আমার ইলেকশনের লেখাটার উদ্ধৃতি বেশ কটা পত্রিকায় ছিল,বাড়তি কিছু বিষয় জোগাড়ের কথা বলে সম্পাদকের অনুমতি পাওয়া কষ্ট হবে না।
চুপচাপ,শান্ত একটা পরিবেশ গলফ ক্লাবে,হয়তো এই নিস্তব্ধতাই জেকবের পচ্ছন্দের কারণ,অবশ্য আমার কাছেও খুব একটা খারাপ মনে হয়নি,স্বাপ্নিক এক ছোঁয়াচ।শরতের সোনালি ছোঁয়াচে গাছের রং বদলে গেছে,জেকবের হাত ধরে ঘুরতে ভালই লাগবে।হাঁটা ফেরায় আমার চিন্তা,কথা বলার ক্ষমতাটা বেশ জোরালো হয়ে ওঠে,নাইওনে দৌড়াতে দৌড়াতে সেটা উপলদ্ধি করলাম।
রাতের খাবার ছিল,পনীর ভাজির তরকারী,সুইজারল্যান্ডে যা রাকলেট,সাথে গরুর মাংস,আলুর ঝোল।ছেলেমেয়েরা জানতে চাইলো,বিশেষ কোন অনুষ্ঠান,নাকি কোন পর্বের দিন?
আমরা সবাই সুস্থ আর একসাথে বসে খাওয়ার সুযোগ এটা কি কম আনন্দের কথা।খাবারের পর ছেলেমেয়েদের ঘরে বসে গল্প বলা আরম্ভ করলাম,কিন্ত ওদের মনটা হাতে ধরা টেবলেটে,
পনের বছরের নীচের ছেলেমেয়েদের জন্যে এই সব জিনিষ নিষিদ্ধ করা উচিত।অনেক বলার পর অনিচ্ছায় টেবলেট বন্ধ করে,গল্প শোনা আরম্ভ করলো সবাই।
সারা পৃথিবী তখন তুষারে ঢাকা,জীবজন্তরা সব মারা যাচ্ছে প্রচন্ড শীতে,একদল সজারু ঠিক করলো তারা একে অন্যের শরীরে উষ্ণতা যোগাবে।তবে তাদের শরীরের কাটা বিশাল অন্তরায়,শেষে সেই চিন্তা মন থেকে বাদ দিল তারা।
মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে,সজারুদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে একে অন্যের খোঁচাটা সহ্য করবে না শীতে সবাই শেষ হয়ে যাবে।
বুদ্ধিমানের মত তারা একে অন্যের যন্ত্রনা ভাগ করে নিল,আর খুঁজে পেল বেঁচে থাকার মন্ত্র।তারা শিখলো সহনীয়তা অস্তিত্বের একটা বিরাট অংশ।
ছেলেমেয়েরা জানতে চাইলো সত্যিকারের সজারু কি দেখা সম্ভব?
“আচ্ছা,চিড়িয়াখানায় কোন সজারু নাই”?
আমার ঠিক জানা নাই।
“তুষার পর্ব নিয়ে যা বললে,কেমন ছিল ঐ সময়টা”?
এমন একটা সময় শুধু শীত বললে ভুল হবে,এমনই প্রচন্ড শীত যার দাপটে সারা পৃথিবি তখন ঢাকা ছিল তুষারে।
“ও তাহলে শীতের মতই”।
ঠিক তা না,এমন শীত যার কোন শেষ ছিল না।
“আচ্ছা,একে অন্যকে জড়িয়ে ধরার আগে,সজারুরা তাদের কাঁটা খুলে ফেললো না,কেন,”?
