somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৩:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা

(৩৭)

আলেকজান্দারের কোলে সম্রাট দারিয়ুসের যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু,বেহরাম গুর রাশিয়ান রাজকুমারীর সাথে অন্দরমহলের ছবি,সিয়াভুষ কালো ঘোড়ায় চড়ে আগুনের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে,নিজের ছেলের হাতে হুসরেভের নির্মম ভাবে খুনের পর জানাজার দৃশ্য।পান্ডুলিপিগুলো এক এক করে দেখে ওস্তাদ ওসমান একপাশে রাখছিল,তার চেনা দু একজন শিল্পিকে দেখে মাঝে মাঝে তাদের ছবি নিয়ে দু একটা মন্তব্যও করলো ওস্তাদ ওসমান,শিল্পীর কায়দা করে নিজের নামটা ফুলের ঝোপে লেখা নিয়েও কিছু একটা বললো।

বই এর নাম বা শেষ পাতাটা দেখে দেখে ওস্তাদ ওসমান মন্তব্য করছিল,কোন ছবিটা কার ছবি থেকে নকল করা।কোন কোন বইটা ওস্তাদ আবার বারে বারে দেখছিল কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার আশায়,কোন কথা,আলাপআলোচনা ছিল না,শুধু নিস্তব্ধতা আর বই এর পাতা উল্টানোর শব্দ।মাঝে মাঝে ওস্তাদ ওসমান চীৎকার করে বলছিল, ‘উহ,আহ’,ওস্তাদ ওসমানের উত্তেজিত হওয়ার কারণটা আমি বুঝি নি।আবার কোন একসময় ওস্তাদ ওসমান বিশেষ একটা ছবি ধরে বলছিল,ঐ ছবিটাই দেখা যাবে,একেবারে সম্পূর্ন ভিন্ন ধরণের আরেকটা গল্পে।একই ছবি তৈমুর লংএর ছেলে শাহ রেজার সময়ের নিজামীর কবিতার বই এ,আবার সেই ছবি তাব্রিজের বই এ বছর ষাট,সত্তর আগে।ওস্তাদ ওসমানের প্রশ্ন করলো,দুজন শিল্পী কোনদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি যাদের একই ছবি আঁকলো কি ভাবে,উত্তরটাও দিল ওস্তাদ ওসমানের,‘ছবি আঁকা আর মনের কথা বলা একই জিনিষ’।

