আগের পর্ব : আল কোরআনঃ এক রত্নভান্ডার
ছায়াতত্ত্ব
[এক]
খ্রীষ্টীয় ধর্মবাদের মূলে প্রোথিত জিওসেন্ট্রিক থিওরি এবং কোপার্নিকাসের প্রবর্তিত যুগান্তকারী তত্ত্ব যা বিজ্ঞানকে জিয়োসেন্ট্রিক থিওরির গ্রহণী অন্ধকার হতে মুক্তিদান করেছিল, সেই হেলিওসেন্ট্রিক থিওরি- এই দুই এর কোনটাই যেখানে পরিপূর্ণভাবে সত্য ছিল না, সেখানে ঐ জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের যুগে বসে কোরআন আজকের উৎকর্ষময় বিজ্ঞানের সত্য ও সঠিক জ্ঞানকে অতি সহজ ভাষায় প্রকাশ করে রেখেছিল। কোরআনের প্রস্তাবিত সহজ ও বোধগম্য সত্যটি কেবল উপেক্ষা করে যাবার কারনেই মুসলমানরা কোপার্নিকাসের চাইতেও অধিকতর বাস্তব একটি তত্ত্ব দানের সুযোগ গ্রহন করেনি। সুধী পাঠক, আপনার বিষ্ময়কে তাক লাগিয়ে পবিত্র কোরআন উভয় তত্ত্বের বিরোধের অতি সুন্দর মীমাংসা করে রেখেছে। এই সত্যটি আমাদের এই অধ্যায়ে প্রত্যাক্ষ করার সুযোগ পাবেন। একই সাথে দেখতে পাবেন, সামান্য ছায়া যার প্রস্তাবটি অতি সহজ ও সাধারণ- সেই ছায়া বিষয়ক প্রস্তাবের ভিতর সৃষ্টির কত বড় নিগুঢ় রহস্যের ইঙ্গিত রয়েছে। অনুভব করবেন, কোরআন কেবল স্পর্শ দিয়ে গেছে আর এই স্পর্শ জ্ঞানের এক মহা-বিস্তার দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে।
আমরা সকলেই জানি যে গণিতবিদ পিথাগোরাস পৃথিবী-কেন্দ্রীক বিশ্ব-ব্যবস্থার জন্ম দিয়ে যান। এই বিশ্বাসে মনে করা হতো যে সূর্য, চন্দ্র, জানা পাঁচটি গ্রহ- এরা সকলেই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। দার্শনিক এরিষ্টটল এসে এই পাল্লাটি আরো ভারী করলেন। মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই পৃথিবী- আর তা হলো স্থির এবং দৃশ্যমান আকাশ হলো একটি নিখুঁত ও অনড় গম্বুজ সদৃশ পূর্ণাঙ্গ ও অপরিবর্তনশীল (perfect) সৃষ্টি, তারারা হলো ঐ গম্বুজে এঁটে থাকা বাতি- এই সব শ্রুতিমধুর চিন্তা-ভাবনা দিয়েই মানব জাতির মহাবিশ্ব সংক্রান্ত জ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। আর এই তত্ত্বকে বিশেষভাবে পছন্দ করলেন খ্রীষ্টান ধর্মযাজকগণ, যাদের একটা বিশেষ অংশ আজো জিয়োসেন্ট্রিক মতবাদের দোসর হয়ে বেঁচে আছেন। আমরা আজ জেনেছি- এটা শুধু একটি ভুল মতবাদই ছিল না, এটি গ্রহণযোগ্যতার যে কোন পরিমাপের কাছে বর্জনীয়।
গ্রীক জ্যোতির্বিদ্যার সর্বশেষ ল্যান্ডমার্ক টলেমি (১০০-১৭৮ এডি) তার এলেমজেষ্ট (Alemgest) পুস্তকে জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের ভিত আরো মজবুত করে দেন। টলেমি শিখিয়ে যান, আকাশ তার গম্বুজের বক্রতলে সূর্য-তারাদের নিয়ে প্রত্যেক রাতে একবার প্রদক্ষিন করে যায়। এ বিশ্বাসটি প্রচলিত ছিল টলেমি-যুগ হতে আরো ১৫০০ বছর পর্যন্ত। ইতিহাস এই সময়কে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহণকাল অর্থাৎ অন্ধকার সময় হিসাবে চিহ্নিত করেছে। "For nearly 1500 years after Ptolemy, astronomy in Europe entered a period of total eclipse" -The Dark Age. সূধী পাঠক, এই তথ্যটিকে বিশেষভাবে মনে রাখবেন। বিশেষ করে মনে রাখতে হবে এ জন্য যে, এই গ্রহণকালের মধ্যেই অবতীর্ণ হয়েছিল পবিত্র কোরআন। খ্রীষ্টীয় সাত শতকে জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের দ্বারা বেষ্টিত দুনিয়ায় বসে পবিত্র কোরআন হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের চাইতেও অধিতর সাফল্যজনক এবং চূড়ান্ত তত্ত্ব দান করে যায়। এমনি একটি বিষ্ময়কর সত্য আমাদের সামনে অতি অনাদরে অবহেলায় উপেক্ষিত হয়। অথচ সম্পূর্ণ নির্ভুল নয় সেই হেলিওসেন্ট্রিক থিওরিকে বিজ্ঞানের অঙ্গনে রেনেসাঁ এনেছিল বলে ইতিহাসে সম্মান দেয়া হয়েছে।