অন্য কোন একটা গল্প বেছে নেয়া উচিত ছিল।লাইটটা বন্ধ করে ঘুমপাড়ানী গান আরম্ভ করলাম,আল্পসের উপত্যকার লোকগাথা,চুলে বিলি কাটতে কাটতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সবাই।
ভ্যালিয়াম টেবলেট দিল স্বামী,ওষুধ খেয়ে তার উপরে নির্ভরশীল হতে চাই না,তবে প্রস্ততি দরকার আগামীকালের জন্যে।১০ মিলিগ্রামের একটা টেবলেট আমাকে নিয়ে গেল ঘুমের দেশে,তবে স্বপ্নছাড়া একটা ঘুম।
সময়ের একটু আগেই পৌছালাম গলফ ক্লাবে,মাঠের খেলার ঘরটা ছেড়ে বাগানের দিকে গেলাম,বড় বড় গাছগুলোর বিকেলে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম।শরতের সাথে একাকীত্বের কান্নার অদ্ভুত একটা যোগাযোগ আছে,গরমের উচ্ছাসটা থাকে না তখন।ছোট হয়ে আসে দিন,সজারুদের কল্পনার সেই তুষার রাজ্যে নেই আর কোথাও,অন্য কারও একটু আঘাতও সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমাদের।প্রায়ই শুনি কত মানুষ মরছে,কেউ শীতে,কেউ খাবারের অভাবে,কোথাও বন্যায়-আমরা সাহায্য করি।কিন্ত ভুলে যাই সমস্যাগুলো আমাদেরই তৈরী,সাহায্যের সোচ্চার একটা সুর ধরে একধরণের পাশবিক আনন্দ খুজে নেই আমরা।
প্রকৃতির একটা রুপ আছে যা কোনভাবেই কোথাও তুলে ধরা যায় না,তুলির ক্যানভাসে হোক,হোক সে মনের খাতায়।একই গাছ গ্রীষ্ম,শরত,শীতে,ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় একেক সময় একেক ব্যাক্তিত্ব নিয়ে দেখা দেয়,এক পর্ব শেষ হয় আরেক পর্বের গল্প,তারপর,বসন্ত আসে-আনে নতুনের গান ফুলে ফুলে হেসে উঠে সারা পৃথিবী।
পুরোনো ভুলে যাওয়ার শুরু শরতে-শীতের কান্না দুমড়ানো মোচড়ানো দুঃখের অসহায়ত্বে সর্মপনের আগে নাচের পর্ব।জেকবকে দেখলাম,রেস্তোরার বাইরের এলাকাতে আমাকে না দেখে ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করে বাইরে হেঁটে আসছিল।
আমার মনটা চাইছিল দেখার পর সে যেন আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়,যেন প্রশংসা করে পোশাকের,জুতোর,হাটার ভঙ্গীর।আমার হ্রদয় ছুটছিল ঝড়ের গতিতে,তবে চাই না তার প্রকাশ হোক আমার চোখেমুখে।
(ভাবছিলাম কি বলবো জেকবকে,কেন দেখা করছি তার সাথে?এ ভাবে সামাল দিয়ে কি
লাভ,আমাদের দুজনের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে,যা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার
দিকে। কেন ভয় পাচ্ছি আমরা হোঁচট খেয়ে পড়ার?যেন অন্ধকার একটা গুহা দিয়ে হেঁটে
যাচ্ছি,অজানা একটা রাজ্য,উন্মাদনা থেকে আবেগ,আর তারপর সম্পুর্ন আত্মসর্মপন।
আমাকে দেখে কি ভাববে,জেকব?কি ভাবে বোঝাবো তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই, “অমঙ্গল,অঘটন বলে যদি কিছু থাকে,সেগুলো কথার কথা আর ভঁয় শুধু আমাদের মনে”।