পান্ডুলিপি দেখে মাঝে মাঝে দুঃখে হাতে মুখ ঢাকছিল ওস্তাদ ওসমান,ও ধরণের অভাবনীয় ছবি আঁকার প্রতিভা হারিয়ে গেছে,আবার কোন কোন ছবি আঁকার ধরণটা দেখে হতাশায় মুখ ঢাকছিল ওস্তাদ।ওস্তাদ ওসমান দেখাচ্ছিল শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত গাছপালা,ছাতা,
ফেরেশতা,বাঘ,তাঁবু,ড্রাগন,মনমরা শাহজাদার ছবি।আল্লাহর পৃথিবী ভঁরা সৌন্দর্যে,সেই সৌন্দর্যের ছোঁয়াচ ছড়ানো জগতটার কিছুটা ফুটে উঠতো শিল্পীদের অনুভুতিতে,শিল্পীদের তুলির ছোঁয়ায় ফুটে উঠতো সেই বেহেশতী সুর,অন্ধ না হওয়া পর্যন্ত শিল্পীরা তুলির টানে এঁকে যেত অন্তরের আল্লাহর সৃষ্টির অভাবনীয় সৌর্ন্দয।ছবিগুলো মানুষের মনকে নিয়ে যেত স্মৃতিমধুর আকাশে,তবে দুঃখের সাথে বলতেই হয় যুগে যুগের নামকরা শিল্পীরা অন্ধ হওয়া পর্যন্ত যা এঁকে গেছে তুলির ছোঁয়ায়,সে গুলো তো স্বর্গীয় অনুভুতি থেকে অনেক দূরে ছুটে যাওয়া দৃশ্য।ও ভাবেই ওস্তাদরা এঁকে গেছে,গাছ,পাখী,শাহজাদার হাম্মামে গোসল করার দৃশ্য,
জানালার ধারে হতাশ যুবতী,যদিও কোনদিন দেখার সূযোগ হয়নি তাদের।
খাজাঞ্চীখানার আলমারিতে শাহ তামাসপের সুলতানের দাদার কাছে পাঠানো বইগুলোর কোনটাই ছিল না।
‘অনেক সময়,পাখীর ডানা,গাছের পাতা,ভেসে যাওয়া মেঘ,অজানা যুবতীর মিষ্টি হাসি,শত শত বছর ধরে আঁটকে আছে শিল্পীর তুলিতে,ওস্তাদ থেকে শিষ্যতে।ওস্তাদের ছবি আঁকার বিশেষত্ব শিখে শিল্পী অনেকটা পবিত্র কোরাণের লেখার মতই সেটা অমর করে রাখে তার মনের খাতায়,কিন্ত ভুলে না যাওয়া আর ছবিতে তুলে ধরা দুটো তো এক কথা না। ওস্তাদদের ছবি আঁকার কায়দা,ক্ষমতাসীন সুলতানের আদর্শ,চিন্তাধারা সবকিছু নিয়ে শিল্পীর ঐ পাখীর ডানা,মেয়েটার হাসি-‘।
‘ বা ঘোড়ার নাক’।
‘-হ্যা,ঘোড়ার নাক’,বিচলিত না হয়ে উত্তর দিল ওস্তাদ ওসমান, ‘হয়তো যা তার মনের খাতায় আঁটকে আছে তা না,বরং সঙ্গী শিল্পীদের প্রভাবও ছিল,এখন বুঝতে পারছো’?

নিজামীর হুসরেভ আর শিরিনের আরেকটা বই এ যেখানে শিরিন সিংহাসনে বসে আছে,ওস্তাদ ওসমান প্রাসাদের দেয়ালে লেখাটা পড়া আরম্ভ করলো, ‘মহান আল্লাহ যেন জয়ী তৈমুর লং এর ছেলের ক্ষমতা রক্ষা করে,আমাদের খান যে বুদ্ধি,বিচারে অতুলনীয়,যেন রক্ষা করে তার রাজত্ব।(বামদিকের দেয়ালে লেখা) আর সবসময় যেন তাকে সুস্থ,প্রাচুর্যতায় ভঁরা রাখে(ডানদিকের পাথরে লেখা)।
এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় খুঁজে পাব আমরা সেই ঘোড়ার নাক,যা শিল্পীর স্মৃতিতে আঁকা’?
‘আমাদের খুঁজে বের করতে হবে শাহ তামাসপ উপহার হিসাবে পাঠানো বইগুলো’,ওস্তাদ ওসমান বললো, ‘আমাদের ফিরে যেতে হবে পুরোনো দিনে,যখন শিল্পীর হাতে ছিল আল্লাহর নেয়ামত,আরও অনেক বই খুঁজে দেখতে হবে’।
কেন জানি মনে হলো,ওস্তাদ ওসমানের কোন ইচ্ছা নাই বিশেষ ভাবে আঁকা নাকের ঘোড়াকে খুঁজে বের করতে,বরং ওস্তাদ যেন ব্যাস্ত হয়ে ছিল,খাজাঞ্চীখানার বই,ছবি দেখার সূযোগের জন্যে।আমি অধৈর্য হয়ে গেছি তখন,মনটা অস্থির হয়ে ছিল সেকুরের শারীরিক সঙ্গ পাওয়ার আশায়,আর কত অপেক্ষা।খাজঞ্চীখানার বামনের সাথে একের পর এক বাক্স খুলে আমরা ভেতরের বই,ছবিগুলো দেখছিলাম।বেশ অস্থির হয়ে গেছি তখন,্তেম্ন কোন তফাৎ চোখে পড়ছিল না,আর।আবার যেন দেখতে না হয় হুসরেভকে শিরিনের জানালায় ঘোড়ার নাকের কোন ছবি ছাড়া,ইচ্ছে হচ্ছিল খাজাঞ্চীখানার এই ঘরটার সব দামী পোষাক,অলঙ্কার একপাশে ছুঁড়ে ফেলে ছুটে যাই পাশের ঘরটাতে।মাঝে মাঝে ওস্তাদ ওসমান হাতের ইঙ্গিতে,না হয় চীৎকার বলছিল,নতুন কোন বই না হয় আরেকটা ঘোড়ার ছবির কথা।ওস্তাদ ওসমানের হাতের ছবিটা উঁকি মেরে দেখছিলাম,বিজয়ী সুলতান মেহমুদের সময়ের,ও ধরণের ছবি কোনদিন চোখে পড়েনি,শয়তান চুপিচুপি হযরত নূহের জাহাজে উঠে যাচ্ছে।
কয়েক শত ছবি ছিল শাহ,সুলতান,খান,রাজা,বাদশাহদের-তৈমুর লং এর সময় থেকে শুরু করে মহান সুলতান সুলায়মানের সময় পর্যন্ত,হরিণ,সিংহ এমন কি খরগোস শিকারের ছবিও বাদ পড়েনি।একটা ছবিতে শয়তানও লজ্জায় নিজের আঙ্গুলে কামড় দিচ্ছে,যখন কেউ একজন কাঠের উপর দাঁড়িয়ে উটের সাথে সঙ্গম করছে।একটা বই এ আরব দেশ থেকে এক ব্যাবসায়ী রুপকথার কাল্পনিক পাখীর পিঠে চড়ে সমুদ্র পার হচ্ছে।