১৫৪৩ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত পুস্তক On the Revolution of the celestial Spheres এর উদ্ধৃতি কোপার্নিকাসের হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের সারবস্তু তুলে ধরে - "As if seated upon the royal throne, the sun rules the family of the planets as they circle round" - রাজকীয় সিংহাসনে বসে সূর্য তার সৌর-পরিবারের সদস্য গ্রহদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে - এটাই বক্তব্য। উল্লেখ্য যে কোপার্নিকাস একটি স্থির সূর্যের কল্পনা করেছিলেন। জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বে পৃথিবী স্থির এবং হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বে সূর্য স্থির- এই মিলটি ছাড়া এই দুই তত্ত্বে যে বৈপরীত্যটি ছিল তা হলো, পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থা হতে বেরিয়ে এসে সূর্য কেন্দ্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা। এতে কৃতিত্বটি ছিল এইটুকু যে, প্রথমটিতে একটি গ্রহ অন্যান্য গ্রহদের কেন্দ্রবিন্দু, এই মতবাদ হতে দ্বিতীয়টিতে একটি নক্ষত্র গ্রহগুলির কেন্দ্রবিন্দু, এবং পৃথিবীও এই নক্ষত্র-ব্যবস্থায় নক্ষত্রকেন্দ্রিক ঘূর্ণনে নিরত রয়েছে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থল নয়- এই বাস্তবতাটিতে পৌছা। শুধুমাত্র এইটুকু বৈপরীত্যের অবস্থানে পৌঁছুতে বিজ্ঞানকে দেড় হাজার বৎসর অপেক্ষা করে থাকতে হয়। অথচ খ্রীষ্টীয় সাত শতকে কোরআন একটি সুন্দর তত্ত্ব দিয়েছিল যা উভয় তত্ত্বের চাইতে গ্রহণযোগ্যতর এবং আজকের বিজ্ঞানের জ্ঞানে পরিপূর্ণ বিশুদ্ধতায় নির্বাচিত। প্রিয় পাঠক- আমরা এই পাঠে উভয় তত্ত্বের বিরোধ মীমাংসার বাস্তবতাটি প্রত্যক্ষ করব। আমরা উপলব্ধি করতে বাধিত হব যে দৃশ্যতঃ সামান্য একটি তথ্য যাকে আমরা এত যুগ অবহেলা করে এসেছি, আপাতদৃশ্যে যা কোনো জ্ঞানপূর্ণ প্রতিবেদন বলেই মনে হয় না- তেমনি কোনো প্রস্তাব কত পরিপূর্ণভাবে এই দুই মহাতত্ত্বের বিরোধের নিস্পত্তি করেছে।
[দুই]
দৃশ্যতঃ জ্ঞানপূর্ণ নয়, অতি সাধারণ ও জ্ঞানউদ্দীপক মনে হয় না এমনিভাবে কোরআনে প্রস্তাবিত হয়েছে একটি প্রসঙ্গ- তা হলো ছায়া। অথচ এর মাঝে একটি ইতিহাস লেখা হয়ে আছে। ছায়া সম্পর্কে কোরাআনে যে কয়েকটি আয়াত এসেছে আপাতদৃশ্যে সেগুলি অতিশয় সাদামাটা। এই সাদামাটা আয়াতগুলি মোটেই কিন্তু ততটা সাদামাটা নয়। এদের মাঝে যে তথ্য রয়েছে তা জ্ঞানী ও সূক্ষ্মদ্রষ্টাকে ইঙ্গিত করে যায় এক গভীর অনুভূতির জগতের দিকে। আপনার অনুভবকে অসার করে দিয়ে কোরআন এইসব সাদাসিধে আয়াতে সুগভীর তত্ত্ব পেশ করে গেছে যার সাথে রয়েছে আপনার, আমার অস্তিত্ত্বের সম্পর্ক। চলুন, আমরা আয়াতসমূহের প্রস্তাবগুলি পর্যবেক্ষন করি - "তাহারা (অবিশ্বাসকারীরা) কি লক্ষ্য করে না যে, আল্লহ যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহাদের ছায়ারা কিভাবে ডাইনে এবং বায়ে স্থান পরিবর্তন করে? সেজদা করে তাহারা আল্লহকে যখন তাহারা নত হয়" (১৬:৪৮)। কিংবা " তুমি কি লক্ষ্য কর না কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়াকে সম্প্রসারিত করেন; তিনি ইচ্ছা করিলে উহাকে স্থির রাখিতে পারিতেন। অনন্তর আমরা সূর্যকে করিয়াছি ইহার নির্দেশক (২৫:৪৫)। অতঃপর আমরা ইহাকে আমাদের দিকে ধীরে ধীরে উঠাইয়া আনি" (২৫:৪৬)।
ডানে বা বায়ে ছায়াদের স্থান পরিবর্তনের মধ্যে লক্ষ্য করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কি তথ্য থাকতে পারে? তাছাড়া আল্লহপাকের প্রতি ছায়াদের সেজদাবনত হবার মধ্যে কোন বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে- তা সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন হয়ে আসে। তিনি ছায়াকে নিশ্চল রাখতে পারতেন- এই তথ্যই-বা মানুষের জেনে লাভ কি? অন্যদিকে ছায়ার দিশারী তো সূর্যই- তা কোরআন দাবী করুক কিংবা না করুক, এটি একটি সহজ সত্য বৈ কিছুই নয়। এতদসত্ত্বেও কোরাআনের পাতায় কোনরূপ বিশেষত্ব ছাড়াই কি এই প্রস্তাবগুলি মুদ্রিত হয়েছে?
(চলবে......)
বি.দ্র. : কোরআনের আয়াত সমূহ সাধু ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে।
-------------------------------------------------------------------
পরবর্তী পর্ব : ছায়াতত্ত্ব-২
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