হতাশ,মনমরা ভাবটা ছেড়ে আবেগ,উদ্দীপনার নতুন এক মানুষ এখন আমি,প্রতি পদক্ষেপে বদলে আমি হচ্ছি নতুন আরেকজন।কি বলবো জেকবকে,এত ভাবার কি আছে,মনের স্রোতে যা আসবে ভেসে যাব সেই কথায়।আমার মনের গভীরে লুকানো কথাগুলো,খুঁজে বের করতে হবে।কেন যে খুঁজছি মনের না বলাগুলো!আমার মনের লুকোনো ভয়টা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য এক রাজ্যে,চারপাশের সব কিছু হারিয়ে যেন গেছে,একা পড়ে আছি আমি,শুধু একটা মুখ এ পৃথিবীর।
গাছের পাতাগুলো সুর্যের আলোয় শেষ ছবিটা এঁকে,ঝরে যাচ্ছে এক এক করে,একই অনুভুতি আমার মনের খাতায়,প্রতি পদক্ষেপে ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার মনের বাঁধন,ভেঙ্গে যাচ্ছে দেয়াল,সব আড়াল সরিয়ে উকি দিচ্ছে শরতের মিষ্টি হাসিটা।
কি নিয়ে কথা বলবো,আমরা?আসার সময় গাড়ীতে যে গানটা শুনলাম?নাকি বাতাসের সাথে গাছের যুদ্ধের কথা?হয়তো বা ভালমন্দ মেশানো জীবন যুদ্ধের গল্প।জীবনের হতাশা,অসহায়ত্ব নিয়ে কথা বলতে পারি,তবে জেকব হয়তো বলবে ও সব কথায় মনটা শুধু দুঃখে ভঁরে যায়।আমি বলবো,ঠিক তা না,পুরোনো কথায় মনে আসে জীবনের স্বপ্ন হেরে যাওয়ার গল্প,বলে দেয় আমাদের অনুমতি নিয়ে কেউ কোন পথ দেখায় না।জীবনে আমরা শুধু সুখ খুঁজে যাই,সবকিছু একপাশে ছেড়ে ছুটি সুখের আকাশে।একটু দুর্গম পথ হেটে যাওয়ার পর,আসে ভেঙ্গে পড়া আরও কটা পথ।
আলোর বন্যা ছুটে আসছে আমার পৃথিবীতে,আর কোন নিয়ম মানা না,শুধু নিজেকে খুঁজে যাওয়া।কাউকে কিছু বোঝানোর দরকার নাই,সময় সবকিছুর জায়গা করে দিবে।একটু শীত যদিও,তবুও আমরা বাইরে বসবো,যাতে জেকবের সিগারেট খাওয়ার অসুবিধা না হয়।
কথা হতে পারে অন্যান্য গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে,বিধাতার অস্তিত্ব নিয়েও কিছু তর্কও হবে।বিশ্বাস,অলৌকিকতা আর যোগাযোগ,ভাগ্য-জীবনের ওঠানামা নিয়ে কথা হবে।হয়তো বিজ্ঞান আর ধর্মের যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা করতে পারি।ভালবাসা যেমন মানুষকে নিয়ে যায় স্বর্গে,আবার তছনছও করে দিতে পারে মানুষের জীবন।এমনও হতে পারে জেকব হয়তো বলবে,হতাশা সমন্ধে আমার ধারণাটা সম্পুর্ন ভুল,কোন কিছু না বলাটাই ঠিক হবে সে সময়।আমরা ফুল নিয়ে কথা বলতে পারি,বারের পাশে সাজানো ফুলের তোড়া হয়তো আনা কোন ফার্মের বাগান থেকে।শরতে ফুল নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে ভালই লাগে,তাতে আছে বসন্তের রঙ্গীন সাজের স্বপ্ন।সব দেয়ালগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে,আর আমি নতুন এক মানুষ হয়ে জন্ম নিচ্ছি।)
জেকব আলতো করে গালে তিনটা চুমু দিয়ে জানতে চাইলো কেমন আছি,অন্যান্য দেশে দুটো চুমু খাওয়াটাই নিয়ম।জেকব ওয়েটারকে বাইরে বসার আয়োজনের কথা বললো,তার চোখেমুখে বেশ কিছুটা ভঁয়।আমি গরম চা এর অর্ডার দিলাম আর জেকব চাইলো কামপারি।
