somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(গল্প) কামরাঙা রঙের জীবন

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘরের দরজা ভেঙে পুলিশ ঢোকার পর থেকেই ঝামেলা শুরু। তার আগপর্যন্ত সবকিছু প্রায় ঠিকঠাকই ছিল। বেশ একটা আদুরে আদুরে সকালের বুকে সাঁতার কাটছিলাম। কিন্তু পুলিশ ঘরের ভেতর মৃতদেহের সাথে আমাকে পেয়ে ভাবল আমি খুন করেছি। আটকে দিল।

তাদেরকে প্রথম প্রথম বোঝানোর বেশ চেষ্টা করেছি যে ঘরের মৃতদেহটা আসলে আমারই। নিজেকে কেউ কখনো খুন করতে যায় না। এটা একটা স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু তারা আমার কথা কানেই তুলল না। আইডি কার্ড দেখিয়েও লাভ হয় নি। পুলিশের বড়কর্তা আইডি কার্ডের ছবির সাথে আমার চেহারা মিলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যেন এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। খুনীরা এসে বলে তারা খুন করে নি। অবশ্য ওকে খুব দোষ দেয়া যায় না। আইডি কার্ডের ছবিটা বেশ পুরনো। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম নতুন একটা ছবি দিবো। কিন্তু তার আগেই ঝামেলা হয়ে গেল।

অবশ্য এরকম একটা ক্রাইম সিনে ডেডবডির সাথে কাউকে পেলে ছাড়বেই বা কেন। হোক না ব্যক্তিটি সে নিজে। আমাকে আপাতত বাসার বাইরে যেতে মানা করা হয়েছে।

পুলিশরা আমার ডেডবডির কাছে গিয়ে নিজদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। বোঝা গেছে ওরা বেশ টাকার গন্ধ পেয়েছে। এরকম একটা ব্যাচেলর লোক মারা যাওয়াটা খারাপ না। অনেককে সন্দেহ করা যায়। আর পুলিশের কাছে সন্দেহ মানেই টাকার টুংটাং।

এই ফাঁকে আমি চোরের মত ফোনটা তুলে রুমুকে ফোন দিলাম। ওর ঘুম ভীষন ভারী। এত সকালে এত সহজে ও ফোন ধরবে বুঝি নি। দুইবার রিং হওয়ার আগেই জড়ানো গলায় ফোন রিসিভ করল ও।।
হ্যালো
হ্যালো রুমু। শোন, একটু ঝামেলা হয়ে গেছে।
কিন্তু ঝামেলাতো কমলই না। বরং বাড়ল। রুমু আমার মরার খবরটা শুনে একটা চিৎকার দিল প্রথমে। তারপর কিছুটা সামলে নিল।
সবসময় তুমি এমন কর।
শোন রুমু। এখন তর্ক করার সময় নেই। ওরা ঘরে ঢুকে আমার ডেডবডি পেয়েছে। আর এখন আমাকেই সন্দেহ করছে।
ঠিকই করছে। আমার নিজেরো সন্দেহ হচ্ছে। তুমি এখন মারা গেলে কি করে বলতো। দুইদিন পর লতিফার জন্মদিন। তোমার কি কমনসেন্স কখনোই হবে না?
আমি ফোনের লাইন কেটে দিলাম। মরার উপর খাড়ার ঘা সহ্যেরও একটা সীমা থাকে।

হইচই শুনে আমাদের বাড়িওয়ালা ইয়াসীন সাহেব উপরে উঠে এসেছেন। তাকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছে। বেচারা নির্ভেজাল মানুষ। এরকম একটা অযাচিত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ায় তার দুঃখের শেষ নেই। আমার মত তিনিও বেশ ভড়কে গেছেন।

সকালে ঘুম পুরোপুরি ভাঙ্গার আগেই চমকে গিয়েছিলাম। আধো ঘুমে নিজের ঘরের মধ্যে একটা লাশ আবিষ্কার করা যথেষ্ঠই ভয়ানক ব্যাপার। সেটা নিজের লাশ হলেতো কথাই নেই, অনুভূতিটা যথেষ্ঠই জটিল। প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম পুরো ব্যাপারটাই হয়ত একটা স্বপ্ন। তাই আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভেবেছিলাম এবার ঠিক জেগে উঠব। কিন্তু ঘড়ির কাঁটার বিরক্তিকর টিক টিক শব্দ জানিয়ে দেয় অনেকগুলো সেকেন্ড চলে গেছে। এবার শুধু ভয় নয়, খুব বিরক্ত লাগে।

বিরক্তি কোলে নিয়ে মাথার উপর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ঘোরা ফ্যানের নিচে বসে থাকি। একহাতে দেয়াল ধরে ক্যালেন্ডারটা তার দুই পা ইচ্ছেমত ঝাঁকাচ্ছে। যেন এরকম আর কোন মজার খেলা নেই। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল আজ ছুটির দিন। বিকেলে পলাশের সাথে দেখা করার কথা। অথচ মরে গিয়ে কি ঝামেলাতেই না পড়লাম।

পলাশের সাথে সন্ধ্যায় ছাদে যাওয়ার কথা ছিল। সবাই নাকি আসবে। অনেকদিন সন্ধ্যায় আমাদের সেই ছাদের ওপর মাদুর বিছিয়ে আড্ডা দেয়া হয় না। অথচ কিছুদিন আগেও প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ওখানে আড্ডায় বসতাম আমরা ক'জন। পাশে ফ্লাস্কভর্তি চা আর সিগারেটের প্যাকেট রেখে চলত আয়েশ করে আকাশ দেখা। আলোর দিনে শুকনো সন্ধ্যা জ্বেলে রাতের অন্ধকার পোহাতাম আমরা।