আরেকটা বই এ প্রথম পাতায় ছিল সেকুরের খুবই প্রিয় ছবিটা,গাছে ঝোলানো হুসরভের ছবি দেখে শিরিন প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার দৃশ্য।ঘড়ির ছবি যেখানে ববিন,লোহার বল,ডাক দেয়া পাখীসহ পুরো ঘড়িটা বিস্তারিত তুলে ধরা,সাথে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা কয়েকটা মুর্তি।জানি না এভাবে কতগুলো বই আর ছবি দেখলাম,মনে হচ্ছিল ছবির পাতায় আঁটকে থাকা সময়ের চাকায় নতুন করে ফিরে যাচ্ছিলাম পুরোনোতে।শিল্পীদের রং এর চীৎকারে শাহ,বাদশাহ,রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আঁকা ঐ ছবিগুলোঃশিরস্ত্রান,মনিমুক্তা ভঁরা চাকু,চীনের সিরামিকের কাপ,মুক্তায় সাজানো বাঁশী,বসার তোষক,সব কিছুই শিল্পীর তুলিতে প্রানবন্ত হয়ে আছে।

‘এখন বুঝতে পারছি,একই ছবি বারে বারে আঁকা হলেও,ওর মধ্যেই ওস্তাদ শিল্পিরা তাদের সময়ের চারপাশটা নিপুন ছোঁয়ায় এঁকে ধরতে কার্পন্য করেনি’,ওস্তাদ ওসমান বললো।
ঠিক বুঝতে পারলাম না ওস্তাদ ওসমানের কথা,তবে গত দু শত বছরে আঁকা বুখারা থেকে হেরাত,বাগদাদ থেকে তাব্রিজ হয়ে ইস্তাম্বুলের ছবিতে ঘোড়ার নাক ছাড়া অনেক কিছুই দেখার সুযোগ হলো আমাদের।শিল্পীদের হতাশা,বিষাদ এক এক করে ফুটে উঠছিল আমাদের চোখে।