জেকবের ভয় কাটানোর জন্যে,গাছপালা,প্রকৃতি,শরতের সৌন্দর্য নিয়ে আলাপ আরম্ভ করলাম।জানি না,কেন যে আমরা সমস্যা এড়ানোর চেষ্টা করি-সামনের সমস্যাকে না এড়িয়ে,সেটার সমাধান করাটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ।ভঁয়টা কাটেনি তার,আমার কাছে এটা একটা বিশেষ দিন,অন্ততঃ এ দিন জেকবকে আমাকে কিছুটা প্রাধান্য দেয়া উচিত।
মনের এলোমেলো কথা সব বলে যাচ্ছিলাম,হাজারো কথার জোয়ার আমার মনে।
জেকবকে জিজ্ঞাসা করলাম পোষা জন্তূদের কথা,কেন মানুষের এত ভালবাসা তাদের পোষা জন্তূর জন্যে?জেকব অন্য কিছু বলা আরম্ভ করলো,আমি কেন মেনে নিচ্ছি না,সব মানুষ এক না।কেন এত আইন কানুন করে আমরা সমাজের সবকিছু বদলে দিতে চাচ্ছি,যে যেমন ভাবে আছে সেটা কেন মেনে নেই না,আমরা।রাজনীতির কথায়,ক্লান্ত হয়ে গেছে জেকব রাজনীতির আঙ্গিনায়,ওগুলো নিয়ে কথা বলার কোন ইচ্ছা ছিল না তার।
ছেলেমেয়েদের স্কুলের একুরিয়ামের গল্প আরম্ভ করলাম,একটা মাছ একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে একুরিয়ামে।মনে নেই তার কোথায় আরম্ভ করেছে,কোথায় শেষ হবে তার যাত্রা।এ জন্যেই আমরা একুরিয়ামের মাছ দেখতে ভালবাসি,ওরা অনেকটা আমাদের অস্তিত্বের কথা বলে দেয়,আটকে থাকা একটা কাঁচের দেয়াল ঘরে খাওয়াদাওয়া ঘুমানো,ওটাই জীবন।
সিগারেট ধরালো জেকব,এশট্রেতে তার শেষ করা দুটো সিগারেট।মনে হলো জেকবকে কোন কিছু বলার সূযোগ না দিয়ে আমিই শুধু বকবক করে যাচ্ছি।জানি না জেকব কি বলতে চাচ্ছে?
“ঐ যে ছবিটার কথা তুমি বললে”,বেশ সর্তকতার সাথে বললো জেকব।
সেই ছবি,অবশ্যই একটা ছবি আছে।ছবিটা আছে আমার মনের খাতায়,উপরের ঐ সর্বশক্তিমান ছাড়া কেউ কি মুছে দিতে পারবে সেটা।তুমি বুঝতে পারছো,ধীরে ধীরে আমি তোমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।এখন বলো না,পথটা তোমার অজানা-এ পথে অনেকবারই হয়তো যাওয়া আসা তোমার।আমরা একই পথে ছুটে যাচ্ছি দুজন-ভয় পেও না আমার হাত থাকবে তোমার হাতে।
জেকব আমার হাতটা নিয়ে বললো, “দেখ আমাদের বয়স হয়ে গেছে,এখন কৈশোরে নেই আমরা আর,তুমি একজন নামকরা সাংবাদিক,সুন্দর একটা সংসার আছে,নিঃসন্দেহে তুমি অনেকের ঈর্ষার কারণ।কেন তুমি তোমার জীবনটাকে তছনছ করতে চাচ্ছ?কোন মানসিক চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে পার,আমি জানি তারা তোমাকে অনেক সাহায্য করতে পারবে”।
নিজেকে হারিয়ে ফেললাম আবার হতাশায়,উঠে হেঁটে গেলাম,গাড়ীর দিকে।চোখে কান্না ছিল না,কোন দীর্ঘশ্বাস ছিল না,আর পেছনে ফিরে তাকায় নি,হেঁটে গেলাম আমার চলার পথে।
অনুভুতি হারানো আমি,গাড়ীতে বসে ভাবছি,কোথায় যাব,কি করবো কিছুই জানা নেই,
হতবুদ্ধি নতুন আরেকজন।কেউ অপেক্ষা করে নেই এই পথের শেষে,হতাশাই শুধু এখন আমার চলার সাথী,কোনরকমে গড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে।এলোমেলো মিনিট পাঁচেক পর,আমি এক কেল্লার বাইরে এসে পৌছালাম,প্রানহীন এক দানব।জানি না,কেউ যেন প্রান ফিরিয়ে দিবে এই দানবের শরীরে।