এইসব ভাবতে ভাবতে চায়ের তৃষ্ণা পেল। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছিল না। বারান্দা থেকে চুমুক চুমুক তাজা বাতাস তাদের সবটুকু গন্ধ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছিল আমার মৃতদেহের উপর। ততক্ষনে অবশ্য লাশটা চোখে মানিয়ে গেছে। বুকভরা বাতাস টানার সময় টের পেলাম অনেকদিন আমার সকাল দেখা হয় না। বারান্দার পাশের বকুল গাছটার সাথে আমার শেষ কবে কথা হয়েছিল ঠিক মনে নেই। অথচ প্রতি সকালেই ওর নিচ দিয়ে অফিস যেতে হত। বড্ড ব্যস্ত ছিলাম।

এইরকম একটা সময়ে বুটের আওয়াজ পেলাম। খুব জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ। যেন ভেঙ্গে ফেলবে। একটা বিশ্রী গালি দিয়ে উঠব, ঠিক তখনই দরজার কপাট খোলার ভারী শব্দ আছড়ে পড়ে। এত তাড়াতাড়ি পুলিশ কিভাবে খবর পেল জানিনা। কাউকে যে সে কথা জিজ্ঞেস করব তারও উপায় নেই। তাদের মধ্যে কি এক অনর্থক ব্যস্ততা। অথচ ঘর ভরে আছে বকুল ফুলের গন্ধে, কেউ খেয়ালই করল না।

হ্যালো পলাশ।
কি ব্যাপার স্যার। দেখা করার কথাতো বিকেলে। এত আগে ফোন দিলেন যে?
ফাজলামী করিস না। একটা খারাপ খবর আছে।
কি?
পলাশ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল। ওর গলার স্বরে বিন্ধু বিন্দু ঘাম জমছে।
আমি মারা গেছিরে। আমার ঘরে এখন পুলিশ। ডেডবডি নিয়ে বসে আছে।
পলাশ কিছু বলল না। ঠান্ডামাথায় ভাবছে। গলার স্বর যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
তুই কিছু চিন্তা করিস না। আমি আসছি।
না চাইতেও একটা মুচকি হাসি আমার শুকনো ঠোঁটের একপাশ ধরে ঝুলে পড়ল। আমার জীবনে চিন্তার অনেক কিছু ছিল। কিন্তু মরনে আর চিন্তার কিছু নেই।
আচ্ছা তুই কি জানিস আমি শেষ কবে কবিতা লিখেছিলাম?
পলাশ একমুহূর্ত চুপ করে থাকে।
আমি জানিনারে। আমি আসছি দাঁড়া।

পলাশ মুখ অন্ধকার করে বসে আছে।
মরে যাবার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপারটা কি জানিস?
পলাশ মুখ তুলে তাকালো। ওর চোখে বিষন্ন জিজ্ঞাসা।
আমি আসলে আরো অনেক আগেই মারা গিয়েছিলাম। এতদিনে শুধু আনুষ্ঠানিকতার পালা বিদায় হল। শেষবার রুমুকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একদিন আবিষ্কার করলাম আমরা দু'জন দু'জনের কাছে অভ্যাস হয়ে গেছি শুধু। আমার কবিতারাও হারিয়ে গেছে।
পলাশ মুখ নিচু করে শুনে যায়। কবিতারা যেন পোস্ট অফিসের ঠিকানা ভুলে পথ হারিয়েছে। কতদিন প্রিয়জনদের ডেকে শোনানোর মত প্রিয় একটা গান খুঁজে পাই নি। একই ছন্দের জীবনের গান গাইতে গাইতে আমি কবে জানি মারা গেছি।

পুলিশের বড়কর্তা ডেকে পাঠালেন। তার চোখে বিরক্তি। টকটকে টাক ঘামে ভিজে চকচক করছে। একটু পর পর রুমাল বের করে মুখ মুছছেন।
আপনি ইচ্ছা করলে চলে যেতে পারেন।
চলে যেতে পারি মানে। আমিতো এখানেই থাকি। এরা কি ইচ্ছে করে এমন করছে নাকি।
আমাদের প্রাথমিক পরীক্ষায় এটাকে একটা আত্নহত্যা বলেই মনে হচ্ছে। সুইসাইড কেসেতো আর আরেকজনকে ধরে নিতে পারি না। পুলিশ হলেওতো আমাদের একটা বিবেচনা আছে। নাকি?
বলে নিজেই হা হা করে পেট দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। যেন এটা খুব মজার একটা কথা। আমি আস্তে করে দরজা ঠেলে বের হয়ে আসি। তার ঘর কাঁপানো হাসি পেছনে পড়ে হাসতে থাকে।

নানারকম ভাবনা মাথায় গুন গুন করছে। জীবিত থাকতে ব্যর্থ মানুষরা কি তবে এভাবেই মারা যায়? জানিনা। মধ্যরাতের হাইওয়ে ধরে হাঁটছি। কোন একটা পথের আড়ালে ভোর লুকানো আছে। পথটা খুঁজে বের করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৬ রাত ১:২৮
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×