আগের পর্ব: ছায়াতত্ত্ব-১
হেলিওসেন্ট্রিক ও জিয়োসেন্ট্রিক অন্ধকার থেকে আলোর পথে
ছায়াদের গতি-চরিত্র নিয়ে কোরআন বিশ্লেষকগণ যেসব তথ্য দিয়েছেন তা সবই আমাদের জানা। ড. মরিস বুকাইলি ছায়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন তার বিখ্যাত "বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান" পুস্তকে। তার আলোচনার সারাংশে ঐশী মহাবিজ্ঞানের কোনো ইঙ্গিত নেই*। তেমনি আল্লামা Yusuf Ali তার বিখ্যাত The Holy Quran-এ এই আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা দিতে কোরআনের অনুভূতি হতে অনেক দূরে রয়েছেন। তাদের এই দূরত্বের অবস্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে কোরআনের মূল্যবান প্রস্তাবকে আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়েছি। মূলতঃ আমাদের ব্যর্থতার জন্য আমরাই কেবল লজ্জিত হবার শর্ত সৃষ্টি করি- কোরআনকে না বোঝার ব্যর্থতা আমাদের। প্রকৃতপক্ষে আল্লহপাক যথার্থই বলেছেন যে - "এই কিতাবে কোনো কিছুর বর্ণনাই বাদ দেওয়া হয় নাই" (৬:৩৮)। ছায়ার প্রসঙ্গটিও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যদিও আমরা তার প্রস্তাব ও অনুভূতিকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
আসুন আমরা ছায়া বিষয়ক নিস্পত্তির আগে দেখি বিজ্ঞান যে সময়কে জ্যোতির্বিদ্যার গ্রহণকাল বলে চিহ্নিত করেছে, সেই সময়ের মধ্যে অবতীর্ণ কোরআন পৃথিবী ও সূর্যের সম্পর্কে আমাদেরকে কি তথ্য দেয়।
মনে করুন আমরা কেউই পৃথিবী কিংবা সূর্যের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন নই এমন অজ্ঞ মানুষ, যাদের বসবাস খ্রীষ্টীয় সাত শতকের কোন সময়ে যখন কোরআন অবতীর্ণ হয়ছে। আমরা দেখছি সকালে ও সন্ধ্যায় ছায়া প্রলম্বিত হয় এবং এই দুয়ের মধ্যবর্তী সময়ে ছায়ারা সংকুচিত হয়ে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। এমতাবস্থায় কোরআন ছায়া সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত আয়াতগুলি পেশ করেছে। ছায়াদের ডানে ও বামে স্থান পরিবর্তন করার বিষয়ে আমরা যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করি আমরা এই কোরআনিক নির্দেশও পেয়েছি। আসুন দেখি এমনি পরস্থিতিতে কোরআন থেকে আমরা কি তথ্য পাই।
স্বাভাবিক কারনেই আমাদের মনে প্রশ্ন উদিত হবে- ছায়াদের কেন সকাল সন্ধ্যায় আকৃতির হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে? আমরা দৃশ্যতঃ যা বুঝতে পারি, তা হলো যে সূর্য পুর্ব হতে পশ্চিমে স্থান পরিবর্তন করে, তাই তার অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য ছায়ারা পশ্চিমে ও পূর্বে দিক পরিবর্তন করে। এখানে আমরা প্রকৃতিতে যা দেখি, সে অনুসারে পৃথিবী স্থির, সূর্যই ঘোরে। আমরা জিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের অভিমত মেনে নিতে পারি যে পৃথিবী অনড় ও সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। এখন আমরা কোরআনের আয়াতের পর্যালোচনা করব - "সূর্য ও চন্দ্র আবর্তন করে সুনির্ধারিত কক্ষপথে (৫৫:৫)। সূর্যের সাধ্য নাই চন্দ্রকে নাগালে পায়, রাত্রির সাধ্য নাই দিবসকে অতিক্রম করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষে পরিভ্রাম্যমান (৩৬:৪০)। সূর্য তাহার গন্তব্যের (যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে) উদ্দেশ্যে ভ্রমণে নিরত। ইহা মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানীর সুনির্ধারিত ব্যবস্থা (৩৬:৩৮)। তিনি চন্দ্র ও সূর্যকে করিয়াছেন নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই পরিভ্রমণ করে একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত (৩১:২৯)"।