মাগরেবের নামাজের পর খাজাঞ্চীখানার দরজা খোলার সময় ওস্তাদ ওসমান বললো,
অন্ধকারে মোমবাতি আর তেলের বাতিতে বই আর ছবিগুলো পরখ করতে করতে হয়তো ভোর হয়ে যাবে,আমি তার সাথে সময়টা কাটাবো এটা জানালাম।দরজা খোলার পর ওস্তাদ ওসমান প্রধান খাজাঞ্চীকে খবরটা বলে পাঠালো,মনে হলো কাজটা ঠিক করিনি।সেকুরের জন্যে বাড়ীতে ফিরে যাওয়া দরকার ছিল,আরও খারাপ লাগছিল চিন্তা করে ছেলে দুজনকে নিয়ে কি ভাবে অস্থির হয়ে থাকবে সেকুরে সারা রাতটা,জানালার নতুন খিড়কি লাগাতে হয়তো তার কত না কষ্ট হবে।

খাজাঞ্চীখানার দরজার ফাঁক দিয়ে প্রাসাদের আঙ্গিনার গাছটা চোখে পড়ছিল,কিছুটা কুয়াশার ছাপ চারপাশে,প্রাসাদের বাইরে দাঁড়ানো প্রহরী দুজন ইঙ্গিতে কথাবার্তা বলছিল যেন মহামান্য সুলতানের শান্তিতে কোন ব্যাঘাত না হয়,অজানা এক দোষে আমার মনটা ছেয়ে ছিল।

আমরা-দুই দরবেশ

গুজবে শোনা যায়,চীন,সমরখন্দ,বোখারা থেকে সুলতান,তার পূর্বপুরুষদের আনা খাজাঞ্চীখানার বিশেষ জায়গায় লুকানো বই এর,কোন একটাতে আছে আমাদের ছবি,বই ছবিগুলোর রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব ছিল বামন জেজমী আগার হাতে।আমরা যদি আমাদের কথা নিজেদের মত করে সাজিয়ে বলি,মহান আল্লাহ নিশ্চয় আমাদের সাথে থাকবেন,আর এই কফির দোকানের শ্রোতারাও সেটাকে অন্যায় মনে করবে না।

প্রায় দেড়শ বছর হয়ে গেল আমরা চলে গেছি বানানো কথা আর ছলনার আশ্রয় এই পৃথিবীর পারসী দরবেশদের আখড়া থেকে-তবে আমরা এখন আবার তোমাদের সামনে হাজির হয়ে গেছি।কিন্ত এটা কি ভাবে সম্ভব হলো?ঠিক আছে আমি বলছি,কি ভাবে সেটা সম্ভব হলোঃআমাদের তুলে ধরা হলো ভেনিসের ছবি আঁকার নিয়মে,এখানে যে ভাবে আমরা দুই দরবেশ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম,সুলতানের রাজত্বে-এক শহর থেকে আরেক শহরে।

খালি পা,মাথায় চুল ছিল না আমাদের,কাপড়চোপড় বলতে অর্ধেকটা শরীরে কিছুই থাকতো না;হরিনের চামড়া দিয়ে গায়ের কিছুটা অংশ ঢাকা,কোমরে বেল্ট,হাতে লাঠি,এটাই আমাদের চেহারা।গলায় ভিক্ষার বাটি;একজনের হাতে কুড়াল,আরেকজনের সাথে খাবারের থালা,চামচ,
যখন যেখানে আল্লাহ রুজী দেয় বসে খাওয়ার প্রস্ততি ছিল আমাদের।

আমরা ঝর্নার পাশে একটা কাফেলার সাথে দাঁড়িয়ে আছি;প্রিয় বন্ধুরা,প্রিয়জনেরা,না আমার ভায়েরা,আমরা তর্কবির্তকে যোগ দিলাম, ‘ঠিক আছে তুমিই বল,না না তুমি’।একজন আরেকজনের সাথে বাদানুবাদে ব্যাস্ত,ছবি আঁকার জন্যে সোনার মোহর দিয়ে কি খাওয়া যায় সেটাই ছিল চিন্তা্র বিষয়।খোলামেলা ভাবে কথা বলছিল লোকটা,কিছুটা বিদঘুটে চরিত্রের যদিও।আমাদের ছবি আঁকা হলো সুলতানের তাঁবুতে,অর্ধেক নগ্ন দুটো চেহারা দেখে,আমার সাথীকে বললাম-ছবিতে দুজন দরবেশের ছবি হিসেবে তুলে ধরলে হয়তো মানানসই হতো।অবশ্য তার জন্যে আমাদের চোখের মনিটা সরিয়ে সাদা অংশটা সামনে আনতে হবে,অনেকটা অন্ধ লোকের মত।