কেল্লার বাগানের গেটটা বন্ধ,তবে তাতে কি যায় আসে?আমি গাছে উঠেও যেতে পারি ভেতরে,একপাশে রাখা বেঞ্চে বসে ভাবছিলাম ১৮১৭ সালের ঘটনাটা।সবকিছু একপাশে ছুঁড়ে মনটাকে নিয়ে যেতে হবে অন্য কোনদিকে।
ভাবছিলাম,যখন কবি লর্ড বাইরনের এই কেল্লার নির্বাসনের সময়।শুধু তার দেশ ইংল্যান্ডে না,সুইজারল্যান্ডেও লর্ড বাইরন তখন অপ্রিয়তার চরমে।সকলের অভিযোগ লোকজনের মাঝে মাতাল হয়ে মেয়ে,এমন কি কিশোরদের সাথে তার নোংরা কামুক যৌন ব্যাবহারের কথা।নিশ্চয় একাকীত্বে বা হতাশায় সময় কাটানোর কোন উপায় ছিল না তার।
১৮১৭ এর একটা দিনে,কবি শেলী,শেলীর বৌ মেরী আর তাদের এক বন্ধু ইংল্যান্ড থেকে এই কেল্লায় লর্ড বাইরনের সাথে দেখা করতে আসে।নিশ্চয় তাদের আলোচনা ছিল সাহিত্য,কবিতা নিয়ে,হয়তো অভিযোগ ছিল তাদের জেনেভার শীত,বৃষ্টি,বাতাসের প্রচন্ডতা নিয়ে-হয়তো তাদের অভিযোগ ছিল এখানে চা হুইস্কির অভাব নিয়ে।কথায় কথায় বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে-বাজী ধরলো সবাই কেল্লাতে কবিতা লিখবে,তারপর বাইরন সহ ফিরে যাবে লন্ডনে,বের হবে তাদের নতুন কবিতার বই।
সময়ে সবাই ভুলে গেল বাজীর কথা,ওটা তো শুধু সময়ের মাতলামি।যদিও মেরী উপস্থিত ছিল সেই আলাপে,তবু শেলী,বাইরন তাকে আমন্ত্রন জানায়নি লেখার বাজীতে অংশ নেয়ার জন্যে,কেন না মেরী শুধু মেয়ে না,বয়সও বেশ কম।মেরীও তো সময় কাটানোর জন্যে একটা কি লিখতে পারতো না?তার সামনে বিষয় তো একটা ছিলই,সেটাকে সাজিয়ে নিয়ে সে কিছু একটা লিখেছিল,তবে প্রকাশ করার ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ ছিল না তার।
ইংল্যান্ডে মেরীর লেখা পড়ে শেলী সেটা প্রকাশ করার প্রস্তাব দিল,শেলী বেশ নামকরা একজন কবি,তার প্রভাব কম ছিল না প্রকাশকদের কাছে।প্রথমে মেরী বাঁধা দিলেও,নিজের নাম ছাড়া প্রকাশ করতে রাজী হলো।অবাক ব্যাপার এটাই,প্রকাশ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বই এর সব কপিগুলোই বিক্রি হয়ে গেল।যাদের জানা ছিল, তাদের কাছে মনে হলো শেলীর নামটাই বইটার সার্থকতার।দ্বিতীয় সংষ্করনে মেরী নিজের নাম দিয়েই বইটা প্রকাশ করলো,
অবাক ব্যাপার এই যে বইটার সার্থকতা কোন অংশে কমেনি,তাতে।
আজও সেই লেখা মানুষের মনে দাগ কাটে,অনেক সমালোচকের মতে, “গত দুশ বছরের আবেগ,ভালবাসা নিয়ে লেখাগুলোর মধ্যে বইটা অবশ্যই প্রথম সারিতে”।যদিও বেশীর ভাগ লোকের বইটার নাম জানা,তবে অনেকের পড়া নেই বইটা।
ভিক্টর নামের এক সুইস বিজ্ঞানীকে নিয়ে লেখা গল্পটা,যে বড় হয় তার পিতামহের সাথে। বজ্রপাত দেখে তার ধারণা হলো সে মৃত মানুষকে ব্জ্রপাতের সাহায্যে নতুন জীবন দেয়া সম্ভব।আরম্ভ হলো তার অভিযান।অনেকটা যেন গ্রীক পৌরানিক কাহিনীর প্রমিথুয়ুসের স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে আনার অভিযান,আর এখানে প্রমিথুয়ুস আধুনিক চেহারায় সাধারণ একটা মানুষ।বইটার নাম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।