৩৬:৪০ আয়াতের রেশ টেনে এ পরিস্থিতিতে আমরা বলতে পারি যে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ইত্যাদি সকলেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমনশীল। পৃথিবী নিজ কক্ষপথে চলনে নিরত। প্রতিদিন সূর্য আমাদের পৃথিবীর পূর্ব হতে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে, ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সূর্য হারিয়ে যাচ্ছে না। তার অর্থ হলো পৃথিবী তার চলার পথে অবশ্যই সূর্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমনভাবে, স্টিমারের সাথে বাঁধা বোট বা ডিঙ্গিকে যেভাবে মূলযানটি টেনে নিয়ে যায়। আমরা যেহেতু কোরআন হতে প্রত্যেক বস্তুর সঞ্চালনের তথ্য সম্পর্কে অবগত রয়েছি এবং সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিন করতে দেখতে পাই, সেহেতু আশা করতে পারি যে - পৃথিবী যদি অদৌ কোন কক্ষপথে সঞ্চালনশীল হয়, তবে অবশ্যই সূর্যকে ডিঙ্গিনৌকার মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, ফলতঃ প্রতিদিন সূর্য-পৃথিবীর অপরিবর্তনশীল সম্পর্ক বজায় থাকছে। সিদ্ধান্তটি অবশ্যই আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করবে- কারণ প্রকৃতিতে যা ঘটছে তার অবলোকনের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের কোনো বিরোধ নেই।
এখন আমরা কোরাআনের ৩৬:৩৮ আয়াতের দিকে তাকালে একটু ভিন্নতর প্রস্তাব প্রত্যক্ষ করি- "সূর্য তাহার গন্তব্যের উদ্দেশ্য ভ্রমণে নিরত। ইহা মহাপরাক্রমশালী মহাজ্ঞানীর সুনির্ধারিত ব্যবস্থা"। এই আয়াত আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্তকে (পৃথিবী কেন্দ্রিক ধারণাকে) সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়। সূর্য তার নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে থাকে এ তথ্য আমরা আয়াত ৩৬:৪০ হতে পেয়ে থাকি এবং আয়াত ৩৬:৩৮-এ সূর্যের আরো একটি বাড়তি গতির তথ্য সম্পর্ক জানতে পাই- সেটি হল তার গন্তব্য বা مُسْتَقَرٍّ (মুছতাকার) এর উদ্দেশ্যে ভ্রমণের তথ্য। তাহলে আমরা দেখছি যে পূর্বের ধারণা, অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যকে টেনে নিয়ে যাবার তথ্যটি ভুল। এখানে আমরা সিদ্ধান্ত পাই যে, সূর্যই একটি গন্তব্যের পানে ছুটে চলছে, আর এই ছুটে চলার সময় সে পৃথিবীকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে পূর্বের কথিত ডিঙ্গি নৌকার মতো। সূর্য পৃথিবীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই তথ্যটি আমরা প্রাকৃতিক ভাবেই পেয়ে থাকি, কারণ প্রতিদিন একটি অনুপাতে আমরা পৃথিবী, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহদের অভিন্ন সম্পর্ককে বিদ্যমান থাকতে দেখি। উপরের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আমরা আর জিয়োসেন্ট্রিক তত্ত্বের কথা অনুমোদন করতে পারি না। এ পর্যন্ত এসে আমরা কোরআন হতে যে সকল তথ্য পেয়েছি, তা নিম্নরূপঃ
ক) পৃথিবী ও সূর্য উভয়েরই নিজস্ব কক্ষপথ আছে।
খ) প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে সদা চলমান।
গ) সূর্যের জন্য একটা গন্তব্যস্থল রয়েছে, সূর্য সে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সব সময় ছুটে চলছে।