ওটা তো দরবেশদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ সারা পৃথিবীকে ধরে রাখতে পারে মনের খাতায়,
আমাদের মাথা ভর্তি গাঁজার আমেজ ছাড়া আর কিইবা আছে।আমাদের চিন্তাধারাটাও ঐ শিল্পীর চেয়ে অনেকটা উদার আর প্রগতিশীল।এর মধ্যে বাইরে বেশ হৈচৈ আরম্ভ হয়ে গেছে,আমরা হোজা এফেন্দীর চীৎকার,কথা শুনতে পাচ্ছিলাম,দোয়া কর সবাই,কারও মনে যেন কোন ভুল ধারণা যেন না জন্মায়।

আমরা সম্মানিত হোজা এফেন্দীর কথা বললাম,গত সপ্তাহে অবশ্য এ ভাবেই ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।আমরা সম্মানিত ‘হোজা এফেন্দীর’ কথা বলছি,যার সাথে ইরজুরুমের সম্মানিত, ‘নুসরত হোজার’ সাথে কোন সর্ম্পক নেই,কোন সর্ম্পক নেই যার ঐ হারামজাদা হুসরাত হোজার সাথে,এমন কি ঐ সিভাসের হোজা,যার আঁতাত শয়তানের সাথে।
যারা সবকিছু নোংরা ভাবে সাজাতে চায়,তাদের কথা মহামান্য হোজা এফেন্দীকে নিয়ে কোন গল্পকার যদি আজেবাজে কিছু বলে,তবে লোকজন আছে যারা শুধু তার জিভ না,মাথাও কেটে ফেলে দিবে মাটিতে।একশত বিশ বছর যখন এ রকমের কফির দোকানের কোন চলন ছিল না,আমরা যে মহামান্য হোজার কথা বলছি,রাগে তার মাথা সবসময় গরম থাকতো।
‘শোন কাফের ফ্রাঙ্ক,কেন তুমি ঐ দুজনের ছবি আঁকছো?ছেঁড়া কাপড়ের ঐ লোকগুলো ভন্ড দরবেশ,মানুষের কাছে শুধু ভিক্ষা করে বেড়ায়,দোয়াদরুদ সমন্ধে কিছুই জানা নেই ওদের, বাড়ীঘর,মানুষদের চালচলন সমন্ধেও কিছু জানে না,শুধু খাওয়া আর গাঁজা টানা ওদের জীবন-সংসারের জঞ্জাল ওরা।কেন ওদের ছবি আঁকছো,আমাদের এই সুন্দর দেশে আর কিছু চোখে পড়েনি তোমার?তুমি কি আমাদের দেশের খারাপ একটা চেহারা তুলে ধরতে চাচ্ছ’?

‘না,না,তা ঠিক না,কথাটা এই যে মানুষের অন্ধকার,নোংরা চেহারার ছবঙ্গি সবাইকে আর্কষন করে বেশী,আর বেশী পয়সাও পাওয়া যায়’,অবিশ্বাসী,কাফের মন্তব্য করলো।আমরা দুই দরবেশ তো লোকটার মন্তব্য শুনে অবাক হয়ে গেলাম।
‘তা টাকাপয়সা পেলেই কি তুমি শয়তানকে একটা ভাল চরিত্র হিসাবে তুলে ধরবে’?প্রশ্ন করলো হোজা এফেন্দী,একটা তর্কবিতর্ক শুরু করার জন্যে।ছবিটা দেখে শুধু ভেনিসের শিল্পীর প্রতিভা বোঝা যায় না,হোজার যুক্তিটা যে কত অযৌক্তিক সেটাও প্রমান হয়।ভেনিসের লোকটা আমাদের ছবি আঁকার পর ঘোড়ার জিনে লুকিয়ে নিয়ে গেল কাফেরদের দেশে। কিছুদিন পর ওটোমান সৈন্যরা যখন দানিয়ুব নদীর পাশের শহরটা দখল করে তছনছ করলো,আমরা ফিরে গেলাম আবার ইস্তাম্বুলে,সুলতানের খাজাঞ্চীখানায়।তারপর একের পর এক নকল হলো আমাদের ছবি বই থেকে বইএ,এখন কফির দোকানে নতুন জীবন নিয়ে বসে আছি আমরা।তা হলে আমাদেরঃ