জানি না,কি সব আজে বাজে কথা ভাবছি আমি।শেলীর সাথে মেরীর প্রথম দেখা তার বয়স তখন বয়স বছর পনের,তা ছাড়া শেলী তখন বিবাহিত,তবুও সমাজ সামাজিকতাকে আঙ্গুল দিয়ে মেরী ছুটে গেল ভালবাসার মানুষের কাছে।পনের বছর বয়স,তবু অজানা ছিল না চাওয়াগুলো,অজানা ছিল না তার স্বপ্নের আকাশে ছুটে যাওয়ার পথটা।আমি তো তিরিশ পেরোনো,তবু ঘন্টায় ঘন্টায় বদলায় আমার চাওয়ার সুর আর স্বপ্নের আকাশে পৌঁছানো তো দূরের কথা…শরতের আবেগে হেঁটে যেতে পারি অনায়েসে,আর সাজিয়ে কথা বলতেও খুব একটা অসুবিধা হয় না।কিন্ত আমি তো মেরী শেলী না,আমি ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন যে ব্যাস্ত তার দানবকে নিয়ে।
আমি জীবন ফেরাতে চাই,জীবন ছেড়ে যাওয়া শরীরে,ফলাফলটাও একই হবে ধ্বংস আর ভঁয়ের এক চেহারা।আর চোখের জল না,আর হতাশার সুর না।আমার মনটা হেঁটে এক চরম যন্ত্রনার মাঝে,আর নড়াচড়া করতে পারছি না,আমি।শরত,তাই সন্ধ্যাটাও ছুটে আসে বেশ তাড়াতাড়ি,সুর্যাস্ত সরানো গোধুলির সাঁজ।এখনও বসে আছি,দেখছি দূর্গের উনবিংশ শতাব্দীর জেনেভার ধনীদের চেহারা।কোথায় সেই বজ্রপাত ফেরাবে জীবন এই দানবের শরীরে?কোন বজ্রপাত এলো না,ঐ নীল আকাশ থেকে।গাড়ীঘোড়া কমে আসছে,ছেলেমেয়েরা,স্বামী অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে,দেরী হলে তারাও চিন্তিত হয়ে পড়বে।কিন্ত আমার পা দুটো যেন শেকলে বাঁধা,নড়তে পারছি না আর,আমি পরাজিত একজন।
কেউ কি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে,এই অস্বাভাবিক একটা চিন্তায় ভাসিয়ে দেয়ার জন্যে।জানি হবে না সেটা,বিধাতার খাতায় ভালবাসা অসম্ভব কিছু একটা,প্রয়োজনে সেটা যায় না দেখা।এমন কি ঈশ্বরের যীশুকে আমাদের মাঝে পাঠানোর কারন,কি ভাবে ভালবাসার ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রন তার চাঁদ,সূর্য,নক্ষত্রের।করিনিথিয়ানদের কাছে লেখা একটা চিঠিতে সেইন্ট পলের যীশুর কথার উদ্ধৃতি আছেঃ
আমি মানুষের ভাষায় কথা বলছি কেন,এজন্যেই যাতে আমাকে মনে না হয়
শুধু একটা শব্দ।
আমরা জানি,পৃথিবীতে অনেক কথা,অনেক চিন্তাধারা ছিল,আছে যার বদলে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল এ পৃথিবীকে,কিন্ত তাদের বলার ভাষায় ছিল না আবেগ,ছিল না ভালবাসার উচ্ছাস।
যতই যুক্তি থাকুক না কথায় সেটা ছুঁয়ে যায় না আমাদের মন,যদি না থাকে ভালবাসার সুর।পলের তুলনা দেখানো ভালবাসার সাথে ভবিষৎ বানীর,তুলনা সেই রহস্যময় রাজ্যের,বিশ্বাসের সাথে,ত্যাগের সাথে।
বিশ্বাসের চেয়ে ভালবাসায় মানুষহের আস্থা যে অনেক বেশী।হয়তো এ কারণেই যে বিশ্বাস শুধু পথটা যা পৌঁছে দেয় আমাদের ভালবাসার সেই আকাঙ্খিত দেশে।আর ত্যাগ ভালবাসার ছোট্ট একটা অংশ,সম্পুর্ন চেহারা না।ভালবাসা মানুষের পৃথিবীকে বড় করে দেয়।
০০০০০০০০০০
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২২ রাত ১২:৪০