এই তথ্যসমূহকে সম্ভাব্যতার ছকে সাজালে আমরা সহজেই পেয়ে যাই যে- যেহেতু পৃথিবী ও সূর্যের সম্পর্ক একটি অপরিবর্তিত অনুপাতে বিদ্যমান, সেহেতু উভয়ই নিজ নিজ কক্ষে সন্তরণরত এবং যেহেতু সূর্য একটি গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে, সেহেতু পৃথিবীর কক্ষ অবশ্যই সূর্য কেন্দ্রিক, সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না-- আর এই শর্তটি পূরণ না হলে লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে চলমান সূর্য পৃথিবী হতে হারিয়ে যেত। এখানে এসে সূর্য কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সে প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয়। সূর্য নিজ কক্ষে কোনো অজানাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমনে নিরত রয়েছে- এই তথ্যগুলি কোপার্নিকাসের সূর্য ব্যবস্থার Royal throne বা রাজকীয় সিংহাসনের উচ্ছেদ ঘটায়। এই আয়াত সমূহ জিয়োসেন্ট্রিক ব্যবস্থাকে যেমন নাকচ করে দেয়, তেমনি মহাবিশ্ব হেলিওসেন্ট্রিক নয় সে ধারণার জন্ম দিয়া যায়, যা রেনেসাঁ সৃষ্টিকারী হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের অনেক অনেক অগ্রে অবস্থান নেয়। খ্রীষ্টীয় সাত শতকে কোনো কোরআন গবেষক যদি মাত্র দু'তিনটি আয়াতকে সত্যতায় বিশ্লেষণ করতেন, দেখতে পেতেন পবিত্র কোরআন প্রচলিত জ্ঞানের কত সম্মুখে অবস্থান নেয়। "তাহারা কি সতর্কতার সঙ্গে কোরআনকে অনুধাবন করে না? আর যদি উহা আল্লহ ছাড়া অন্য কাহারো নিকট হইতে আসিত, তবে অবশ্যই তাহারা উহাতে বহু অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতি প্রত্যক্ষ করিত (৪:৮২)। ইহা তো মানুষের জন্য এক বার্তা, যাহা দ্বারা উহারা সতর্ক হয় এবং জানিতে পারে যে, তিনিই একমাত্র উপাস্য, যাহাতে বোধশক্তিসম্পন্নরা উপদেশ গ্রহণ করে (১৪:৫২)"।
আমাদের আলোচনা সুস্পষ্টত তুলে ধরে যে- আল কোরাআন যে ব্যবস্থার অনুমোদন দিয়েছে তা জিয়ো এবং হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের বাইরে একটি পৃথক তত্ত্ব, যার মধ্যে বিবেচনা হলো যে পৃথিবী বা সূর্য কেহই স্থির নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে এবং সূর্য বা পৃথিবী কেহই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। সূর্য চলমান তার নিজস্ব কক্ষপথে এবং একই সাথে সে একটি গন্তব্যের দিকে অগ্রসারমান (সূর্যের কক্ষপথ ও তার গন্তব্য বা সোলার এপেক্স অভিমুখী যাত্রা নিয়ে সুযোগ পেলে পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব)। বিষ্ময়করভাবে আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করি যে, আজকের বিজ্ঞান যোগ্যতায় অর্জিত জ্ঞানের সাথে কোরাআনের কোন বিরোধ নেই। যেখানে টলেমির পরবর্তী ১৫০০ বছরকে জ্যোতির্বিদ্যার অন্ধকার যুগ বলা হয়, এমন একটি সময়েই উম্মি নবীর উপর অবতীর্ণ কোরআন এক চরম সত্যকে ধারন করে আছে, যা বিজ্ঞানের দুই তত্ত্বকে নাকচ করে দেয় এবং সঠিক তথ্যটি আমাদের জানিয়ে যায়, যখন বিজ্ঞান ছিল একটি শিশু- এই তথ্যটি আমাদের সুচিন্তার দাবি রাখে না কি? কোরআনের আয়াতের বিস্ময়কর মহিমাময় প্রকাশ কেবল কোরআনের আয়াতকেই ডেকে আনে - "যদি তোমরা সন্দিহান হও আমার বান্দার উপর অবতীর্ণ বাণী সমূহের সম্বন্ধে তবে ইহার অনুরুপ একটি আয়াত তৈরী করো যদি সত্যবাদী হও (২:২৩)। যদি না সক্ষম হও এবং কখনোই তাতে সক্ষম হইবে না- তবে ভয় করো সেই অগ্নিকে যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ এবং প্রস্তর পিন্ড (২:২৪)"।
খ্রীষ্টীয় সাত শতকের অজ্ঞানতার অন্ধকারে বসেও পূর্বেকার আলোচনায় আমরা পৃথিবীর একটি কক্ষপথ সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। আমরা জেনেছি কোরআন যে তথ্য দেয়, তা হল সূর্য নয়- পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমণ করে, এবং সূর্য স্থির নয়। এখন আমরা আলোচনাকে ছায়া বিষয়ক প্রশ্নের নিস্পত্তির দিকে নিয়ে যাব।
(চলবে.....)
* ড. মরিস বুকাইলির ব্যাখ্যা
--------------------------------------------------
আগের পর্বগুলো(উল্টাক্রমানুসারে):
- আল কোরআনঃ এক রত্নভান্ডার - ২ (ছায়াতত্ত্ব)
- আল কোরআনঃ এক রত্নভান্ডার
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৮:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