ছবি,মৃত্যু আর পৃথিবীতে আমাদের স্থান।

হোজা এফেন্দী যার কথা আমরা বলছি,তার বাড়ী কোনিয়ায়,খুতবায় বলত,যা লেখাতেও পাওয়া যায়,ফকির দরবেশরা সবাই ভন্ড ছাড়া আর কিছু না।হোজা এফেন্দীর মতে মানুষকে ভাগ করা যায় চারটা দলে,
১)খ্যাতনামা লোকজন
২)ব্যাবসায়ী
৩)কৃষক,চাষী
৪)শিল্পী; আর এই ফকির দরবেশরা বলা যায় অনেকটা সমাজের বাড়তি চরিত্র।

হোজা এফেন্দী,দুই দরবেশের ছবি দেখে মন্তব্য করলো,ওরা ঝগড়া করছে একটা চামচ দু জনের কাছে,কে আগে খাবে আর কে পরে,আর অনেকেই জানে না,যে এটা শুধু তাদের চালাকী তাদের আসল উদ্দেশ্য ঢেকে রাখার জন্যে।তবে ঐ হোজার মতে,এই সুন্দর চেহারার ছেলেরা,শিল্পী,তাদের শিষ্য সবাই জড়িত একই ভনিতার খেলায়।


আসল রহস্যটা

আসলে কথা এই যেঃকাফের লোকটা ছবি আঁকার সময় এত সম্মান আর ধৈর্য নিয়ে আমাদেরকে দেখছিল,তার তুলি দিয়ে আমাদের চেহারা আঁকক্তার কাছে ছিল একটা গর্বের বিষয়।তবে লোকটা একটা ভুল করছিল,ছবিটা আঁকছিল ওর খালি চোখে দেখা দিয়ে
আমাদের ছবিটাও আঁকলো এমন যে আমরা যেন অন্ধ,তবে ওটা তো ভুল আমাদের দেখার চোখ আছে,যদিও অন্ধ হিসেবে দেখানোতে আমাদের কোন আপত্তি ছিল না।হোজার মতে আমাদের জায়গা আর কোথাও না,একেবারে নরকে,অনেক কাফেরদের কাছে আমরা পচে যাওয়া লাশ,আর জ্ঞানী,বুদ্ধিমান শিল্পী-তোমাদের কাছে আমরা জীবিত দুই ফকির ঐ ছবিতে।সম্মানিত হোজা এফেন্দীর সাথে দেখা হওয়ার পর,আমরা তিনদিনে হেঁটে গেলাম কোনিয়া থেকে সিভাসে,ভিক্ষা করে এক এক করে আটটা গ্রাম দিয়ে।একটা রাতে এতই ঠান্ডা ছিল যে আমরা একজন আরেকজনকে ধরে শুয়ে ছিলাম,তবুও রক্ষা হয়নি,ঘুমে ঠান্ডায় জমে আমাদের মৃত্যু হলো।মৃত্যুর আগে আগে স্বপ্ন দেখলাম,কয়েক হাজার বছর পরে বেহেশতের একটা ছবিতে দেখা যাবে আমাদের চেহারা।


এটা আমি,ওস্তাদ ওসমান

অনেকেই বোখারার এই গল্পটা বলে যা আবদুল্লাহ খানের সময়ের কথা,উজবেকের শাসক আবদুল্লাহ খান সমন্ধে বলার তেমন কিছু নাই,তবে তার আদেশ মত শিল্পীরা কোন ছবি নকল করতো না,যাতে কোন ছবির খুঁতটার উদ্ভব কোথায় থেকে সেটা জানা যাবে না সহজে।তাতে অলস শিল্পীরা আল্লাহর দেয়া অর্ন্তদৃষ্টি ব্যাবহার না করে চোখে দেখা যা আছে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করতো।হয়তো এ কারণেই উজবেক খান আমন্ত্রন জানালো দক্ষিনের সিরাজের এক শিল্পীকে আর উত্তর দিকের সমরখন্দ শহরের আরেকজন শিল্পীকে,আর দুজনকে প্রাসাদের দুদিকে দুটো ছোট ঘর দিল থাকার জন্যে।তবে ঐ দুজন শিল্পীর জন্যে আদেশ ছিল একে অন্যের ছবি যেন না দেখে,এমন কি কোন আলাপ আলোচনাও যেন না করে।প্রায় সাইত্রিশ বছর চার মাস এ ভাবেই দুজন প্রতিভাবান শিল্পী আবদুল্লাহ খানের কথামতই একে অন্যকে বর্জন করে তুলির আঁচড়ে তাদের মনের কথাগুলো এঁকে গেছে,তাদের ছবির পার্থক্য বা মিল। যা ছিল সেটা তো জানাই।যদিও তাদের একে অন্যের ছবি দেখার আগ্রহ ছিল আকাশ ছোয়া,উজবেক খানের জীবনাবসানের পর দুজন ছুটে গেল অন্যের ছবিগুলো দেখার জন্যে,তবে তাদের অবাক হওয়া বা হতাশ হওয়া যাই বলা যায়,ছবিগুলোতে ছিল না এমন কোন স্বর্গীয় রুপ আবদুল্লাহ খানের কথামত,খুবই সাধারণ অন্যান্য যে কোন বই এর ছবির মত।দুই ওস্তাদ শিল্পী তখনও উপলদ্ধি করতে পারেনি তাদের ছবির অস্পষ্টতার কারণ আর কিছু না,তাদের হারানো দৃষ্টি,তবে তারা দোষ দিল আবদুল্লাহ খানকে।

প্রচন্ড শীতের রাতে জমে যাওয়া হাতে দেখছিলাম,স্বপ্নের ছবিগুলো,জানি এই বই এর বুখারার ঐ হতভাগা শিল্পীর চেয়ে আমি অনেক বেশী ভাগ্যবান।অন্ধ হওয়ার আগে আমার সৌভাগ্য হলো দেখার কিংবদন্তীর শিল্পীদের ছবির বইগুলো।‘আল্লাহ মহান তোমাকে ধন্যবাদ’,যা শোনা তার চেয়ে আরও সুন্দর ছবিগুলো।
সেই বছর আশি আগে,শাহ ইসমাইল তলোয়ারের জোরে উজবেকদের কাছ থেকে জয় করলো খোরাসান আর হেরাত,আর তার ভাই শাম মির্জা হলো শাসক।জয়ের এই আনন্দ পর্ব দিল্লীর আমীর হুসরেভ এর ভাষায় আছে,‘জয়ের স্মৃতি’নামের একটা বই।বই এ দেখানো নদীর ধারে দুই জয়ী নেতার আলাপ আলোচনার অনুষ্ঠান,দিল্লীর সুলতান,কায়কোবাদ,তার বাবা বাংলার শাসনকর্তা বুঘরা খান,যাদের নিয়ে বই এর কিছুটা অংশ,কিন্ত ঐ দুটো মুখ আবার শাহ ইসমাইল,তার ভাই শাম মির্জার মতও,যারা ঐ বই এর প্রধান চরিত্র।আমি নিশ্চিত গল্পের যে কোন চরিত্রের সাথে অদ্ভুতভাবে তাবুর সুলতানের চেহারার মিল আছে,আল্লাহর কৃপায় বইটা দেখার সূযোগ হলো আমার।

কিংবদন্তীর শিল্পী শেখ মোহাম্মদ এর আঁকা ছবিতে,সুলতানের একজন গরীব প্রজা,সুলতানের জন্যে ছিল তার প্রচন্ড ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।সুলতানের পোলো খেলা দেখার সময় শেখ মোহাম্মদের আশা ছিল,সুলতানের বলটা যেন দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে যায় তার দিকে যাতে সে সুলতানকে তুলে উপহার দিতে পারে,সেই দৃশ্যটা ছিল শেখ মোহাম্মদের।অনেক বার শোনা গল্পটা,গরীব প্রজার,সুলতান তার দেশের শাসনকর্তার জন্যে ভালবাসা,একটা শিষ্যের ওস্তাদের জন্যে শ্রদ্ধা,ভালবাসা,সেই গভীর অনুভুতি কটা আঙ্গুল আর তুলির ছোঁয়ায় ধরা ছবিতে।হাতে বল নিয়ে শক্তিশালী সুলতানের তাকানোর অক্ষমতা,অদ্ভুত ভাবে ফুটে আছে ঐ বই এর পাতায়।জানি একজন নামকরা ওস্তাদের শিষ্য হওয়ার আনন্দটা,নিজেকে একজনের হাতে সর্ম্পূন ভাবে তুলে দেয়া,তার চেয়ে আনন্দটা কম না একজন ওস্তাদের যথাযথ একটা শিষ্য পাওয়ার,দুঃখ হয় তাদের জন্যে যাদের ঐ অনুভুতিটা হয় নি কোনদিন।
পাতাগুলো উল্টে দেখছিলাম হাজার হাজার পাখী,ঘোড়া,সৈন্যের দল,উট,গাছ,মেঘ,প্রেম আর খাজাঞ্চীখানার বামন পুরোনো দিনের শাহ এর মত গর্বের চোখে যেন দেখাচ্ছিল বইগুলো।দুটো লোহার ট্রাঙ্কের মধ্যে সাজানো ছিল সাধারণ বই,এলেমেলো ছবির এলবাম,বের হলো দুটো বই একটা বাঁধানো সিরাজে,আরেকটা হেরাতে।সাদা লালে মেশানো বই এর মলাট আর চীনা পদ্ধতিতে বার্নিশ দিয়ে শেষ করা।বই দুটোর এতই মিল যে দেখে মনে হচ্ছিল একটা আরেকটা থেকে নকল করা।আমি বইগুলো দেখে যখন বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোনটা নকল,দেখছিলাম বই এর শেষ পাতায় নাম,কালিওগ্রাফারদের নাম,দেখার চেষ্টা করছিলাম ছবিতে কোনভাবে লুকোনো শিল্পীর নাম,পরে অবাক হয়ে বুঝতে পারলাম,বই দুটো নিজামীর লেখা,যা ওস্তাদ শেখ আলী তাব্রিজের ছবি দিয়ে সাজানো,একটা খান বংশের কুলাঙ্গার জিহান শাহের জন্যে,আরেকটা খান বংশের গর্ব লম্বা হাসানের জন্যে।ওস্তাদ শেখ আলী তাব্রিজ জিহান শাহের হাতে অন্ধ হওয়ার পর,অন্ধ ওস্তাদ লম্বা হাসানের আশ্রয়ে দ্বিতীয় বইটা তৈরী করে,যা নিঃসন্দেহে প্রথমটা ছাড়িয়ে যায় সব দিক দিয়ে।অন্ধ অবস্থায় আঁকা ওস্তাদের দ্বিতীয় বই এর ছবির সৌন্দর্য মন ছোয়া,যদিও প্রথম বই এর ছবি রং এর প্রাচুর্যতায় চোখ জুড়ানো।বোঝা গেল অন্ধত্বে যদিও ওস্তাদের মনে একটা সরলতার রুপ এনে দিল,তবে কেঁড়ে নিল জীবনের রঙ্গীন রুপ।

০০০০০০

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৩:৫১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×